শ্রদ্ধাঞ্জলি

কোটি মানুষের জননী জাহানারা ইমাম

Jahanara Imam
শহীদ জননী জাহানারা ইমাম। ছবি: সংগৃহীত

ইতিহাস ঐতিহ্য পুরুষ প্রধান কিন্তু নারী ছাড়া ইতিহাস নয়। তাদের অনেকেই সময় সংস্কৃতি সমাজে অসামান্য অবদান রাখতে সক্ষম হয়েছেন। বাঁধার দেয়াল টপকে আলো ফেলেছেন। সাধারণ থেকে হয়েছেন অসাধারণ। এতে কষ্ট স্বীকার করতে হয়েছে অনেক। তথাপি তাদের কষ্ট সংগ্রামের গল্প নিজেরা লিখতেন না, কেউ আবার লিখতে পারতেন না- সামাজিক ও বৈষয়িক চাপে। এমন সঙ্কোচেই আত্মপ্রকাশ বিঘ্ন হয়। আর না লেখার দরুন সুযোগে পুরুষ কল্পনার মাধুরীতে আল্পনা আঁকে নারীর। রচনা করে কাব্য মহাকাব্যের উপন্যাসের।

সে তুলনায় ব্যতিক্রম জাহানারা চৌধুরী, পরবর্তীতে জাহানারা ইমাম। মাঠে কাজ করেছেন, বলেছেন, সেই সাথে লিখেছেন। পথ চলায় বিশ্বাস করতেন ‘সাহসই হচ্ছে সবচেয়ে বড় হাতিয়ার’। তিনি হয়তো অনুপ্রেরণা পেয়েছেন দক্ষিণ এশিয়ার প্রথম মহিলা নওয়াব ফয়জুন্নেসা চৌধুরানী থেকে। হয়তো বেগম রোকেয়া কিংবা সংগ্রামী নারী হিসেবে কিংবদন্তী বঙ্গজননী সুফিয়া কামাল থেকে। বাংলাদেশে সাম্প্রদায়িকতা ও মৌলবাদের বিরুদ্ধে, নারীর অধিকারের প্রশ্নে তার আপসহীন লড়াইকে বলা যায় সুফিয়া, নীলিমা, জাহানারা ইমামের গৌরবোজ্জ্বল উত্তরাধিকারের ফলাফল।

১৯২৯ সালের ৩ মে ভারতের মুর্শিদাবাদে জন্ম জাহানারা ইমামের। বাবার চাকরি সূত্রে নানা জায়গায় থেকেছেন। শৈশব কেটেছে রংপুরে। পারিবারিক পরিবেশের কারণে খুব বেশি বাড়ির বাইরে যাওয়া হতো না। ফলে আশ্রয় ছিল বইয়ের জগত। ডেপুটি ম্যাজিস্ট্রেট বাবার সূত্রে বাড়িতে নিয়মিত আসতো পত্রপত্রিকা। ক্রমে জাহানারার বইপ্রেম গভীর হয়ে যায় দৈনিক আনন্দবাজার, অমৃতবাজার, আজাদ, স্টেটসম্যান,  শনিবারের চিঠি, ইলাস্ট্রেটেড উইকলি অব ইন্ডিয়া, মাসিক ভারতবর্ষ, প্রবাসী, বসুমতি আর মোহাম্মদীর মাধ্যমে। সাথে বাড়িতে কলের গান, হারমোনিয়াম। পরিচিত হন আঙ্গুরবালা, ইন্দুবালা, হরিমতী, কৃষ্ণচন্দ্র দে, কমলা ঝরিয়া, আব্বাসউদ্দিন আহমদের নামের সাথে। এইভাবে মননশীলতায় স্বপ্ন দেখেন শান্তিনিকেতনে পড়ার। কিন্তু সে স্বপ্ন অধরা থেকে যায়- সফল হয়নি। ১৯৪১ সালের ৯ আগস্ট পত্রিকায় রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের মৃত্যুর খবর পড়ে জাহানারার শান্তিনিকেতন যাওয়ার স্বপ্নেরও মৃত্যু হয়।

তবে দমে যাননি। কলকাতা, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় এবং যুক্তরাষ্ট্র থেকে শিক্ষাজীবন শেষ করে শিক্ষিকা হিসেবে কর্মজীবন শুরু করেন। মনে পড়ে উপনিবেশ যাত্রায় রবীন্দ্রনাথের জাপানযাত্রী বইয়ের কথা। তাতে লেখা, ''পরাধীনতা সব চেয়ে বড় বন্ধন নয়, কাজের সংকীর্ণতাই হচ্ছে সব চেয়ে কঠোর খাঁচা।'' পুরুষ প্রধান সমাজে নিজেকে ঘর থেকে বাহির করেছেন। তিলে তিলে ত্যাগে সংগ্রামে চলার শক্তি অর্জন করেছেন।

