ভ্যাকসিন রাজনীতিতে এগিয়ে থাকবে চীন-রাশিয়া

বাংলাদেশের স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয় রাশিয়া ও চীনের করোনা টিকার জরুরি ব্যবহারের অনুমোদন দিয়েছে। সরকার আশা করেছে আগামী মে মাসেই বাংলাদেশ রাশিয়ার টিকা পাবে। শুধু বাংলাদেশ নয় বিশ্বের আরও অনেক দেশ রাশিয়ার টিকা নেওয়ার জন্য জোর চেষ্টা চালাচ্ছে। অপরদিকে রাশিয়াও তার মিত্র দেশগুলোতে টিকা রপ্তানি করতে আগ্রহী।
Corona vaccine

বাংলাদেশের স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয় রাশিয়া ও চীনের করোনা টিকার জরুরি ব্যবহারের অনুমোদন দিয়েছে। সরকার আশা করেছে আগামী মে মাসেই বাংলাদেশ রাশিয়ার টিকা পাবে। শুধু বাংলাদেশ নয় বিশ্বের আরও অনেক দেশ রাশিয়ার টিকা নেওয়ার জন্য জোর চেষ্টা চালাচ্ছে। অপরদিকে রাশিয়াও তার মিত্র দেশগুলোতে টিকা রপ্তানি করতে আগ্রহী।

রাশিয়ার টিকার চাহিদার প্রধান কারণ হচ্ছে এর কার্যকারিতা। ল্যানসেটে প্রকাশিত গবেষণা প্রতিবেদন অনুযায়ী এই টিকার কার্যকারিতা প্রায় ৯১ শতাংশ এবং মাঠ পর্যায়ে আরও বেশি যা অন্য যেকোনো টিকাকে ছাড়িয়ে গেছে।

অন্যদিকে রাশিয়ার টিকা প্রস্তুতকারী প্রতিষ্ঠান গামালিয়া রিসার্চ ইনস্টিটিউটের দাবি স্পুতনিক-ভি’র কার্যকারিতা আরও বেশি। প্রায় ৯৭ দশমিক ৬ শতাংশ। বিশ্বের প্রায় ৬০টি দেশ স্পুতনিক-ভি টিকা ব্যবহারের অনুমতি দিয়েছে। যদিও এই টিকা এখনও অনুমোদন দেয়নি বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা। তার পরও রাশিয়ার মিত্র কিংবা শত্রু দেশও এই টিকা পেতে দিন দিন মরিয়া হয়ে উঠছে। ভারতের কাছ থেকে অক্সফোর্ড-অ্যাস্ট্রাজেনেকার টিকা না পেয়ে বাংলাদেশ ইতিমধ্যে চীন-রাশিয়াসহ অন্যান্য দেশের সঙ্গে যোগাযোগ করছে।

গত মঙ্গলবার চীনের সঙ্গে দক্ষিণ এশিয়ার পাঁচটি দেশের (বাংলাদেশ, শ্রীলংকা, নেপাল, পাকিস্তান, এবং আফগানিস্তান) পররাষ্ট্রমন্ত্রীরা একটি ভার্চুয়াল মিটিং করেছে এবং চীনের নেতৃত্বাধীন ‘কোভিড -১৯ পরামর্শ, সহযোগিতা এবং মহামারি-পরবর্তী অর্থনৈতিক পুনরুদ্ধারের জন্য চীন-দক্ষিণ এশিয়া প্ল্যাটফর্ম’ এ যোগ দিয়েছে এবং চীনের কাছ থেকে টিকা প্রত্যাশা করেছে। চীন-রাশিয়ার এই নতুন নতুন প্লাটফর্ম করোনা মহামারির বৈশ্বিক রাজনীতির উদাহরণ। এর মধ্যে দিয়ে দক্ষিণ এশিয়ায় ভারতের থেকে চীন এখানে এক ধাপ এগিয়ে গেল।

