ঈদে কর্ম এলাকা ছাড়ায় নিষেধাজ্ঞা কার্যকর করা কঠিন
দেশে করোনার বিস্তার রোধে ঈদকে সামনে রেখে বেশকিছু বিধি-নিষেধ আরোপ করেছে সরকার। ঈদের ছুটিতে ঘরমুখো মানুষের ভিড়ে যেনো সংক্রমণ না বাড়ে সেজন্য সবার কর্ম এলাকা ত্যাগে নিষেধাজ্ঞা দেওয়া হয়েছে। কিন্তু এসব বিধি-নিষেধ ঠিক কিভাবে বাস্তবায়ন করা হবে, তার স্পষ্ট কোনো রূপরেখা নেই।
যেমন--সরকারি কর্মকর্তা-কর্মচারীদের ওপর জনপ্রশাসন মন্ত্রণালয়ের পূর্ণ নিয়ন্ত্রণ আছে। কিন্তু বেসরকারি ও স্বায়ত্তশাসিত প্রতিষ্ঠানগুলোর কর্মীদের ওপর তাদের নিয়ন্ত্রণ নেই। ফলে এসব প্রতিষ্ঠানের বিপুল সংখ্যক কর্মী স্বজনদের সঙ্গে ঈদ উদযাপন করতে পরিবারের সদস্যদের নিয়ে রাজধানী ছেড়ে যাবেন বলে শঙ্কা আছে।
বেশ কিছু কারণেই এ আশঙ্কা তৈরি হয়েছে। সরকারি প্রজ্ঞাপনে বলা হয়েছে, বাস, মিনিবাসসহ সব গণপরিবহন শুধুমাত্র জেলার ভেতর চলাচল করতে পারবে। কিন্তু, এসব যানবাহনের বেশিরভাগই সাধারণত কোনও জেলার সীমানার ওপর ভিত্তি করে চলে না। ফলে এ নির্দেশনা বাস্তবায়ন করা কঠিন।
মানুষ চাইলে এসব যানবাহনে করে জেলার সীমানার বাইরে গিয়ে সেখান থেকে আরেকটিতে করে যানবাহনে করে নিজেদের গ্রামের বাড়িতে পৌঁছাতে পারবে।
এ ছাড়া, অসংখ্য মাইক্রোবাস ও প্রাইভেটকার ঢাকা থেকে ভাড়ায় যাত্রী-আনা নেওয়া করছে। যাত্রীদের কাছ থেকে বাস ভাড়ার প্রায় দ্বিগুণ টাকা আদায় করছে এগুলো। ঈদের সময় এগুলোর সংখ্যা আরও বাড়বে বলে ধারণা করা হচ্ছে। ফেরি ঘাটগুলোতেও প্রতিদিন মানুষের ভিড় বেড়ে যাচ্ছে।
এ পরিস্থিতিতে সংশ্লিষ্ট কর্মকর্তারা আশঙ্কা করছেন, সরকার হয়তো ঈদে মানুষের বাড়ি ফেরা ঠেকাতে সক্ষম হবে না এবং এতে শেষ পর্যন্ত করোনা সংক্রমণ বাড়বে।
গণপরিবহন ও মানুষের চলাচলের ওপর বিধিনিষেধের মেয়াদ ১৬ মে পর্যন্ত বাড়িয়ে ছয়টি নির্দেশনাসহ গতকাল বুধবার প্রজ্ঞাপন জারি করে মন্ত্রিপরিষদ বিভাগ। করোনার দ্বিতীয় ঢেউয়ে ঊর্ধমুখী সংক্রমণ ও মৃত্যু কমিয়ে আনার লক্ষ্যে গত ৫ এপ্রিল থেকে সরকার এ ধরনের বিধিনিষেধ কার্যকর করতে শুরু করে।
গত এক মাসে অবশ্য অনেক বিধিনিষেধের বিষয়ে কড়াকড়ি করছে না সরকার। যেমন, ঈদ উপলক্ষে দেশের শপিং মলগুলোও খুলে দেওয়া হয়েছে। স্বাস্থ্যবিধির তোয়াক্কা না করে প্রতিদিন হাজার হাজার ক্রেতা এসব শপিংমলে ভিড় জমাচ্ছেন।
এ ঘটনায় স্বাস্থ্য বিশেষজ্ঞরা উদ্বেগ প্রকাশ করেছেন।
বিশেষজ্ঞরা বলছেন, ঈদকে কেন্দ্র করে বেড়ে যাওয়া ভিড়ের কারণে দেশে করোনা পরিস্থিতির অবনতি ঘটতে পারে। দেশে কোনোভাবে ভারতীয় ভ্যারিয়েন্ট ছড়িয়ে গেলে, পরিস্থিতি ভয়াবহ হয়ে উঠতে পারে।
এক সপ্তাহের মধ্যেই ঈদ। যাত্রী কল্যাণ সংগঠনগুলোর হিসাব অনুযায়ী, প্রতি বছর ঈদের সময় প্রায় ৮০ লাখ থেকে এক কোটি ২০ লাখ মানুষ ঢাকা, নারায়ণগঞ্জ ও গাজীপুর ছেড়ে যায়।
