অনন্তের পথে অসীমের পথিক কবি সুকান্ত ভট্টাচার্য
মাত্র কুড়ি বছরের জীবনের পরিধি তার। অথচ ছোট্ট এই জীবনে কী দোর্দণ্ড প্রতাপে রাজত্ব করে গেছেন। আমরা কৈশোরের কথা বলি বা তারুণ্যের, প্রথমেই আসে তার নাম। আমরা শক্তির কথা বলি, জাগরণের কথা বলি উঠে আসে মাত্র ২০ বছরের এক কবির কথা। সদ্য কৈশোর পেরিয়ে যৌবনে পা দেওয়া এক তরুণের মাঝে কতোখানি বারুদ থাকতে পারে? অথচ ক্ষুদ্র জীবনে বিপ্লবী আর স্বাধীনতার দাবিতে চির আপোসহীন। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধ, তেতাল্লিশের মন্বন্তর, ফ্যাসিবাদী আগ্রাসন, সাম্প্রদায়িক দাঙ্গা, সম্প্রীতি আর তারুণ্যের জয়গান। কী বাদ গেছে তার কলম থেকে? অথচ মাত্র ৬ বছরের লেখালেখির জীবন তার। অনন্তের পথে অসীমের যাত্রী কবি সুকান্ত ভট্টাচার্য।
সুকান্ত ভট্টাচার্যের জন্ম ১৯২৬ সালের ১৫ আগস্ট কলকাতার কালীঘাটের মহিম হালদার স্ট্রিটে নানার বাড়িতে এক নিম্ন মধ্যবিত্ত পরিবারে। তার বাবা নিবারণ ভট্টাচার্য ছিলেন একটি লাইব্রেরির স্বত্বাধিকারী, যা একাধারে ছিল বইয়ের ক্ষুদ্র প্রকাশনা ও বিক্রয়কেন্দ্র। আর মা সুনীতি দেবী। তাদের পৈত্রিক বাড়ি ছিল ফরিদপুর জেলার গোপালগঞ্জ মহকুমার কোটালীপাড়ার ঊনশিয়া গ্রামে।
সুকান্তের নাম সুকান্ত রেখেছিলেন তার জ্যাঠাতো বোন রাণী ভট্টাচার্য। রাণী ভট্টাচার্য ছিলেন অসম্ভব সাহিত্য পড়ুয়া। তৎকালীন সময়ের জনপ্রিয় সাহিত্যিক মণিন্দ্রলাল বসুর সুকান্ত গল্পটি পড়ার সময় সুকান্ত নামটা নিয়েছিলেন রাণী ভট্টাচার্য। শৈশবে সুকান্তের সবচেয়ে আপনজন ছিলেন এই রাণীদি। একদিন আচমকা রাণী ভট্টাচার্যের মৃত্যু হলো, ভীষণ ভেঙে পড়েছিলেন সুকান্ত। সেই শৈশবেই একইসঙ্গে মাকে হারানো। রাণী ভট্টাচার্যের মাধ্যমেই সাহিত্যে হাতেখড়ি সুকান্তের। রাণী ভট্টাচার্য রাতে ঘুমাতে গিয়ে শোনাতেন নানা গল্প, কবিতা, ছড়া। রাণীদির মৃত্যু আর মাকে হারানোই চঞ্চল সুকান্ত ভট্টাচার্যের জীবনে নিঃসঙ্গতা নিয়ে এলো। সুকান্তের প্রাতিষ্ঠানিক শিক্ষার সূচনা হয় কমলা বিদ্যামন্দিরে ভর্তি হওয়ার মধ্য দিয়ে। সেখানে থাকা অবস্থাতেই সাহিত্যের প্রতি মোহ সৃষ্টি হয় সুকান্তের। মাত্র ৮ কিংবা ৯ বছর বয়সেই বিদ্যালয়ের সাময়িকী "সঞ্চয়" শিরোনামে প্রকাশিত হলো সুকান্তের প্রথম ছোট গল্প। এই গল্পটি ছিল হাস্য রসাত্মক। এরপর তার "বিবেকানন্দ জীবনী" নামের একটি গদ্য ছাপা হয়েছিল "শিখা" পত্রিকায়। এই শিখা পত্রিকাই পরবর্তীতে সুকান্তের বহু লেখা ছাপিয়েছিল।