রাশিয়া করোনার টিকা উৎপাদন শুরু করেছে গত বছরের অগাস্ট থেকে। গত বছর ৫ ডিসেম্বর থেকে এই বছরের ৩১ মার্চ পর্যন্ত রাশিয়া তার ৩৮ লাখ নাগরিকে এই টিকা দিয়েছে এবং একটা গবেষণায় দেখা গেছে দুই ডোজ টিকা নেওয়া ৩৮ লাখ মানুষের মধ্যে করোনা সংক্রমণের হার মাত্র ০.০২৭ শতাংশ।

রাশিয়া শুধু যে স্পুতনিক-ভি টিকা তৈরি করছে তা নয়। রাশিয়ার সঙ্গে চুক্তি করে চীনের হুয়ালান বায়োলজিক্যাল ব্যাকটারিন এবং রুশ ডাইরেক্ট ইনভেস্টমেন্ট ফান্ড (আরডিআইএফ) মিলে চীনে বছরে ১০০ মিলিয়ন স্পুতনিক-ভি টিকা তৈরি করতে প্রতিশ্রুতিবদ্ধ হয়েছে। চীন যে ভ্যাকসিন (সিনোফর্ম) তৈরি করেছে এখন পর্যন্ত এর ২২৯ মিলিয়ন ডোজ মানবদেহে দেওয়া হয়ে গেছে। এছাড়া গণমাধম্যের খবর অনুযায়ী সমপরিমাণ ভ্যাকসিন তারা বিদেশে রপ্তানি করেছে।

এখন যদি চীন-রাশিয়ার টিকা সত্যিই কার্যকর হয় এবং রাশিয়ার টিকা সম্পর্ক বিশ্বের অধিকাংশ দেশের সঙ্গে শর্ত সাপেক্ষে বা বিনা শর্তেও স্থাপিত হয় এবং মানুষের প্রাণরক্ষা হয় তবে রাশিয়া-চীন বিশ্ব-রাজনীতিতে এক ধরনের নতুন মেরুকরণ তৈরি করবে। এটা খুব স্বাভাবিক যে মানুষ কারো কাছে কিছু পেয়ে উপকৃত হলে কৃতজ্ঞ হয়। সেটা পরম শত্রু হলেও সেই অনুভূতি হয়। হয়তো অনেকে সেই কৃতজ্ঞতা মুখে প্রকাশ করে না কিন্তু অন্তরে সেই অনুভূতি অবশ্যই সৃষ্টি হয়। আর এই অনুভূতির প্রভাব পড়ে বিশ্ব-রাজনীতিতে।

অন্যদিকে আমেরিকা এমন কঠিন পরিস্থিতির মধ্যেও ভারতে ভ্যাকসিনের কাঁচামাল রপ্তানি বন্ধ করে দিয়েছে। পরে দুই-তিন দিন আগে অবশ্য আবার কাঁচামাল দিতে সম্মত হয়েছে। ভারত আবার নিজেদের সংকট নিরসনে বাংলাদেশে প্রয়োজনীয় অক্সিজেন এবং টিকা রপ্তানি বন্ধ করে দিয়েছে। যার ফলে বেক্সিমকো এবং সরকারের মধ্যে সম্পর্কের ধরন প্রকাশ্যে এসেছে।

এখন পর্যন্ত বিশ্বের ১৪টি দেশ (চীন, আমেরিকা, রাশিয়া, ভারত, যুক্তরাজ্য, জার্মানি, বেলজিয়াম, নেদারল্যান্ডস, ব্রাজিল, দক্ষিণ কোরিয়া, দক্ষিণ আফ্রিকা এবং সুইজারল্যান্ড) করোনা টিকা তৈরিতে সক্ষম হয়েছে। এদের মধ্যে সবচেয়ে বেশি টিকা তৈরি করেছে চীন।

