কোভিড রোগীদের আরেক আতঙ্ক ‘কালো ছত্রাক’

মারাত্মক এই ছত্রাকটি নাক, চোখ, এমনকি মস্তিষ্ককেও আক্রান্ত করতে পারে
ভারতের নয়াদিল্লির একটি হাসপাতালে করোনা রোগীর চিকিৎসা সেবা দিচ্ছেন ডাক্তাররা। ছবি: রয়টার্স

গত শনিবার সকালে ভারতের মুম্বাইয়ের চোখের চিকিৎসক ডা. অক্ষয় নায়ের ২৫ বছরের এক নারীর অস্ত্রোপচারের জন্য অপেক্ষা করছিলেন। ওই নারী তিন সপ্তাহ আগে কোভিড-১৯ থেকে সুস্থ হয়ে উঠেছেন ।

অস্ত্রোপচারের আগ মুহূর্তে একজন নাক-কান-গলা বিশেষজ্ঞকে ডায়াবেটিসে আক্রান্ত ওই রোগীর নাকে নল ঢুকিয়ে মিউকরমাইকোসিসে আক্রান্ত কোষগুলো বের করে আনতে দেখা যায়। এই মিউকরমাইকোসিস একটি বিরল কিন্তু বিপদজনক ছত্রাক। মারাত্মক এই ছত্রাকটি নাক, চোখ, এমনকি মস্তিষ্ককেও আক্রান্ত করতে পারে।

ডা. অক্ষয় নায়ের বিবিসি’র প্রতিবেদককে বলেন, ‘মেয়েটির জীবন বাঁচাতে আমাকে এখন তার চোখ বাদ দিতে হবে। এই রোগে এমন অবস্থাই হয়।’

করোনার দ্বিতীয় ঢেউয়ে এমনিতেই ভারতের বিপর্যস্ত অবস্থা। তার ওপর করোনা থেকে সুস্থ হয়ে যাওয়া বা সুস্থ হওয়ার পথে থাকা রোগীরা ‘কালো ছত্রাক’ নামে পরিচিত এই রোগে আক্রান্ত হচ্ছেন। আক্রান্তের সংখ্যা ক্রমেই বাড়ছে বলে চিকিৎসকরা জানিয়েছেন।

মিউকরমাইকোসিস কী?

মিউকরমাইকোসিস খুবই বিরল একটি সংক্রমণ। মাটি, গাছপালা, সার, পচতে থাকা ফল ও সবজিতে থাকা মিউকর মোল্ডের সংস্পর্শে এলে এ রোগে সংক্রমিত হওয়ার আশঙ্কা থাকে।

এটি সবখানেই পাওয়া যায় জানিয়ে ডা. নায়ের বিবিসিকে বলেন, ‘মাটি, বাতাস, এমনকি সুস্থ মানুষের নাক ও কফেও এটি থাকতে পারে।’

চিকিৎসকরা জানান, সাইনাস, মস্তিষ্ক ও ফুসফুসের ক্ষতি করে এই কালো ছত্রাক। ডায়াবেটিস, এইডস ও ক্যান্সারের মতো জটিল রোগে আক্রান্তদের জন্য প্রাণঘাতি হয়ে ওঠতে পারে এটি। এ রোগে মৃত্যুহার ৫০ শতাংশ। ডাক্তাররা মনে করছেন, গুরুতর অসুস্থ করোনা রোগীদের জীবন বাঁচাতে যে স্টেরয়েড ব্যবহার করা হচ্ছে, সেটিই তাদেরকে মিউকরমাইকোসিসে আক্রান্ত করছে। 

স্টেরয়েড করোনা আক্রান্তদের ফুসফুসের প্রদাহ প্রশমিত করে। শরীরের স্বাভাবিক রোগ প্রতিরোধ ব্যবস্থা যখন করোনাভাইরাসকে ঠেকাতে অনেক বেশি সক্রিয় হয়ে ওঠে, তখন শরীরের কিছু ক্ষতি হয়। সেই ক্ষতি কমাতে সহায়তা করে স্টেরয়েড। কিন্তু একইসঙ্গে এটি মানুষের রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতা কমিয়ে দেয় এবং রক্তে শর্করা বাড়িয়ে দেয়। ডায়াবেটিসে আক্রান্ত বা আক্রান্ত নন- সবার ক্ষেইে এটি ঘটে। আর এ কারণেই রোগীরা মিউকরমাইকোসিসে আক্রান্ত হন বলে চিকিৎসকদের ধারণা।

ডা. নায়ের বলেন, ‘ডায়াবেটিস শরীরের রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতা কমিয়ে দেয়। করোনাভাইরাস বিষয়টি আরও খারাপের দিকে নিয়ে যায়। এরপর করোনা সারাতে যখন স্টেরয়েড দেওয়া হয়, তখন তা আগুনে ঘি ঢালার মতো কাজ করে।’ 

করোনার দ্বিতীয় ঢেউয়ে ভারতের যে কয়টি শহর বিপর্যস্ত হয়ে পড়েছে, তার মধ্যে মুম্বাই একটি। ডা. নায়ের এ শহরের তিনটি হাসপাতালে কাজ করেন।