মাত্র এগারো বছর বয়সে ‘রাখাল ছেলে’ নামে একটি গীতিনাট্য রচনা করেছিলেন সুকান্ত। যেটি পরে তার ‘হরতাল’ গ্রন্থে সংকলিত হয়। বলে রাখা ভালো, পাঠশালাতে পড়বার কালেই ‘ধ্রুব’ নাটিকার নাম ভূমিকাতে অভিনয় করেছিলেন সুকান্ত। কমলা বিদ্যামন্দিরে পঞ্চম শ্রেণি পাশ করার পরে সুকান্তকে ভর্তি করানো হলো বেলেঘাটা উচ্চ বিদ্যালয়ে। বেলেঘাটা উচ্চ বিদ্যালয়ে পড়া অবস্থাতেই সুকান্তের কবিতা ছাপা হতো বিভিন্ন পত্রিকা, সাহিত্য সাময়িকীতে। বেলেঘাটা স্কুলে থাকা অবস্থাতেই সুকান্তের সঙ্গে পরিচয় হলো অরুণাচল বসুর। অরুণাচল বসু নিজে ছিলেন একজন কবি। সপ্তম শ্রেণিতে পড়া অবস্থায় তারা দুজনে মিলে সম্পাদনা করেছিলেন হাতে লেখা পত্রিকা "সপ্তমিকা"। এর পরে অবশ্য তারা "শতাব্দী" নামে আরও একটি মাসিক পত্রিকা সম্পাদনা করেছিলেন। অরুণাচল তার আমৃত্যু বন্ধু ছিলেন।
স্কুলে থাকা অবস্থাতেই এক পর্যায়ে সমাজতন্ত্রের প্রতি ঝুঁকে পড়েন সুকান্ত। আর তার প্রাতিষ্ঠানিক পড়াশোনা চলে যায় গোল্লায়। সমাজতন্ত্রের দিকে ঝুঁকে রুশ বিপ্লব থেকে সমাজতান্ত্রিক নানা সংগ্রামের ঘটনা, বই ডায়েরি পড়তেন তিনি। একই সঙ্গে চলছে তখন তার সাহিত্য পড়া, কবিতা প্রবন্ধ লেখা ছাপা হচ্ছে নানা পত্রিকায়।
১৯৪১ সালে সুকান্ত ভট্টাচার্য কলকাতা রেডিওতে গল্পদাদুর আসরে যোগ দিলেন। সেখানে রবীন্দ্রনাথের কবিতা আবৃত্তি করতেন তিনি। রবীন্দ্রনাথের মৃত্যুর পর সেই আসরেই নিজের লেখা কবিতা পাঠ করে তাকে শ্রদ্ধা জানিয়েছিলেন সুকান্ত ভট্টাচার্য। গল্পদাদুর আসরের জন্য সুকান্ত ভট্টাচার্যের লেখা গান নির্বাচিত হয়েছিল, আর সেই গানে সুর দিয়েছিলেন পঙ্কজ মল্লিক। আনন্দবাজার পত্রিকার সভ্য ছিলেন সুকান্ত ভট্টাচার্য।
১৯৪৪ সালে পুরোপুরি ভারতীয় কমিউনিস্ট পার্টিতে যোগ দিলে পড়াশোনা এক প্রকার লাটে উঠে সুকান্তের। ফলাফল ১৯৪৫ সালের ম্যাট্রিক পরীক্ষায় উত্তীর্ণ হতে পারেননি। এ সময় ছাত্র আন্দোলন ও বামপন্থী রাজনৈতিক কর্মকাণ্ডে যুক্ত হওয়ায় তার আনুষ্ঠানিক শিক্ষার সমাপ্তি ঘটে। দলের একনিষ্ঠ কর্মী হয়ে ওঠেন সুকান্ত। কমিউনিস্ট পার্টির পত্রিকা দৈনিক স্বাধীনতার ‘কিশোর সভা’ বিভাগ সম্পাদনা করতেন সুকান্ত ভট্টাচার্য। মিটিং মিছিল, সভা সমাবেশ থেকে সর্বত্রই সুকান্ত হয়ে উঠেন সর্বত্র কর্মী ও সংগঠক। তাকে ছাড়া পার্টির কাজকর্ম ভাবাই যেত না। বিপ্লবী ও স্বাধীনতার আপোসহীন সংগ্রামী কবি সুকান্ত ছিলেন কমিউনিস্ট পার্টির সার্বক্ষণিক কর্মী। কিন্তু পার্টি ও সংগঠনের কাজে অত্যধিক পরিশ্রমের ফলে নিজের শরীরের উপর যে অত্যাচার তিনি করলেন তাতে তার শরীরে প্রথমে ম্যালেরিয়া ও পরে দুরারোগ্য যক্ষ্মায় আক্রান্ত হলেন তিনি। কিন্তু থামলেন না। সুকান্ত যখন রোগাক্রান্ত হয়ে শয্যাশায়ী তখনো অসুস্থতা তাকে মানসিকভাবে দমাতে পারেনি। তার প্রমাণ অসুস্থ অবস্থায় নিজেদের ঘরের সিঁড়ি দেখে শোষক শ্রেণি আর শোষিতের প্রতীক বানিয়ে লিখলেন "সিঁড়ি"। আর ১৯৪৭ সালের ১৩ মে মাত্র ২১ বছর বয়সে কোলকাতার ১১৯ লাউডট স্ট্রিটের রেড এন্ড কিওর হোমে তো চিরতরে চলেই গেলেন সুকান্ত।