করোনা মহামারির শুরুতে জাতিসংঘ, বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা, আমেরিকা এবং নোবেল বিজয়ী অনেক বিশ্ব বরেণ্য ব্যক্তিত্ব, রাজনীতিবিদ, লেখক, কবি একটি দাবি করেছিলেন যে করোনার ভ্যাকসিন নিয়ে যেন খুব খারাপ কিছু (রাজনীতি) না হয়। সার্বজনীন মানবতার খাতিরে কোভ্যাক্স-এর মাধমে যেন করোনার টিকাকে সহজলভ্য করা হয়। বিশ্বের গরিব দেশগুলোর যেন সহজে টিকা পেতে পারে। এতে অনেক দেশ রাজি হলেও টিকা যখন উৎপাদন শুরু হলো তখন বিশ্বনেতাদের আবেদনের প্রতিফলন দেখা গেল না বরং টিকা উৎপাদনকারী প্রতিষ্ঠান এবং দেশগুলো জাতীয়তাবাদী রাজনীতি শুরু করেছে। অনেক প্রতিষ্ঠান টিকার ফর্মুলা গোপন রাখার জন্য যথাসাধ্য চেষ্টা চালাচ্ছে। ভালো মুনাফার জন্য চেষ্টা করছে উৎপাদনকারী প্রতিষ্ঠানগুলো। ভারতের সেরাম ইনস্টিটিউট খোদ ভারতের বিভিন্ন রাজ্যে টিকার দাম নির্ধারণ করেছে বিভিন্ন। সরকারি হাসপাতালে কম হলেও বেসরকারি হাসপাতালে ডোজ প্রতি ৬০০ রুপি নির্ধারণ করেছে। আবার কোভ্যাক্সিনের দাম বেসরকারি হাসপাতালের জন্য প্রতি ডোজ ১২০০ রুপি নির্ধারণ করেছে ভারত বায়োটেক।

সব রাষ্ট্র আগে তার দেশের মানুষের টিকা নিশ্চিত করতে চায়। ফলে গরিব দেশগুলোর সময় মতো টিকা পাওয়া অনেকটা অনিশ্চিত হয়ে পড়েছে এই মুহূর্তে।

তবে আশার খবর হলো, কিউবার ভ্যাকসিন নীতি এ ক্ষেত্রে ভিন্ন। আমরা জানি কিউবার স্বাস্থ্য খাত অনেক উন্নত। করোনার টিকা তারা নিজেরাই তৈরি করছে। এখন পরীক্ষার তৃতীয় পর্যায়ে আছে এবং ভালো কার্যকারিতা দেখাচ্ছে। কিউবা শুধু নিজেদের জন্যই টিকা তৈরি করছে না। তারা গরিব দেশগুলোকে করোনা টিকা দিবে এবং আন্তর্জাতিক গণমাধ্যমের খরব অনুযায়ী কিউবা ইতিমধ্যে গরিব এবং উন্নয়নশীল কিছু দেশের কাছ থেকে প্রায় ১০০ মিলিয়ন ডোজের অর্ডার পেয়েছে। এখন দেখার অপেক্ষা কিউবা কি করে।

টিকা উৎপাদনকারী ধনী দেশগুলো যদি মনে করে যে সবার আগে তারা দেশের মানুষের টিকা দিয়ে নিজেদের জাতীয় নিরাপত্তা সুরক্ষিত করবে তাহলে সেটা হবে ভুল। কারণ বিশ্বায়নের এই যুগে টিকা না পাওয়া গরিব দেশগুলো থেকে নতুন নতুন ভ্যারিয়েন্ট নিয়ে করোনা হানা দিবে ধনী দেশগুলোতে। এতে করে বিপর্যয় আরও বাড়বে বৈ কমবে না, এমনিভাবে সতর্ক করেছিলেন করেছিলেন জাতিসংঘের মহাসচিব আন্তোনিও গুতেরেস।