তিনি জানান, এপ্রিলে তিনি অন্তত ৪০ জনকে এই ছত্রাকে আক্রান্ত হতে দেখেছেন। তাদের মধ্যে অনেকেই ডায়াবেটিসে আক্রান্ত এবং বাড়িতে চিকিৎসা নিয়ে করোনা থেকে সেরে ওঠেছেন। তাদের ১১ জনের চোখ অস্ত্রোপচার করে ফেলে দিতে হয়েছে।

ডা. নায়ের জানান, গত ডিসেম্বর থেকে ফেব্রুয়ারি পর্যন্ত ভারতে এ রোগে আক্রান্তের সংখ্যা অনেক কম ছিল। এ সময়ের মধ্যে মুম্বাই, ব্যাঙ্গালুরু, হায়দারাবাদ, দিল্লি ও পুনেতে তার ছয়জন সহকর্মী মাত্র ৫৮টি ছত্রাক সংক্রমণের ঘটনা জানিয়েছিলেন। তাদের বেশিরভাগই করোনা থেকে সুস্থ হয়ে ওঠার ১২ থেকে ১৫ দিন পর সংক্রমিত হন।

মুম্বাইয়ের সিওন হাসপাতালের নাক-কান-গলা বিভাগের প্রধান ডা. রেনুকা ব্রাদু বিবিসিকে জানান, গত বছর মাত্র ছয় জন তাদের হাসপাতালে ছত্রাকের সংক্রমণ নিয়ে এলেও, গত দুই মাসে এসেছেন ২৪ জন। এই ২৪ জনের মধ্যে ১১ জন একটি করে চোখ হারিয়েছেন। মারা গেছেন ছয় জন। আক্রান্তদের বেশিরভাগই ডায়াবেটিসে আক্রান্ত, মধ্যবয়সী এবং হাসপাতালে আসার দুই সপ্তাহ আগে কোভিড-১৯ থেকে সেরে উঠেছিলেন।

ডা. রেনুকা বলেন, ‘আমরা এখানে সপ্তাহে দুই থেকে তিন জন রোগী পাচ্ছি। মহামারির মধ্যে এটা একটা দুঃস্বপ্নের মতো।’

দক্ষিণাঞ্চলের শহর ব্যাঙ্গালুরুর চিকিৎসক ডা. রঘুরাজ হেগড়েও একই ধরনের তথ্য জানিয়েছেন বিবিসিকে। গত দুই সপ্তাহে ১৯ জন মিউকরমাইকোসিস আক্রান্তের দেখা পেয়েছেন তিনি। তাদের বেশিরভাগই তরুণ। তাদের মধ্যে অনেকে এতোটাই অসুস্থ ছিল যে, ডাক্তাররা তাদের শরীরে অস্ত্রোপচার পর্যন্ত করতে পারছিলেন না।

মিউকরমাইকোসিসের উপসর্গ

নাক বন্ধ হয়ে যাওয়া, নাক থেকে রক্ত পড়া, চোখে ব্যথা ও চোখ ফুলে যাওয়া, চোখের পাতা ঝুলে পড়া, দৃষ্টিশক্তি কমে যাওয়া এবং দৃষ্টিশক্তি হারিয়ে ফেলা কালো ছত্রাকে আক্রান্ত হওয়ার উপসর্গ। এ ছাড়া, নাকের চারপাশে কালো দাগও পড়তে পারে।

চিকিৎসকরা বলছেন, এ রোগে আক্রান্ত বেশিরভাগ রোগীই হাসপাতালে যেতে অনেক দেরি করে ফেলেন। দৃষ্টিশক্তি একেবারেই হারিয়ে ফেলার পর হাসপাতালে যান তারা। ফলে চোখ অপসারণ করা ছাড়া আরও কোনো উপায় থাকে না চিকিৎসকদের। অনেক ক্ষেত্রে রোগীর দুই চোখই আক্রান্ত হয়। বিরল কিছু ক্ষেত্রে ছত্রাকের ছড়িয়ে পড়া রোধ করতে রোগীর চোয়ালের হাড়ও ফেলে দিতে হয় চিকিৎসকদের।

সংক্রমণ রোধের উপায়

মুম্বাইয়ের ডায়াবেটিস চিকিৎসক ডা. রাহুল বকশি বিবিসিকে জানান, এ রোগের সংক্রমণ রোধের একটি উপায় হতে পারে, কোভিড আক্রান্ত ও কোভিড থেকে সেরে ওঠা রোগীদের সঠিক মাত্রায় ও সঠিক সময়ে স্টেরয়েড দেওয়া। গত বছর তিনি ডায়াবেটিস আক্রান্ত ৮০০ করোনা রোগীর চিকিৎসা করেছেন, যাদের একজনও ছত্রাকে সংক্রমিত হননি।

ডা. রাহুল বলেন, ‘ছাড়পত্র দেওয়ার পরও রোগীদের রক্তে শর্করার মাত্রার দিকে খেয়াল রাখা উচিত ডাক্তারদের।’

Comments

The Daily Star  | English

Israel will take all of Gaza: PM

Strikes kill 52 more; WHO chief says 2 million 'starving'

7h ago