১৯৭১ সালে বড় ছেলে রুমী ইমামকে হারান। কয়েক মাসের মধ্যে স্বামী শরীফ ইমামকেও পাকিস্তানী হানাদাররা নির্মম নির্যাতন করে আহত অবস্থায় মুক্তি দেয়। বিজয়ের তিন দিন আগে শরীফ ইমাম মারা যান। বিজয়ের পরে রুমীর সব বন্ধুসহ সকল মুক্তিযোদ্ধা তাকে তাদের জননী হিসেবে মেনে নিয়েছিল। এক শহীদের জননী, হাজার শহীদের জননী, হাজার মুক্তিযোদ্ধার জননী হয়ে ওঠা পরিচিতি পান সবার শহীদ জননী হিসেবে।

সেই আবেগে বাঙালির আবেগপূর্ণ জেমসের গান “স্বাধীনতা তুমি শহীদ জননী জাহানারা ইমামের একাত্তরের দিনগুলি” থাকে কোটি মানুষের কন্ঠে। বিবর্ণ সময়ে শত না পারাকে পারা-র নাম জাহানারা ইমাম। স্বামী সন্তান হারানো মানুষের নিদারুণ যুদ্ধদিনের স্বাক্ষী। ‘একাত্তরের দিনগুলি’ বইতে শহীদ জননী জাহানারা ইমাম ২০ নভেম্বর ১৯৭১ তারিখে ডায়েরিতে বেদনামাখা কিছু কথা লিখেন- “ঈদের কোন আয়োজন নেই আমাদের বাসায়। কারো জামাকাপড় কেনা হয়নি। দরজা-জানালার পর্দা কাচা হয়নি। ঘরের ঝুল ঝাড়া হয়নি। বাসায় ঘরের টেবিলে রাখা হয়নি আতরদান। শরীফ, জামী ঈদের নামাজও পড়তে যায়নি। কিন্তু, আমি ভোরে উঠে ঈদের সেমাই, জর্দা রেঁধেছি। যদি রুমীর সহযোদ্ধা কেউ আজ আসে এ বাড়িতে? বাবা-মা-ভাই-বোন, পরিবার থেকে বিচ্ছিন্ন কোন গেরিলা যদি রাতের অন্ধকারে আসে এ বাড়িতে? তাদেরকে খাওয়ানোর জন্য আমি রেঁধেছি পোলাও কোর্মা, কোপ্তা কাবাব। তারা কেউ এলে আমি চুপিচুপি নিজের হাতে বেড়ে খাওয়াবো। তাদের জামায় লাগিয়ে দেবার জন্য একশিশি আতরও আমি কিনে লুকিয়ে রেখেছি।”

একজন মায়ের উদারতা। সেই প্রেক্ষিতে বলা যায় কিছু মানুষের ঋণ শোধ করা যায় না, যাবে না। জানা অজানায় কত মানুষের পাশে ছিলেন। ব্যক্তিগতভাবে উপকার করেছেন, তা অসাধারণ- অপরিশোধ্য। বৈরী পরিবেশে বড় হওয়া, উচ্চশিক্ষা গ্রহণ করা, সংসারের সাথে সাথে শিক্ষকতা করা। তারপর সংগ্রামে যুক্ত থাকা। মোটকথা সংসার জীবন এবং লেখক জীবনের পাশাপাশি সামাজিক ও সাংস্কৃতিক সংগঠনে নিজেকে সম্পৃক্ত রেখেছিলেন। সাংবাদিকতার সংগেও যুক্ত ছিলেন। কলাম লিখতেন দৈনিক বাংলায়। সর্বোপরি এসব কোনো ভাবেই সাধারণ ঘটনা না।

লিখেই ক্ষান্ত হননি। প্রজন্মের জন্য কাজ করে গেছেন। ভিয়েতনাম যুদ্ধে যারা নিরীহ মানুষকে হত্যা করেছিল, তাদের বিচারের দাবিতে দার্শনিক বার্ট্রান্ড রাসেল ‘পাবলিক ট্রায়াল’-এর আয়োজন করেছিলেন, যা সারা বিশ্বে ব্যাপক আলোড়ন তুলেছিল। সেই একই আদলে বাংলাদেশে ‘গণ-আদালত’ গঠন করে ঐতিহাসিক সোহরাওয়ার্দী উদ্যানে বিচারের আয়োজন করে জাতীয়  কমিটি। এ আন্দোলন সারাদেশে  ব্যাপক সাড়া জাগায়। যদিও দেশের রাজনৈতিক পরিবেশ তখন ভীষণ বৈরী ছিল, কিন্তু জাহানারা ইমামের ডাইনামিক নেতৃত্বে তরুণরা অনুপ্রাণিত হয়েছিলো।

খ.

