১০০-২৫০ টাকা বাড়তি দামে বিক্রি হচ্ছে এলপিজি সিলিন্ডার
নির্ধারিত দামের চেয়ে প্রতি সিলিন্ডার এলপিজি কিনতে ১০০ থেকে ২৫০ টাকা বাড়তি খরচ করতে বাধ্য হচ্ছেন গ্রাহকরা।
বাংলাদেশ এনার্জি রেগুলেটরি কমিশন (বিইআরসি) গত ২৯ এপ্রিল চলতি মাসের জন্য খুচরা পর্যায়ে ১২ কেজির এলপিজি সিলিন্ডারের দাম ৯০৬ টাকা পুনর্নির্ধারণ করে দিয়েছে এবং পরিবেশক ও খুচরা বিক্রেতাদের এই নতুন মূল্য বাস্তবায়নের নির্দেশ দেওয়া হয়েছে।
কিন্তু, কমিশনের এমন সিদ্ধান্তের এক সপ্তাহ পরও এলপিজি সিলিন্ডারের নতুন মূল্য বাস্তবায়িত হয়নি। বিইআরসি’র নির্দেশনা অমান্য করে খুচরা বিক্রেতারা এলপিজি নির্ধারিত মূল্যের চেয়ে কমপক্ষে ১০০ টাকা থেকে ২৫০ টাকা বেশি দাম রাখছেন।
সারা দেশে খুচরা পর্যায়ে একটি ১২ কেজি এলপিজি সিলিন্ডার বিক্রি হচ্ছে ১ হাজার ৫০ টাকা থেকে ১ হাজার ১৫০ টাকার মধ্যে। চলমান মহামারিতে বিপর্যস্ত স্বল্প-আয়ের মানুষ ও মধ্যবিত্তরা এই বাড়তি দামে এলপিজি কিনতে হিমশিম খাচ্ছেন।
ক্ষুদ্ধ ভোক্তাদের অভিযোগ, বিইআরসি শুধু গ্যাসের মূল্য নির্ধারণ করেই দায় সেরেছেন, নতুন দাম বাস্তবায়নে কোনো দৃশ্যমান ব্যবস্থা নিচ্ছে না।
সংস্থাটির নির্ধারণ করে দেওয়া নতুন মূল্য বাস্তবায়নের বিষয়ে ভোক্তারা সংশয় প্রকাশ করেছেন। কেননা, গত এপ্রিলের জন্যে বেঁধে দেওয়া এলপিজির দাম সংস্থাটি বাস্তবায়ন করতে পারেনি।
নজরুল ইসলাম নামের এক ভোক্তা দ্য ডেইলি স্টারকে বলেন, বিইআরসি গত এপ্রিলের জন্য ১২ কেজি এলপিজি সিলিন্ডারের খুচরা মূল্য ৯৭৫ টাকা বেঁধে দিয়েছিল। কিন্তু, পরিবেশক ও খুচরা বিক্রেতারা সে দাম মেনে চলেননি। নির্ধারিত মূল্য বাস্তবায়নে সংস্থাটির ব্যর্থতাকেই দায়ী করছেন ভোক্তারা।
তিনি আরও বলেন, ‘একইভাবে চলতি মাসের জন্যেও কমিশন এলপিজির মূল্য নির্ধারণ করে দিয়েছে। তা গত আট দিনেও বাস্তবায়ন করা যায়নি। এসব দেখে মনে হচ্ছে সংস্থাটি আসলে এর “রুটিন কাজ”-টাই করে যাচ্ছে।’
এই প্রতিবেদক ঢাকা, কুমিল্লা ও জামালপুরসহ দেশের বিভিন্ন জেলায় এক ডজনেরও বেশি এলপিজি ব্যবহারকারীর সঙ্গে এ প্রসঙ্গে কথা বলেছেন।
তাদের সবাই জানিয়েছেন, রান্নার গ্যাস কিনতে সরকার নির্ধারিত দামের চেয়ে তাদের বেশি খরচ করতে হচ্ছে। তারা মনে করেন, নতুন দাম বাস্তবায়নে ব্যর্থতার জন্যে কমিশনই দায়ী।
গত ২৯ এপ্রিল ভার্চুয়াল সংবাদ সম্মেলনে এলপিজির নতুন মূল্য ঘোষণা করতে গিয়ে বিইআরসির সভাপতি আব্দুল জলিল বলেন, তারা বিভিন্ন সূত্র থেকে জানতে পেরেছেন যে খুচরা দোকানে নির্ধারিত দামে গ্যাস বিক্রি হচ্ছে না।
তিনি আরও বলেন, গ্যাসের বেশি দাম রাখা পরিবেশকদের বিরুদ্ধে সুনির্দিষ্ট অভিযোগের ভিত্তিতে ব্যবস্থা নেবে বিইআরসি।
নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক একাধিক খুচরা বিক্রেতা ডেইলি স্টারকে জানিয়েছেন, পরিবেশকরা বেশি দাম রাখায় তারা সরকার নির্ধারিত মূল্যে এলপিজি বিক্রি করতে পারছেন না।
