আগামী লোকসভা ভোটে মোদিবিরোধী মুখ হয়ে উঠতে পারেন মমতা

পর পর তিনবার কঠিন পরিস্থিতির ভেতর দিয়ে পশ্চিমবঙ্গ বিধানসভায় জিতলেন মমতা। ২০২১ সালে খোদ ভারতের প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদি উঠে পড়ে লেগেছিলেন মমতাকে হারাতে। রেকর্ড সংখ্যক বার ভোটের প্রচারে মোদি পশ্চিমবঙ্গে এসেছেন। মমতাকে তিনি ব্যক্তিগত আক্রমণ করতেও ছাড়েননি।
মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়। ছবি: ফাইল ফটো/ সংগৃহীত

পর পর তিনবার কঠিন পরিস্থিতির ভেতর দিয়ে পশ্চিমবঙ্গ বিধানসভায় জিতলেন মমতা। ২০২১ সালে খোদ ভারতের প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদি উঠে পড়ে লেগেছিলেন মমতাকে হারাতে। রেকর্ড সংখ্যক বার ভোটের প্রচারে মোদি পশ্চিমবঙ্গে এসেছেন। মমতাকে তিনি ব্যক্তিগত আক্রমণ করতেও ছাড়েননি।

এই অবস্থার ভেতর দিয়েও মমতা অভাবনীয় ফল করেছেন। নিজে হারলেও দলকে জেতানোর ক্ষেত্রে মমতার এই ভূমিকা ভারতের জাতীয় রাজনীতির ক্ষেত্রে তাকে একটা বিশেষ জায়গা দিতে চলেছে- এটা এখনই বলতে পারা যায়।

ভারতের জাতীয় রাজনীতির ক্ষেত্রে বিরোধী মুখ হিসেবে এখন গ্রহণযোগ্য কেউ নেই। বিরোধী দল হিসেবে কংগ্রেস ছন্নছাড়া। সোনিয়া গান্ধী যখন কংগ্রেস সভানেত্রী ছিলেন, তখনও তাকে দেশ পরিচালনার জন্যে প্রধান মুখ হিসেবে কংগ্রেস তুলে ধরবার সাহস দেখাতে পারেনি। সোনিয়া জন্মসূত্রে ইতালীয় হওয়ায় এক সময় বিজেপি তাকে জঘন্য ভাষায় ব্যক্তিগত আক্রমণ করেছে। কংগ্রেস ভালোভাবেই জানে, দলের বাইরে দেশের নেত্রী হিসেবে যদি তারা সোনিয়াকে তুলে ধরে সে ক্ষেত্রে রাষ্ট্রীয় স্বয়ংসেবক সঙ্ঘ ও বিজেপি ‘বিদেশিনী’ ইস্যুকে এমনভাবে তুলে ধরবে যে গোটা বিষয়টি কংগ্রেসের কাছে নেতিবাচকই হয়ে উঠবে।

এই কারণেই কংগ্রেস তুলে ধরেছিল রাহুল গান্ধীকে। প্রথমে তাকে কংগ্রেসের সহসভাপতি করা হয়। পরে সভাপতি। কিন্তু, কংগ্রেসের মতো একটি শতাব্দী প্রাচীন দলের সভাপতি হিসেবে রাহুল কোনোই দাগ কাটতে পারেননি। তাকে ঘিরে তার দলেরই লোকেদের অভিযোগ ছিল, রাহুল দেশে থাকেন না। বছরের অধিকাংশ সময় ছুটি কাটাতে তিনি ভারতের বাইরে থাকেন। পরে অবশ্য রাহুল নির্বাচনে হারের দায় নিয়ে দলীয় সভাপতির পদ থেকে ইস্তফা দিয়েছেন।

বিগত লোকসভা ভোটে (২০১৯) নরেন্দ্র মোদির বিরুদ্ধে বিরোধীদের কোনো মুখ ছিল না, সেটা বিরোধীদের এতো খারাপ ফল হওয়ার অন্যতম কারণ ছিল। বস্তুত বিরোধীদের ভেতরে জ্যোতি বসুর পর আজ পর্যন্ত কোনো সর্বগ্রাহ্য মুখ উঠে আসেনি।