এ বছর সরকারি বিধিনিষেধ অমান্য করে ইতোমধ্যে অসংখ্য মানুষ শহরগুলো ছেড়ে যাচ্ছে। গত বছরের দুই ঈদেও হাজার হাজার মানুষ শহর ছেড়ে যায়। বিশেষজ্ঞদের মতে, এ কারণেই তখন করোনা পরিস্থিতির অবনতি ঘটেছিল।
‘কর্মস্থল ত্যাগ করবেন না’
নতুন প্রজ্ঞাপনে বলা হয়েছে, সরকারি-বেসরকারি ও স্বায়ত্তশাসিত অফিস, ব্যাংক ও অন্যান্য আর্থিক প্রতিষ্ঠানের কর্মকর্তা ও অন্য কর্মীরা ঈদের ছুটিতে নিজ নিজ কর্মস্থলের এলাকা ত্যাগ করতে পারবেন না।
এ নির্দেশ কার্যকর করতে প্রজ্ঞাপনের কপি পুলিশের মহাপরিদর্শক (আইজিপি), সব বিভাগীয় কমিশনার, উপকমিশনার ও উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তাদের কাছে পাঠানো হয়েছে।
এ ব্যাপারে যোগযোগ করা হলে জনপ্রশাসন মন্ত্রণালয়ের জ্যেষ্ঠ সচিব শেখ ইউসুফ হারুন গতকাল বুধবার দ্য ডেইলি স্টারকে বলেন, ‘সব সরকারি চাকরিজীবী সরকারি আদেশ মানতে বাধ্য। কর্মস্থল ছাড়তে হলে প্রত্যেক সরকারি কর্মীকে আগে থেকে অনুমতি নিতে হবে। কেউ অনুমতি ছাড়া কর্মস্থল ছাড়লে চাকরির নিয়ম অনুযায়ী তার বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেওয়া হবে।’
বেসরকারি ও স্বায়ত্তশাসিত প্রতিষ্ঠানের কর্মীদের ব্যাপারে জিজ্ঞেস করা হলে তিনি বলেন, ‘আমি শুধু সরকারি চাকরিজীবীদের ব্যাপারেই বলতে পারি।’
পুলিশ সদর দপ্তরের উপমহাপরিদর্শক হায়দার আলি খানের সঙ্গে যোগাযোগ করা হলে তিনি বলেন, ‘সরকারি সিদ্ধান্ত বাস্তবায়নে আমরা কাজ করব।’
তবে, পুলিশ সদর দপ্তরের আরেক ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তা জানান, সরকারি নির্দেশনা মানা হচ্ছে কিনা, তা নিশ্চিত করার দায়িত্ব সংশ্লিষ্ট অফিস কর্তৃপক্ষের।
নাম প্রকাশ না করার শর্তে তিনি বলেন, ‘এ ব্যাপারে পুলিশের ভূমিকার ব্যাপারে কিছুই স্পষ্ট না।’
বাড়ছে ভিড়
চলমান লকডাউনের মধ্যেই প্রতিদিনই গাড়ি, মাইক্রোবাস ও ছোটখাটো যানবাহনে করে হাজার হাজার মানুষ বাড়তি টাকা খরচ করে ঢাকা ছাড়ছেন। শিমুলিয়া-কাঁঠালবাড়ি ও পাটুরিয়া-দৌলতদিয়া রুটের ফেরিগুলোকে যাত্রিদের চাপ সামলাতে বেগ পেতে হচ্ছে। সামনের সপ্তাহে এ ভিড় আরও বাড়ার সম্ভাবনা আছে।
নাম প্রকাশ না করার শর্তে বাংলাদেশ অভ্যন্তরীণ নৌ-পরিবহন করপোরেশনের (বিআইডব্লিউটিসি) মাওয়া ফেরিঘাটের এক কর্মী জানান, পদ্মা পার হতে আসা গাড়ি ও মাইক্রোবাসের সংখ্যা বেড়ে যাওয়ায় গত কয়েকদিন ধরে তারা প্রতিদিন ১২ থেকে ১৩টি ফেরি পরিচালনা করছেন।
তিনি বলেন, ‘আমরা কোনো ব্যক্তিগত যানবাহন আটকাচ্ছি না। সেগুলোকে আটকাতে পুলিশকেও গত কয়েকদিনে কোনও ব্যবস্থা নিতে দেখিনি।’
আরিচায় বিআইডব্লিউটিসির উপমহাব্যবস্থাপক জিল্লুর রহমান জানান, প্রয়োজন হলে তারা দিনে চার থেকে পাঁচটি ছোট ফেরি ও দুই থেকে তিনটি বড় ফেরি চালান। রাতে চলে ১৪ থেকে ১৬টি ফেরি।
এক প্রশ্নের জবাবে তিনি বলেন, ‘আমাদের আসলে অ্যাম্বুলেন্স, মালবাহী ও জরুরি পরিবহন পারাপার করার কথা। কিন্তু ঘাটে প্রতিদিন প্রচুর গাড়ি ও মাইক্রোবাস আসছে। এগুলো কীভাবে ফেরত পাঠাই?’