বিইআরসির সদস্য (গ্যাস) মোহাম্মদ মকবুল-ই-এলাহি চৌধুরী বলেছেন, শুধু কমিশনের পক্ষে এককভাবে এলপিজির নির্ধারিত দাম বাস্তবায়ন করা সম্ভব নয়। গণমাধ্যম, ভোক্তা অধিকার সংস্থা, রাজনৈতিক দল ও সরকারি সংস্থাগুলোর পারষ্পরিক সহযোগিতায় এটি করা সম্ভব।
তিনি বলেন, ‘নির্ধারিত নতুন দাম সম্পূর্ণভাবে বাস্তবায়নে সময় লাগবে। আমরা পরিবেশকদের তালিকা সংগ্রহ করছি। আমরা সরকারের কাছ থেকে সহায়তা চেয়েছি। আমরা এই আসন্ন ঈদের ছুটির পর সরকারের কাছে আবারও চিঠি পাঠাব। আমরা একই সঙ্গে প্রত্যেক জেলা প্রশাসকের কাছেও চিঠি পাঠাব।’
কনজ্যুমারস অ্যাসোসিয়েশন অব বাংলাদেশের (ক্যাব) জ্বালানিবিষয়ক উপদেষ্টা অধ্যাপক শামসুল আলম ডেইলি স্টারকে বলেন, মূল্য নির্ধারণের পাশাপাশি যারা নির্দেশনা মানবে না, তাদের বিরুদ্ধেও ব্যবস্থা নেওয়ার ক্ষমতা আছে বিইআরসির।
বিইআরসি আইনের ৪৩ নং ধারা অনুযায়ী সংস্থাটি নির্দেশনা ভঙ্গকারীদের জেল-জরিমানা করতে পারে।
তিনি আরও বলেন, ‘যারা নির্দেশনা মানছে না তাদের বিরুদ্ধে ফৌজদারি মামলা হতে পারে এবং গ্রাহকদের কাছ থেকে অতিরিক্ত অর্থ রাখার দায়ে দুর্নীতির মামলাও হতে পারে। তাই, যারা নির্দেশনা মানছে না তাদের বিরুদ্ধে অবশ্যই আইনি ব্যবস্থা নিতে হবে।’
তিনি বলেন, এলপিজির মূল্য নির্ধারণেল ক্ষেত্রে বিইআরসি নিষ্ক্রিয় ছিল। দীর্ঘদিন তারা এলপিজির মূল্য নির্ধারণ করেনি। এক পর্যায়ে আদালত বিইআরসির বিরুদ্ধে নিষ্ক্রিয়তার অভিযোগটিকে আমলে নিয়ে মূল্য নির্ধারণ করার নির্দেশ দেয়।
অধ্যাপক শামসুল আলম আরও বলেন, ‘তারপরও সংস্থাটি মূল্য নির্ধারণ করেনি। তাদের বিরুদ্ধে আদালত অবমাননার অভিযোগ আনার পর তারা মূল্য নির্ধারণ করা শুরু করে।’
তার মতে, ‘আমরা আগে মূল্য নির্ধারণের ক্ষেত্রে সংস্থাটির সদিচ্ছা ও উদ্যোগের অভাব দেখেছি। নতুন মূল্য বাস্তবায়নের ক্ষেত্রে এটি তাদের আগের উদ্যোগহীনতার প্রতিফলন কি না সে বিষয়ে আমরা সন্দিহান।’
এলপিজি অপারেটর্স অ্যাসোসিয়েশনের সভাপতি আজম জে চৌধুরী ডেইলি স্টারকে বলেন, ‘বিইআরসি আমাদের জন্যে এলপিজির দাম খুব কম করে নির্ধারণ করেছে।’
তিনি বলেন, ‘যেমন ধরুন, পরিবেশক ও পাইকারি বিক্রেতাদের জন্য ৫০ টাকা কমিশন থাকে। কিন্তু, বিইআরসি এটিকে যথাক্রমে ২৫ ও ২০ টাকা নির্ধারণ করে দিয়েছে।’
তার প্রশ্ন, ‘একজন পরিবেশক কীভাবে একটি সিলিন্ডার দেশের যেকোনো স্থানে মাত্র ২৫ টাকা কমিশনে পাঠাতে পারবে?’
তিনি আরও বলেন, ‘যদি সর্বোচ্চ খুচরা মূল্য (এমআরপি) নির্ধারণ করা হয়ে থাকে, তাহলে সবাই সে দামে গ্যাস বিক্রি করতে বাধ্য। কিন্তু, এই এমআরপি কেন টিকছে না? কারণ বিইআরসি নিজেদের ইচ্ছা মতো একটি মূল্য নির্ধারণ করেছে, যা আমাদের কাছে গ্রহণযোগ্য নয়। এ কারণে আমরা একটি দায়িত্বশীল সংগঠন হিসেবে তাদের সঙ্গে একাধিক বৈঠক করে মূল্য পুনর্নির্ধারণ করার চেষ্টা চালিয়েছি।’
তিনি আরও বলেন, ভোক্তারা স্বল্প-মূল্যে এলপিজি পাবেন যদি সরকার পরিবেশবান্ধব এই জ্বালানিতে ভর্তুকি দেয়।
প্রতিবেদনটি ইংরেজি থেকে অনুবাদ করেছেন মোহাম্মদ ইশতিয়াক খান
Comments