সিপিআই (এম) এর সীতারাম ইয়েচুরি বা প্রকাশ কারাত তাদের দলে জনপ্রিয় হলেও জননেতা হিসেবে সেভাবে পুরো ভারতে প্রতিষ্ঠিত নন।

বুদ্ধদেব ভট্টাচার্য মুখ্যমন্ত্রী থাকাকালে জ্যোতি বাবুর মতো জাতীয় রাজনীতিতে কখনো মনোনিবেশ করেননি। কেরালাতেই এমএস নাম্বুদ্রিপাদের এককালে যে সর্বভারতীয় গ্রহণযোগ্যতা ছিল, সেভাবে পিনরাই বিজয়ন বা ভিএস অচ্যুতানন্দনকে কখনো জাতীয় রাজনীতির অঙ্গনে দেখা যায়নি। একই কথা প্রযোজ্য ত্রিপুরার মানিক সরকারের ক্ষেত্রেও।

পর পর তিন বার মুখ্যমন্ত্রী হওয়াই নয়, খোদ নরেন্দ্র মোদি-অমিত শাহের ব্যক্তিগত প্রচেষ্টা, কেন্দ্রীয় ভূমিকা ঘিরে বিতর্ক— কার্যত সব কিছুকে অতিক্রম করে মমতার এবারের জয়, পশ্চিমবঙ্গের ভৌগোলিক সীমা অতিক্রম করে সর্বভারতীয় স্তরে তাকে নতুন রাজনৈতিক প্রতিষ্ঠা দিতে চলেছে।

পশ্চিমবঙ্গের ভোটের ফল প্রকাশিত হওয়ার পরেই কোভিড পরিস্থিতি নিয়ে ভারত সরকারের কাছে বিরোধীরা দাবিপত্র পেশ করেছেন। সেই দাবিপত্রে কংগ্রেস সভানেত্রী সোনিয়া গান্ধী, প্রাক্তন প্রধানমন্ত্রী এইচডি দেবগৌড়া, সিপিআই (এম) নেতা সীতারাম ইয়েচুরির সঙ্গেই সই করেছেন মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ও।

ভারতের জাতীয় রাজনীতির প্রেক্ষাপট বিবেচনা করে সিপিআই (এম) আর মমতা একই সঙ্গে কেন্দ্রের কাছে দাবিপত্র পেশ করছে— এই ঘটনা ভারতের রাজনীতির ক্ষেত্রে যথেষ্ট ইঙ্গিতবাহী।

পশ্চিমবঙ্গের সিপিআই (এম) সহ অন্যান্য বামপন্থি নেতাদের কাছে মমতাকে ঘিরে যতই নেতিবাচক মানসিকতা থাকুক না কেন তাদের দলের সর্বভারতীয় নেতৃত্ব যে জাতীয় সংকট মোকাবিলায় মমতাকে ব্রাত্য বলে মনে করছেন না, এটি আগামী দিনে মোদিবিরোধী রাজনৈতিক প্রেক্ষাপটকে শক্তিশালী করবার ক্ষেত্রে বিশেষ গুরুত্বপূর্ণ হয়ে উঠতে পারে।

মমতাকে পর্যুদস্ত করতে চেষ্টার ত্রুটি করেনি বিজেপি। মমতা বা তার ঘনিষ্ঠ আত্মীয় অভিষেক বন্দ্যোপাধ্যায়ের বিরুদ্ধে বহু ধরনের দুর্নীতির অভিযোগ উঠেছে। স্বয়ং প্রধানমন্ত্রী ভোট প্রচারে এসে ‘পিসি-ভাইপো’র দুর্নীতি ঘিরে অনেক কথা বলেছেন। তারপরও মমতার দল তৃণমূল কংগ্রেস এইভাবে জিতেছে।

জেতার পর একটা অংশের মানুষের কাছে এই প্রশ্নটা খুব তীব্র হয়ে উঠছে যে, মমতা ও তার ঘনিষ্ঠ আত্মীয়-পরিজন ঘিরে যে আর্থিক দুর্নীতির অভিযোগ আছে, সেই অভিযোগের যথার্থতা কতোখানি?

