পশ্চিমবঙ্গ: অপেক্ষার ২ মে

ঘটনাবহুল ভোট এর আগে পশ্চিমবঙ্গে বহু হয়েছে। কিন্তু, এবারের মতো হিংসাশ্রয়ী আর সার্বিক বিভাজনমূলক ভোট এখানে ১৯৪৭ সালের পর আর হয়নি। এই বিভাজনের সর্বশেষ দৃষ্টান্ত, শেষপর্বের ভোটে বীরভূমের বোলপুরে বিজেপি-তৃণমূলের সংঘর্ষকে সেখানকার বিজেপি প্রার্থী অভিহিত করলেন ‘তৃণমূল-আশ্রিত মুসলমান গুণ্ডা’ বলে। এ থেকেই বোঝা যায় যে, এই নির্বাচন কী ধরনের বিভাজনমূলক ছিল।
West Bengal.jpg
করোনা মহামারির মধ্যে পশ্চিমবঙ্গে অনুষ্ঠিত নির্বাচনের আগে তৃণমূল কংগ্রেসের একটি দলীয় সমাবেশ। ছবি: রয়টার্স

ঘটনাবহুল ভোট এর আগে পশ্চিমবঙ্গে বহু হয়েছে। কিন্তু, এবারের মতো হিংসাশ্রয়ী আর সার্বিক বিভাজনমূলক ভোট এখানে ১৯৪৭ সালের পর আর হয়নি। এই বিভাজনের সর্বশেষ দৃষ্টান্ত, শেষপর্বের ভোটে বীরভূমের বোলপুরে বিজেপি-তৃণমূলের সংঘর্ষকে সেখানকার বিজেপি প্রার্থী অভিহিত করলেন ‘তৃণমূল-আশ্রিত মুসলমান গুণ্ডা’ বলে। এ থেকেই বোঝা যায় যে, এই নির্বাচন কী ধরনের বিভাজনমূলক ছিল।

বিজেপি ক্ষমতা দখলের লক্ষে লড়েছে সব রকমের শক্তি দিয়ে। তৃণমূল কংগ্রেস ক্ষমতা ধরে রাখার লক্ষে লড়েছে। আর বামপন্থিরা লড়েছে নিজেদের অস্তিত্ব বজায় রাখার তাগিদে। মোট আট দফা ভোটের পর এই ছবিটা এখন মোটামুটি পরিষ্কার হয়ে যাচ্ছে যে, দেশের প্রধানমন্ত্রীকে পশ্চিমবঙ্গের নিত্যযাত্রীতে পরিণত করেও ক্ষমতা দখলের জন্যে যে ম্যাজিক নম্বর প্রয়োজন, বিধানসভাতে সেই সংখ্যা বিজেপি অর্জন করতে পারার নিশ্চয়তার জায়গায় তাদের নেতারা পৌঁছাননি।

আট দফা ভোটের প্রথম দুই দফায় বিজেপির সঙ্গে রাজ্যের শাসক তৃণমূল খুব একটা কুলিয়ে উঠতে পেরেছিল বলে মনে হয় না। কিন্তু, পরের ছয় দফা ভোটে তৃণমূল টেক্কা দিয়েই চলেছে বিজেপিকে। শেষ ছয় দফার ভোটে শহরগুলোতে বিজেপির প্রচারে জোরদার থাকলেও ভোটের দিন তৃণমূলই বেশি সক্রিয় থেকেছে। তৃণমূলের এই সক্রিয়তার ভেতরে ভোটারদের মানসিকতার যেটুকু আভাস আন্দাজ করতে পারা গেছে, তাতে মনে হয়, নিম্ন আয়ের মানুষের একটা বড় অংশের ভোট এবারও ধরে রাখতে সক্ষম হবেন মমতা।

শিক্ষিত মধ্যবিত্ত, যাদের সমর্থনের ওপর ভিত্তি করে মমতা ২০১১ সালে ক্ষমতায় এসেছিলেন, মমতার শাসক হিসেবে অক্ষমতা, দুর্নীতি, বিজেপিকে সুবিধা পাইয়ে দিতে ইমাম ভাতার প্রবর্তন, তার ভাইপো অভিষেক বন্দ্যোপাধ্যায়কে ঘিরে ব্যাপক অসন্তোষ— এসবের ফলে সেই শিক্ষিত মধ্যবিত্ত ক্রমশ বিরূপ হয়ে উঠতে শুরু করেছিল মমতার উপরে। ইমাম ভাতার ভেতর দিয়ে হিন্দু সম্প্রদায়ের একটা বড় অংশকে বিজেপির দিকে ঠেলে দেওয়ার কৌশলটি মমতার ওপর আরএসএস (রাষ্ট্রীয় স্বয়ংসেবক সংঘ) চাপিয়ে দিয়েছে কি না— এই প্রশ্নটি গত ১০ বছরে বামেরা বারবার তুলেছে। গত লোকসভা নির্বাচনে যে বিভাজনের রাজনীতি প্রকট ছিল, তাতে এসব বিষয়গুলো বিজেপিকে অনেক সুবিধা পাইয়ে দিয়েছিল।