সুকান্ত জীবিত থাকাকালীন তার কোনো গ্রন্থ প্রকাশিত হয়নি। কেবল দৈনিক পত্রিকা, সাহিত্য সাময়িকী, সাপ্তাহিক পত্রিকায় ছাপা হয়েছিল তার লেখা। মাত্র একুশ বছরের জীবনের ব্যাপ্তি, আর এর মধ্যে মাত্র ৬/৭ বছর পড়াশোনার পরিধি। মৃত্যুর পর প্রকাশিত হলো তার ৮টি কাব্যগ্রন্থ।
সুকান্ত ভট্টাচার্য তো কেবল কবিই নন, একাধারে তিনি গীতিকার, গল্পকার, প্রাবন্ধিক, সর্বোপরি একজন বহুপ্রজ সাহিত্যিক।
সুকান্ত ভট্টাচার্যের জীবনের পরিধি হয়তো ক্ষুদ্র, কিন্তু তার সাহিত্যের পরিধি ব্যাপক, সৃষ্টিশীল ক্ষমতা কিংবদন্তিতুল্য। সুকান্তের কবিতা এক রৈখিক নয়, বরং বিষয় বৈচিত্র্যে ও লৈখিক দক্ষতায় অনন্য অসাধারণ। সাধারণ সব বস্তুকেও সুকান্ত কবিতার বিষয় করেছেন। বাড়ির রেলিং ভাঙা সিঁড়ি উঠে এসেছে তার কবিতায়। আসেনি কোনটি? ক্ষুধা, দারিদ্র্য থেকে পুঁজিবাদ, এসেছে তারুণ্য, কৈশোর, মার্ক্সবাদ থেকে বিপ্লব, স্বপ্ন। অধিকার অনাচার সমস্তই। সুকান্তকে তুলনা করা যায় ইংরেজ কবি জন কিটসের সঙ্গে। দুজনের জীবনের পরিধিই ত্রিশের কম। সুকান্তের একুশ, কিটসের পঁচিশ। আবার দুজনের শেষটাও যক্ষ্মায় ভুগে। অবশ্য কিটসের মৃত্যুর চার বছর আগে তার গ্রন্থ প্রকাশিত হতে শুরু করেছিল, আর সুকান্তের মৃত্যুর এক বছর পরে। দুজনের মধ্যে সবচেয়ে মিল হলো দারিদ্রতা। তারা নিজেদের জীবন দিয়ে উপলব্ধি করেছেন। তাইতো সুকান্ত হে মহান কবিতায় ক্ষুধা দারিদ্র্য আর বিপ্লবকে একত্রিত করে লিখেছেন,
"হে মহাজীবন, আর এ কাব্য নয়
এবার কঠিন, কঠোর গদ্যে আনো,
পদ-লালিত্য-ঝঙ্কার মুছে যাক,
গদ্যের কড়া হাতুড়িকে আজ হানো।
প্রয়োজন নেই, কবিতার স্নিগ্ধতা,
কবিতা তোমায় দিলাম আজকে ছুটি
ক্ষুধার রাজ্যে পৃথিবী-গদ্যময়:
পূর্ণিমা-চাঁদ যেন ঝলসানো রুটি।"
সুকান্তের কবিতা নিছকই কেবল কবিতা নয়। যাপিত জীবনের সমস্ত উপাদান দেখা মেলে তার কবিতায়। তেমনি পাওয়া যায় অনন্ত সাহস। সুকান্তের কবিতা দুরন্ত, দুর্দম্য। সমস্ত কিছু জয়ের। শির উঁচু করে নেয়ার। নিজেকে ছাড়িয়ে যাওয়ার। সুকান্তের কবিতায় তারই তো প্রমাণ মেলে। তাইতো আঠারো বছর বয়স কবিতায় লিখেছিলেন সুকান্ত,
"আঠারো বছর বয়স কী দুঃসহ
র্স্পধায় নেয় মাথা তোলবার ঝুঁকি,
আঠারো বছর বয়সেই অহরহ
বিরাট দুঃসাহসেরা দেয় যে উঁকি......