প্রধানমন্ত্রী মোদি দিল্লি-পশ্চিমবঙ্গের নিত্যযাত্রীতে পরিণত হলেন বিজেপিকে এখানকার ক্ষমতা পাইয়ে দিতে। অথচ মমতার বিরুদ্ধে বা তার আত্মীয়দের বিরুদ্ধে দুর্নীতির প্রশ্নে তদন্ত একচুলও অগ্রসর হলো না। সিবিআই আগে যেটুকু তর্জন-গর্জন করত, এবারের ভোটের আগে সেটুকুও করল না। তাহলে কি মমতা বা ঘনিষ্ঠদের বিরুদ্ধে দুর্নীতির অভিযোগ ঘিরে প্রয়োজনীয় তথ্য, সাক্ষ্য, প্রমাণ— কিছুই কেন্দ্রীয় গোয়েন্দা সংস্থার হাতে নেই?

প্রধানমন্ত্রী কি নিছক ভোটে জেতার জন্যে মমতাকে এভাবে আক্রমণ করলেন?

এই প্রশ্নগুলো যেমন পশ্চিমবঙ্গের রাজনীতিতে ওঠে আসছে, তেমনিই প্রধানমন্ত্রীর ব্যক্তিগত আক্রমণকে অতিক্রম করে মমতার এই জয় জাতীয় রাজনীতির ক্ষেত্রে তাকে অনেক বেশি গুরুত্বের জায়গায় উপস্থাপিত করছে।

বামপন্থিরা পশ্চিমবঙ্গের রাজনীতির পরিপ্রেক্ষিতে মমতার প্রশ্নে আক্রমণাত্মক হলেও, জাতীয় রাজনীতির প্রশ্নে, আরএসএস-বিজেপি, মোদি-শাহ জুটিকে মোকাবিলা করবার প্রশ্নে মমতার গুরুত্বকে তাদের দলের কেন্দ্রীয় নেতৃত্ব উপেক্ষা করতে পারছে না।

তাই বিরোধীদের দাবিপত্রে সোনিয়া, দেবগৌড়ার সঙ্গে মমতার নাম ঘিরে সিপিআই (এম) এর সাধারণ সম্পাদক সীতারাম ইয়েচুরি কোনো আপত্তি তোলেননি।

আগামী ২০২৪ সালে লোকসভার পরবর্তী ভোট। ভোটে মোদিকে পর্যুদস্ত করবার সম্ভাবনা একটা সময় প্রায় ছিলই না। কিন্তু পশ্চিমবঙ্গ, তামিলনাডুর বিধানসভার সাম্প্রতিক ভোটের পর মোদিকে রাজনৈতিকভাবে পর্যুদস্ত করার সেই সম্ভাবনা ক্রমেই স্পষ্ট হতে শুরু করেছে।

তামিলনাডুতে ডিএমকে জয়ী হয়েছে। সেখানে ডিএমকের সহযোগী ছিল সিপিআই (এম)। প্রয়াত এম করুণানিধির ছেলে স্টালিন সেখানকার মুখ্যমন্ত্রী হতে চলেছেন। স্টালিনের দল ডিএমকে রাজনীতির ক্ষেত্রে একটা সময়ে যথেষ্ট ভূমিকা রাখলেও মুখ্যমন্ত্রী হিসেবে এবারেই প্রথম।

অপরদিকে, দিল্লির আম আদমি পার্টির অরবিন্দ কেজরিওয়াল গত বছরের শেষের দিকে বিজেপির অনেক আক্রমণ প্রতিরোধ করে জিতলেও রাজনীতির অঙ্গনে মমতার চেয়ে অনেকটাই নবীন। তাই মোদির প্রতিপক্ষ মুখ হিসেবে মমতারই এখন জনপ্রিয়তার নিরিখে অনেকখানি এগিয়ে থাকার সম্ভাবনা।

মমতার সঙ্গে কংগ্রেস সভানেত্রী সোনিয়ার যথেষ্ট সুসম্পর্ক আছে। পশ্চিমবঙ্গের রাজ্য নেতৃত্বে মমতা সম্পর্কে সংরক্ষণ থাকলেও সিপিআই (এম) এর সর্বভারতীয় নেতাদের কাছে মোদিকে মোকাবিলার প্রশ্নটি তাদের রাজনৈতিক লড়াইয়ের প্রশ্নে অনেক বেশি গুরুত্বপূর্ণ।