বাংলাদেশের প্রধানমন্ত্রীও মনে করেন যে এই রকম মহামারির সময় কোনো দেশ একলা চলতে পারে না। দরকার পারস্পরিক সহযোগিতা-সাহায্য।

ফরাসি বিপ্লবের পর থেকে পৃথিবীর ঔপনিবেশিক শক্তিগুলো লেজ গোটাতে শুরু করেছিল। ফলে সৃষ্টি হয়েছিল অনেক জাতীয়তাবাদী স্বাধীন রাষ্ট্রের কিন্তু তাতে প্রত্যক্ষ উপনিবেশের সমাপ্তি ঘটলেও রয়ে গেছে প্রচ্ছন্ন উপনিবেশবাদ। আর সেটা ব্যবসা-বাণিজ্য, প্রযুক্তিগত সহায়তা, আর্থিক সহায়তা, আন্তর্জাতিক দাতা সংস্থার মাধ্যমে সহায়তা, উন্নয়নে অংশীদারিত্ব, ভূ-রাজনৈতিক অংশীদারিত্ব, বৈদেশিক ঋণের পৃষ্ঠপোষকতা, অস্ত্র ব্যবসা, দেশের ভেতরে গণহত্যা বা পার্শ্ববর্তী দেশের সঙ্গে স্নায়ুযুদ্ধে প্রকাশ্যে বা প্রচ্ছন্নভাবে মদদ দেওয়ার মাধ্যমে বজায় রেখেছে পরাশক্তিগুলো। সম্প্রতি শুরু হয়েছে করোনা টিকা নিয়ে বিশ্ব-রাজনীতি এবং জাতীয়তাবাদ।

ফরাসি বিপ্লব যেমন বৈশ্বিক রাজনীতিতে সূচিত করেছিল এক বিরাট পরিবর্তনের তেমনি করোনার এই মহামারির ফলে পৃথিবীর রাজনৈতিক প্রেক্ষাপটে আসতে চলেছে বৈপ্লবিক পরিবর্তন। পুরনো ভূ-রাজনৈতিক সম্পদের দখলদারিত্বের থেকে যে উপনিবেশবাদ রাজনীতির সূচনা তা ব্যবসা-বাণিজ্য, সমরাস্ত্র, উন্নয়ন এবং প্রযুক্তির ব্যবসার হাত ধরে রূপ নিয়েছে বৈশ্বিক টিকা রাজনীতিতে। আর এক্ষেত্রে ৯০ শতাংশ নম্বর নিয়ে রাশিয়া-চীন আপাতত এগিয়ে গেল।

বৈশ্বিক প্রকৃতি বিপর্যয় কিংবা মানুষের দুষ্ট বৃদ্ধির বিস্তারের কারণেই হোক কিংবা অজানা অন্য কোনো কারণে হোক, নতুন জীবাণুর এই মহামারি অদূর ভবিষ্যতে আরও ঘন ঘন সময়ে দেখা দিতে পারে। এই আশঙ্কা ইতিমধ্যে পৃথিবীর মানুষকে ভাবিয়ে তুলেছে। তাই অদূর ভবিষ্যতে টিকা বা প্রতিষেধকের ব্যবসা-কেন্দ্রিক রাজনীতি আরও বিস্তার লাভ করবে তাতেও কোনো সন্দেহ নাই।

সার কথা হলো অন্য যেকোনো দুর্যোগের মতো করোনা মহামারিতেও গরিব দেশের মানুষের জীবনের সুরক্ষা নির্ভর করবে ধনী দেশের ভ্যাকসিন নীতি/রাজনীতির উপর।

[email protected]

Comments

The Daily Star  | English

One month of interim govt: Yunus navigating thru high hopes

A month ago, as Bangladesh teetered on the brink of chaos after the downfall of Sheikh Hasina, Nobel Laureate Muhammad Yunus returned home to steer the nation through political turbulences.

8h ago