মুক্তিযুদ্ধ, ইতিহাস, সাহিত্য, সংস্কৃতি, সমাজ সর্ম্পকে আগ্রহী আর জাহানারা ইমামের নাম শোনেননি এমন মানুষ খুঁজে পাওয়া ভার। যার ডায়েরিতে  বাংলাদেশের জন্মের নিমর্ম স্মৃতি মলাটবন্দি। তা  শুধুই স্মৃতিচারণা নয়, ইতিহাসের অসামান্য দলিল। স্বাধিকার আন্দোলন থেকে স্বাধীনতার জন্য সাধারণ মানুষ যে নিপীড়নের স্বীকার হয়েছেন পাকিস্তানিদের মাধ্যমে তার হৃদয়গ্রাহী বয়ান।

এমন কালজয়ী একাত্তরের দিনলিপি গ্রন্থ নিয়ে অনেক আগ্রহ। যেমন একবার সরদার ফজলুল করিম প্রশ্ন করেছিলেন- একাত্তরের দিনলিপি আপনি কীভাবে তৈরি করেছেন? সব ঘটনা বিস্তারিত এসেছে। এত বিস্তারিত কি আপনি নোট রাখতে পেরেছিলেন, নাকি স্মৃতি থেকে এইটা বিস্তারিত করেছেন?

তখন জাহানারা ইমাম বলেন, “ন্যাশনাল আর্কাইভে গিয়ে একাত্তরের কিছু কাগজটাগজ দেখেছি, কবে কোথায় কী মিটিং হতো, প্রতিবাদের মিটিং হতো—এসব। আমার ডায়েরিতে হয়তো লেখা থাকত, আজকে পাঁচটায় বাংলা একাডেমিতে মিটিং, যাব ওখানে। পরে কোন মিটিংটা কী প্রসঙ্গে হয়েছিল এবং নামটামগুলো আমি কাগজ দেখে ঠিক করে নিয়েছি। তারপরও ধরুন, ছেলেদের যে অ্যাকশনগুলো হতো, শাহাদাত চৌধুরী আর আলম ঠিক কোন তারিখে ঢাকায় এসেছিল, এসে যে তারা আমার কাছ থেকে ওই ব্রিজের ডিজাইন নিয়ে গেল—মানে আমার স্বামীর কাছ থেকে জোগাড় করে দিলাম—নাসিরউদ্দীন ইউসুফ বাচ্চু ও রাইসুল ইসলাম আসাদ। আমি ঘটনাগুলো প্রথমে লিখেছি। তারপর ওদের ডেকে বলেছি, ঘটনাগুলো তোমরা শুনে আমাকে বলো। তা ছাড়া ওদের ডেকে আমি ক্যাসেটে বলেছি, তোমাদের ঘটনাগুলো আগে আমাকে বলো। আবার আমি বলেছি, যাতে আমার স্মৃতিবিভ্রম হয়ে না যায়।

তারপর ‘বিচিত্রা’র সম্পাদক শাহাদাত চৌধুরী আমাকে খুব হেল্প করেছে। ও তো ওদের সঙ্গে ছিল সব সময়। কখন কোন ঘটনা ঘটল, জানে। এ রকম একটা ঘটনা হলো যে দেখা যাচ্ছে, আলম বলছে আমরা পাঁচজন ছিলাম, সেলিম বলছে যে আমি সেই ওয়েতে ছিলাম। এখন সেলিমের কথা আলমের মনে নেই, কিন্তু কাজীর মনে আছে। কাজী বলল, হ্যাঁ, সেলিম ছিল। তখন শাহাদাত আলমকে আলাদাভাবে জিজ্ঞেস করল। তখন আলম বলছে, হ্যাঁ, বোধ হয় গাড়িতে ছয় জনই ছিল। সামনে তিন জন বসায় গিয়ার দিতে গেলে একজনের হাঁটুতে হাত ঠেকে যাচ্ছিল। এভাবে শাহাদাত আমাকে এই নয় মাসের প্রতিটি ঘটনার বিবরণ দিয়েছে। আমি লিখেছি, অন্যদের কাছ থেকেও একবার করে শুনে নিয়েছি, যাতে স্মৃতি আমাকে বিভ্রান্ত না করে।”

মহীয়সী এই নারীর আজ ৯২তম জন্মবার্ষিকী। বিনম্র শ্রদ্ধা তার প্রতি।

তথ্য সহায়ক:

১. সুফিয়া কামাল/ একাত্তরের ডায়েরী

২. জাহানারা ইমাম/ একাত্তরের দিনগুলি

৩. আমি বীরাঙ্গনা বলছি/ নীলিমা জাহান

৪. ধ্রুপদী নায়িকাদের কয়েকজন/ সিরাজুল ইসলাম চৌধুরী

৫. জ্ঞানতাপস আবদুর রাজ্জাক স্মারকগ্রন্থ / আনিসুজ্জমান

৬. বাংলাদেশ জাতীয় জাদুঘরের ‘কথ্য ইতিহাস প্রকল্প ’/ সরদার ফজলুল করিম

Comments

The Daily Star  | English

Yunus meets Chinese ambassador to review China visit, outline next steps

Both sides expressed a shared commitment to transforming discussions into actionable projects across a range of sectors

40m ago