নৌ পরিবহন মন্ত্রণালয়ের এক শীর্ষ কর্মকর্তা জানান, ‘বাস্তবতা’ বিবেচনা করে গাড়ি, মাইক্রোবাস ও অন্যান্য ছোটো যানবাহনের যাত্রীদের ফেরির মাধ্যমে নদী পার হতে দেওয়া হচ্ছে। কারণ ফেরি না চললে লোকজন মরিয়া হয়ে ট্রলার ও স্পিডবোটে করে নদী পার হওয়ার চেষ্টা করবে। এতে গত সোমবারের মতো দুর্ঘটনা আরও হতে পারে।
সেদিন মাদারীপুরের শিবচর উপজেলায় পদ্মা নদীতে একটি বালুবাহী বাল্কহেডের সঙ্গে ধাক্কা লেগে ৩০ যাত্রীসহ একটি স্পিডবোট উল্টে যায়। এ ঘটনায় ২৬ জন নিহত হন।
তবে নৌ-পরিবহন মন্ত্রী খালিদ মাহমুদ চৌধুরী বলেন যে তারা খুব সীমিত পরিসরে ফেরি সার্ভিস চালু রাখবেন এবং এসব ফেরির মাধ্যমে শুধুমাত্র মালবাহী ও জরুরি পরিবহন পারাপার করা হবে।
জেলার ভেতরে গণপরিবহন
গতকালের প্রজ্ঞাপন অনুযায়ী, সব আন্ত:জেলা গণপরিবহন বন্ধ থাকবে। তবে জেলার সীমানার ভেতর এসব পরিবহন চলবে। ট্রেন ও লঞ্চ সেবাও বন্ধ থাকবে এ সময়।
বাংলাদেশ সড়ক পরিবহন মালিক সমিতির মহাসচিব খন্দকার এনায়েত উল্লাহ জানান, তারা সরকারি নির্দেশনা মেনে জেলার ভেতরেই বাস চলাচল সীমাবদ্ধ রাখবেন।
তবে সমিতির আরেক নেতা বলেন, ঈদকে সামনে রেখে গণপরিবহন চালাতে পারবেন কিনা তা নিয়ে তারা দ্বিধায় ছিলেন। প্রথম সারির দূরপাল্লার বাস সার্ভিসের মালিকরা এখন তাদের কার্যক্রম চালু করবেন না। তবে ছোটখাটো বাস সার্ভিসের মালিকরা কার্যক্রম চালু করতে পারেন। এমনকি আন্ত:জেলা পর্যায়েও সেগুলো চলতে পারে।
নাম প্রকাশ না করার শর্তে তিনি বলেন, ‘কোনো একটি নির্দিষ্ট জেলার ভেতর বাসের চলাচল সীমিত রাখা নিশ্চিত করার বিষয়টি কঠিন হবে। অনেক বাসই জেলার সীমানা পার হয়ে অন্য জেলায় ঢুকে যেতে পারে এবং নিজেদের সেই জেলার বাস হিসেবে দাবি করতে পারে।’
লঞ্চ চালুর দাবি
দেশের সব নৌ রুটে আনতিবিলম্বে লঞ্চ সেবা চালু করার দাবিতে গতকাল ঢাকায় নৌ-পরিবহন কর্মীরা বিক্ষোভ করেছেন। স্বাস্থ্যবিধি মেনে লঞ্চ চালুর দাবির পাশাপাশি আগামীকালের মধ্যে বেতন-ভাতা পরিশোধেরও দাবি জানান তারা।
বাংলাদেশ নৌযান শ্রমিক ফেডারেশন আয়োজিত এ বিক্ষোভ মিছিল ফেডারেশনের কেন্দ্রীয় অফিসের সামনে থেকে শুরু হয়। পরে এটি বিআইডব্লিউটিএ সদর দপ্তরের দিকে যায়।
বিক্ষোভ কর্মসূচিতে ফেডারেশনের নেতারা বলেন, ‘লকডাউনের’ ফলে লঞ্চ ও অন্যান্য গণপরিবহনের শ্রমিকরাই সবচেয়ে বেশি ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছেন। কারণ, সরকার তাদের জীবিকার জন্য বিকল্প কোনও ব্যবস্থা নেয়নি। পাশাপাশি, পরিবহন শ্রমিকসহ সাধারণ মানুষ স্বাস্থ্যবিধি অমান্য করে এবং দ্বিগুণ টাকা খরচ করে বাড়ি ফিরছে।
পরে ফেডারেশনের পাঁচ সদস্য বিশিষ্ট একটি প্রতিনিধি দল বিআইডব্লিউটিএ’র চেয়ারম্যান বরাবর স্মারকলিপি পেশ করে বলে সংবাদ বিজ্ঞপ্তিতে জানানো হয়।
(প্রতিবেদনটি ইংরেজি থেকে বাংলায় অনুবাদ করেছেন জারীন তাসনিম)
Comments