আঠারো বছর বয়সের নেই ভয়
পদাঘাতে চায় ভাঙতে পাথর বাধা,
এ বয়সে কেউ মাথা নোয়াবার নয়—
আঠারো বছর বয়স জানে না কাঁদা।
আঠারো বছর বয়স যে দুর্বার
পথে প্রান্তরে ছোটায় বহু তুফান,
দুর্যোগে হাল ঠিক মতো রাখা ভার
ক্ষত-বিক্ষত হয় সহস্র প্রাণ।"
সুকান্ত বিশ্বাস করতেন এদেশে বিপ্লব হবেই। তাইতো তার কবিতায় দৃঢ় কণ্ঠে উচ্চারিত হতো গণমানুষের কণ্ঠ, জনমানুষের জয়গান। তারুণ্যের শক্তি দিয়ে উন্নত শিরে মানুষের মর্যাদার জন্য মানুষকে প্রস্তুত হওয়ার আহ্বান সুকান্তের কবিতায় লক্ষণীয়। তাইতো সুকান্তের কবিতা আজও উদ্দীপ্ত করে, যোগায় উদ্দীপনা। মহাসাগরের ন্যায় স্রোতে জাগায় জলোচ্ছ্বাসের আভাস। সুকান্তের জীবনটাই তো বলা যায় এক দোর্দণ্ড জলোচ্ছ্বাস।
তাইতো বুদ্ধদেব বসু তার "কালের পুতুল" গ্রন্থে সুকান্তকে নিয়ে লিখেছিলেন,
“গর্কীর মতো, তার চেহারাই যেন চিরাচরিতের বিরুদ্ধে প্রতিবাদ। কানে একটু কম শোনে, কথা বেশি বলে না, দেখামাত্র প্রেমে পড়ার মতো কিছু নয়, কিন্তু হাসিটি মধুর, ঠোঁট দু’টি সরল।”
বুদ্ধদেব বসু আরো বলেছেন, “যে চিলকে সে ব্যঙ্গ করেছিলো, সে জানতো না সে নিজেই সেই চিল; লোভী নয়, দস্যু নয়, গর্বিত নিঃসঙ্গ আকাশচারী, স্খলিত হয়ে পড়লো ফুটপাতের ভীড়ে, আর উড়তে পারলো না, অথবা সময় পেলো না। কবি হবার জন্যই জন্মেছিলো সুকান্ত, কবি হতে পারার আগে তার মৃত্যু হলো”।
আজ বাংলা সাহিত্যের তারুণ্যের মহাপথিক কবি সুকান্ত ভট্টাচার্যের প্রয়াণ দিবস। বিনম্র শ্রদ্ধা জানাই সুকান্ত ভট্টাচার্যের প্রতি।
তথ্যসূত্র:
সুকান্ত বিচিত্রা/ বিশ্বনাথ দে
কালের পুতুল/ বুদ্ধদেব বসু
আহমাদ ইশতিয়াক [email protected]
আরও পড়ুন:
সাদত হাসান মান্টো: এক নির্মম কথাশিল্পী
কিংবদন্তি কথাসাহিত্যিক আলাউদ্দিন আল আজাদ
সাহিত্যে আবুল মনসুর আহমেদ আজও প্রাসঙ্গিক
Comments