কংগ্রেস, সিপিআই (এম), সমাজবাদী পার্টি, বহুজন সমাজ পার্টি, রাষ্ট্রীয় জনতা দল, তৃণমূল কংগ্রেসসহ ভারতের সব অবিজেপি রাজনৈতিক দলের কাছেই নরেন্দ্র মোদি ও মোদিকে মোকাবিলা করার বিষয়টি নিজেদের অস্তিত্ব রক্ষার প্রশ্নের সঙ্গে জড়িত।

বিজেপি যেভাবে রাজনৈতিক আগ্রাসন চালাচ্ছে তাতে তাদের মোকাবিলা করবার প্রশ্নে আসমুদ্র হিমাচলে গ্রহণযোগ্য একটি মুখ দরকার।

মমতাকে ঘিরে বঙ্গ সিপিআই (এম) এর যতই নেতিবাচক দৃষ্টিভঙ্গি থাকুক না কেন এবারের ভোটে মোদিকে সব রকমভাবে মোকাবিলা করে মমতা যে জনপ্রিয়তা অর্জন করেছেন, তার ভিত্তিতে সর্বভারতীয় স্তরে মমতার যে গ্রহণযোগ্যতা তৈরি হচ্ছে, তাকে উপেক্ষা করা এই মুহূর্তে খুবই কঠিন।

ভোটের ফল ঘোষণার পর মুহূর্তেই মমতা বলেছেন, পশ্চিমবঙ্গের মানুষকে বিনামূল্যে করোনা ভ্যাকসিনের ব্যবস্থা যদি কেন্দ্রীয় সরকার না করে, তাহলে তিনি জোরদার আন্দোলন শুরু করবেন।

শাসন ক্ষমতায় বসেও মমতা নিজের লড়াকু-আন্দোলনমুখী পরিচয় বজায় রেখেছেন। এই আন্দোলনমুখী দিকটিকে বামপন্থিরা যতই নাটুকেপনা বলুন না কেন, গরিব মানুষের ভিতরে মমতার এই অভিব্যক্তি যথেষ্ট জনপ্রিয়তা অর্জন করেছে।

সর্বভারতীয় ক্ষেত্রেও একই সঙ্গে রাজ্যে সরকার পরিচালনা ও কেন্দ্রে বিজেপি সরকারের আলঙ্কারিক বিরোধিতা, আন্দোলনের কথা বলা— এটাকেই মোদিবিরোধী প্রধান মুখ হিসেবে মমতার ওঠে আসার কারণ।

মমতার এই আচরণকেই একধরনের বামপন্থি মানসিকতা হিসেবে একাংশের মানুষ খুঁজে পান। এক সময়ে জ্যোতি বসু, ড. অশোক মিত্রেরা কেন্দ্রীয় সরকারের নানা আর্থিক বঞ্চনা নিয়ে দৃঢ় অবস্থান নিতেন। সেই অবস্থানই ক্রমে জ্যোতি বসুকে কংগ্রেসবিরোধী মুখ হিসেবে সর্বভারতীয় স্তরে তুলে ধরে। সেই কার্যক্রমের আভাস এখন মমতাকে ঘিরে ক্রমশ স্পষ্ট হচ্ছে।

বামপন্থিরা মমতার এই বামপন্থাকে ‘ভেক’ বলে অভিহিত করলেও ক্রমেই ভারতীয় রাজনীতিতে মোদিবিরোধী প্রধান মুখ হয়ে উঠছেন মমতা।

আরও পড়ুন:

পশ্চিমবঙ্গে আবারও মমতা

বিজেপিতে যোগ দেওয়া নেতারা তৃণমূলে ফিরছেন?

ইতিহাস সৃষ্টি করেও নন্দীগ্রামে মমতা পরাজিত

খেলা হবে, দেখা হবে, জেতা হবে: মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়

আমার পায়ে আঘাত করেছে, কিন্তু আমার কণ্ঠস্বর রুখতে পারবে না: মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়

বিজেপি অন্য রাজ্যের ‘নেতা ও ক্যাডার’ এনে পশ্চিমবঙ্গে করোনা ছড়াচ্ছে: মমতা

দুর্ঘটনায় পা মচকেছে মমতার: ভারতের নির্বাচন কমিশন

Comments

The Daily Star  | English

DMCH doctors threaten strike after assault on colleague

A doctor at Dhaka Medical College Hospital (DMCH) was allegedly assaulted yesterday after the death of a private university student there, with some of his peers accusing the physicians of neglecting their duty in his treatment

6h ago