হামলা-লুট-আগুনের গ্রাম ব্রাহ্মণবাড়িয়ার নিমবাড়ি

গোষ্ঠীগত দ্বন্দ্বের জের ধরে দুটি হত্যাকাণ্ডের পর ব্রাহ্মণবাড়িয়ার কসবা উপজেলার নিমবাড়ি গ্রাম যেন ‘নরকে’ পরিণত হয়েছে।
গুঁড়িয়ে দেওয়া হয়েছে কয়েকটি আধাপাকা ও পাকা ঘর। ছবি: স্টার

গোষ্ঠীগত দ্বন্দ্বের জের ধরে দুটি হত্যাকাণ্ডের পর ব্রাহ্মণবাড়িয়ার কসবা উপজেলার নিমবাড়ি গ্রাম যেন ‘নরকে’ পরিণত হয়েছে।

গত দুমাসে এ গ্রামে প্রতিপক্ষের হামলায় ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে অন্তত ৩৮ থেকে ৪০টি ঘরবাড়ি। গুঁড়িয়ে দেওয়া হয়েছে কয়েকটি আধাপাকা ও পাকা ঘর। কিছু বাড়িতে অগ্নিসংযোগের পাশাপাশি প্রকাশ্যে চলেছে লুটপাট। প্রতিপক্ষের মামলার ভয়ে পালিয়ে থাকায় সুযোগে দিনের বেলায়ও চালানো হয়েছে তাণ্ডব।

ক্ষতিগ্রস্তদের অভিযোগ, হামলা-লুটপাট থেকে রেহাই পায়নি গ্রামের অনেক নিরীহ পরিবার। ভয়ে গ্রাম ছেড়ে পালিয়ে বেড়াচ্ছে অর্ধশতাধিক পরিবারের কয়েকশ সদস্য।

কসবা উপজেলার মূলগ্রাম ইউনিয়নের এই গ্রামটিতে সরেজমিনে দেখা যায় নৃশংসতার নানা চিহ্ন।

প্রায় পুরুষ শূন্য গ্রামটির অনেক বাসিন্দা ভয়ে মুখ খুলতে চান না।

গ্রামে অবস্থান করা কয়েকজন জানান, ২০১৬ সালের ইউপি নির্বাচনকে কেন্দ্র করে নিমবাড়ি গ্রামের কাবিলা গোষ্ঠীর জমসেদ ভূঁইয়া ও পাণ্ডব গোষ্ঠীর সুদন মিয়ার মধ্যে বিরোধ চলে আসছে। এই বিরোধকে কেন্দ্র করে ২০১৭ সালের ২০ মার্চ সকালে দুই পক্ষের মধ্যে দফায় দফায় সংঘর্ষে ২৫টি বাড়িঘর ভাঙচুর ও লুটপাট করা হয়।

একই ঘটনাকে কেন্দ্র করে ২০১৭ সালের ১০ এপ্রিল দুপক্ষের মধ্যে দফায় দফায় সংঘর্ষে সুদন মিয়ার পক্ষের রহিজ মিয়া নিহত হয় এবং অন্তত ১০ জন আহত হয়।

চার বছর আগে সংঘটিত রহিজ হত্যার জের ধরে দুপক্ষ ফের সংঘর্ষে লিপ্ত হয় চলতি বছরের ১৩ মার্চ। এই সংঘর্ষে রহিজ হত্যা মামলার সাক্ষী তার আপন ভাই ফায়েজ ভূঁইয়া প্রাণ হারান এবং আরও অন্তত ২০ জন আহত হন।

স্থানীয়রা জানান, নতুন করে হত্যাকাণ্ডের পর গ্রাম জুড়ে এখন আতংক বিরাজ করছে। পাণ্ডব গোষ্ঠীর দুজন নিহতের ঘটনায় মামলা হওয়ার পর গ্রেপ্তার এড়াতে প্রতিপক্ষের বাড়িঘর পুরুষ শূন্য হয়ে পড়ে।