যে অংশের শিক্ষিত মধ্যবিত্ত দুই বছর আগে পশ্চিমবঙ্গে বিজেপির দিকে ঝুঁকেছিল, তারা হিন্দু সাম্প্রদায়িক মানসিকতা থেকে মুক্ত না হলেও কেন্দ্রে বিজেপি সরকারের প্রশাসনিক ব্যর্থতা, দ্রব্যমূল্যের অতিরিক্ত বৃদ্ধি, বিশেষ করে রান্নার গ্যাস, পেট্রল, ডিজেল, কেরোসিনের মূল্য অতিরিক্ত বাড়ায় বিজেপির ওপর এখন তারা এখন চটে আছে। এই মানুষদের ক্ষোভের ফসল রাজ্যের শাসক তৃণমূল কংগ্রেস তুলবে— এটাই অনুমান করা যায়।

গত দুই বছরে বিজেপি তাদের অনুকূলে একটা ধারাবাহিকতা ধরে রেখেছিল। সেই ধারাবাহিকতায় একটা বড় অংশের মানুষ ধরে নিয়েছিলেন, মমতার বিদায় এখন কেবলমাত্র সময়ের অপেক্ষা। কিন্তু, ২০২১ সালের শুরু থেকেই যেন মমতার ভেঙে পড়া রাজনৈতিক দিকটি একটু একটু করে পুনর্নির্মিত হতে শুরু করেছিল। এই পুনর্নির্মাণের পেছনে রয়েছে পশ্চিমবঙ্গের বাইরের বিজেপি নেতাদের সেখানে আসা-যাওয়া ও কথাবার্তা— যা বাংলা ও বাঙালির ভাবাবেগকে ক্রমশ আহত করতে শুরু করে। বাঙালির ভাবাবেগে এই আঘাতটা তৃণমূলের পক্ষে ইতিবাচক হয়ে উঠতে শুরু করে। তৃণমূল শুধু নয়, স্বয়ং মমতা গত লোকসভা নির্বাচনের ঠিক পর থেকেই ভারতের মতো বহুভাষী দেশে ভাষাভিত্তিক শোভিনিজমের খেলা খেলতে শুরু করেন। বিজেপি এদিক থেকে বিধানসভা নির্বাচনের কিছু আগে যেভাবে অন্যান্য রাজ্যের নেতাদের নানা দায়িত্ব দিয়ে পশ্চিমবঙ্গে নিয়ে আসেন, সেটা বাঙালির ভাবাবেগকে যথেষ্ট আহত করে। বাঙালির ভাবাবেগের এই আঘাতটি বিজেপির বিপক্ষে যাবে বলেই সংশ্লিষ্ট মহলের ধারণা।

এবারের ভোটে সাম্প্রদায়িক মেরুকরণকে মোকাবিলা করতে যেভাবে ভাষা-ভিত্তিক মেরুকরণ, ভূমিপুত্র বনাম বহিরাগতের মেরুকরণ বিজেপি আর তৃণমূল পরস্পর নিজেদের রাজনৈতিক সুবিধা পাওয়ার জন্যে করেছে, তার ফলাফল রাজ্যের শাসক তৃণমূলের পক্ষেই যেতে বসেছে বলে রাজনৈতিক বিশ্লেষকদের অভিমত। রাজ্য সরকারের ভয়াবহ দুর্নীতির প্রশ্নটি যে এবারের ভোটে কোনোভাবেই গুরুত্ব পায়নি, তার মূলে রয়েছে দুর্নীতির প্রশ্নে কেন্দ্রীয় সরকার এবং অবশ্যই বিজেপির তৃণমূলকে ছাড় দেওয়ার মানসিকতা। মমতা ও তার ভাইপো অভিষেকসহ ঘনিষ্ঠদের দুর্নীতি নিয়ে বহু কথা বলেছেন প্রধানমন্ত্রী ও স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী। কিন্তু, কেন্দ্রের অধীন সিবিআই সারদা চিটফান্ড নিয়ে তদন্তের কাজে একফোঁটা অগ্রসর হয়নি, অথচ প্রধানমন্ত্রী বলে চলেছেন মুখ্যমন্ত্রীর দুর্নীতি নিয়ে। এই বিষয়টি শেষ পর্যন্ত তৃণমূলের পক্ষে একটা ভাবাবেগ হিসেবে কাজ করেছে। নিম্ন আয়ের মানুষ মমতাকে এখনো তাদের নিজেদের লোক হিসেবেই দেখছেন। সেই মমতাকে হেনস্থা করতে চাইছেন প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদি, এমন একটা মানসিকতা নিম্ন আয়ের ভোটারদের মাঝে তৈরি হওয়া এবং সেই মানসিকতার প্রতিফলন ভোট বাক্সে পড়ার সব রকমের সম্ভাবনাকে এড়িয়ে যাওয়া যায় না।