এ সুযোগকে কাজে লাগিয়ে একটি পক্ষ গ্রাম জুড়ে ব্যাপক তাণ্ডব ও লুটপাট চালায়। এ সময় কাবিলা গোষ্ঠীর বাড়িঘর ব্যাপক ভাংচুর ও লুটপাটের শিকার হয়। হামলাকারীরা বাড়িঘরের মূল্যবান জিনিসপত্রের পাশাপাশি জমির ফসল, গৃহপালিত পশুপাখিও লুট করে নিয়ে যায়।

সরেজমিন দেখা যায়, প্রতিপক্ষের হামলায় বসতবাড়ির অনেক স্থাপনা গুড়িয়ে দেওয়া হয়েছে। ভাঙচুরের শিকার হওয়া পরিবারের নারী ও শিশুরা এখনও আতঙ্কের মধ্যে রয়েছে। প্রতিপক্ষ যেকোনো সময় আবারও হামলা করতে পারে এমন আশংকায় দিন কাটছে তাদের।

নিমবাড়ি গ্রামের গৃহবধূ নিলা বেগম বলেন, ‘গেরামে পুরুষ লোক নাই। আমরা ডরের (ভয়) মধ্যে আছি। বিরোধী পার্টিরা নারী ও শিশুদেরও ঢর দেহাইতাছে। আমরা অহন (এখন) স্বাভাবিক জীবনডা ফিরা পাইতাম চাই।’

গ্রামের অশীতিপর বৃদ্ধ রউফ মিয়া বলেন, ‘মার্ডারের পর হেরা আমার সাড়ে আট কানি (বিঘা) জমির পাকনা ধান কাইট্টা নিয়া গেছে। আমি জমিত গেলে হেরা আমারে লাঠি দিয়া দৌড়ানি দিছে। আমি ডরে চইলা আইছি।’

আরেক গৃহবধূ জমিলা খাতুন বলেন, ‘নওয়াব মিয়া ও তার ছেলেরা অনেক লোকজন নিয়া আইসা আমরার পাক্কা বিল্ডিংও ভাইঙ্গালাইছে। তারা ঘরের ভিতর থাইক্কা টেহা ও স্বর্ণের জিনিস লুট কইরা নিয়া গেছেগা।’

আশপাশের একাধিক গ্রামের মানুষ জানান, নিমবাড়ি গ্রামে দুপক্ষের বিরোধকে কেন্দ্র করে গ্রামের একাধিক গ্রুপ প্রত্যক্ষ ও পরোক্ষভাবে লুটপাটে জড়িয়ে পড়ে। ফলে ওই গ্রামের মানুষ এখন নিরাপত্তাহীনতায় দিন কাটাচ্ছে। গ্রামের স্বাভাবিক অবস্থা ফিরিয়ে আনার জন্য তারা আইন শৃঙ্খলা বাহিনীর হস্তক্ষেপ কামনা করেছেন।

এ বিষয়ে জানতে চাইলে ব্রাহ্মণবাড়িয়ার অতিরিক্ত পুলিশ সুপার (প্রশাসন ও অপরাধ) মো. রইস উদ্দিন দ্য ডেইলি স্টারকে বলেন, ‘নিমবাড়ি গ্রামে গোষ্ঠীগত দ্বন্দ্বের জেরে খুনের ঘটনায় থানায় মামলা দায়ের করা হয়েছে। এ ঘটনায় কয়েকজনকে গ্রেপ্তার করা হয়েছে। আসামিদের বাড়িতে কিছু লুটপাটের খবর পেয়েছি। তাদেরও আইনের আওতায় আনা হবে।’

Comments

The Daily Star  | English

$8b climate fund rolled out for Bangladesh

In a first in Asia, development partners have come together to announce an $8 billion fund to help Bangladesh mitigate and adapt to the effects of climate change.

8h ago