মমতা গত ১০ বছরে পরিকাঠামোগত ক্ষেত্রে এক বিন্দু উন্নতির মুখ পশ্চিমবঙ্গকে দেখাতে পারেননি। কিন্তু, যেটা পেরেছেন, সেটা হলো— একটা বড় অংশের মানুষকে কাজ করে খাওয়ার সুযোগ করে দেওয়া। সেই সুযোগ দেওয়ার সুফল যে মমতা খুব ভালোভাবেই নিজের ঘরে তুলবেন, তা আর আলাদা করে বলার দরকার নেই। এর পাশাপাশি বলতে হয়, মমতার উল্লেখযোগ্য উন্নয়ন, সেই উন্নয়নের ধারাবাহিকতা মমতা যদি ক্ষমতায় ফিরেও আসেন, সেটা অব্যাহত রাখতে পারবেন কি না, সেই অর্থের জোগান কোথা থেকে আসবে, এসব প্রশ্ন ছাড়াই এই উন্নয়নের জেরে এবারের ভোটে একটা ইতিবাচক ফল নিজের ঝুলিতে নিতে পারবেন মমতা। এমন ধারণাই করছেন সংশ্লিষ্টরা।

বিগত ২০১৬ সালের বিধানসভা নির্বাচনের পর বিরোধী রাজনীতির ক্ষেত্রে বামপন্থিদের অবস্থানটা খানিকটা অলংকৃত হয়ে গিয়েছিল। ইউরোপীয় রাজনীতির আদলে একটা শাসনতান্ত্রিক বিরোধিতাকেই বামপন্থিরা গত ১০ বছরে সব থেকে গুরুত্বপূর্ণ কাজ হিসেবে করে গেছে। মাঠে-ময়দানের রাজনীতি থেকে নেট দুনিয়ার রাজনীতি আর সেখানে একাংশের নতুন প্রজন্মের বামপন্থিদের ব্যক্তিপ্রচারধর্মী রাজনীতি অতীতের লড়াকু বামপন্থিদের ভূমিকাকে ম্লানই শুধু করে দেয়নি, বিজেপিকেও বিরোধী হিসেবে উঠে আসতে সুযোগ করে দিয়েছে।

বামপন্থিরা ২০১১ সালের ভোটের পর শ্যাডো মুখ্যমন্ত্রী হিসেবে তৎকালীন বিরোধী দলনেতা ডা. সূর্যকান্ত মিশ্রকে তুলে ধরেছিলেন। ২০১৬ সালের নির্বাচনে তারা নিজেদের মুখ হিসেবে তুলে ধরেছিল ডা. মিশ্রকে। সেবারের ভোটে শোচনীয় পরাজয়ের পর কিন্তু ২০২১ সালের ভোটে বামেদের মুখ কে হবেন, সেটা একটিবারের জন্যেও বামেরা তুলে ধরেননি। বুদ্ধদেব ভট্টাচার্যের পরে বামেদের ভেতর জননেতা হিসেবে মহম্মদ সেলিমের যে জনপ্রিয়তা, সেটাকে তুলে ধরে ২০১৬ সালের বিপর্যয়ের পর থেকেই ২০২১ সালকে লক্ষ করে বামেরা যদি তৈরি হতেন, তাহলে তাদের কংগ্রেস বা আইএসএফের ওপর এতটা নির্ভর করে এবারের ভোটে লড়তে হতো না।

নতুন প্রজন্মের যেসব ব্যক্তিত্বকে গত পাঁচ বছরের একটা বেশি সময় ধরে সামনে এনেছেন বামেরা, এবারের ভোটে প্রতিদ্বন্দ্বিতা করেছেন, রাজনীতিক হিসেবে, একজন পরিণত নিবেদিত প্রাণ বামপন্থি হিসেবে তারা কতটা গড়ে উঠেছেন— আগামী ২ মে ভোটের ফল প্রকাশের পর এই প্রশ্নটা যে বড় হয়ে উঠবে, তা নিশ্চিত করেই বলা যায়।

গৌতম রায়, ভারতীয় ইতিহাসবিদ ও রাজনীতি বিশ্লেষক

[email protected]

আরও পড়ুন:

যে কারণে ভারতে অক্সিজেন সংকট

পশ্চিমবঙ্গের নির্বাচনে বাংলাদেশ কেন গুরুত্বপূর্ণ ইস্যু

Comments

The Daily Star  | English

DMCH doctors threaten strike after assault on colleague

A doctor at Dhaka Medical College Hospital (DMCH) was allegedly assaulted yesterday after the death of a private university student there, with some of his peers accusing the physicians of neglecting their duty in his treatment

4h ago