১৩ মে ১৯৭১: ডেমরা ও সাতানিখিলে নির্মম গণহত্যা
মুক্তিযুদ্ধের ইতিহাসে ১৩ মে ছিল গুরুত্বপূর্ণ একটি দিন। এদিন পূর্ব পাকিস্তানের সামরিক আইন প্রশাসক টিক্কা খান মুক্তিবাহিনীর প্রধান সেনাপতি কর্নেল এম এ জি ওসমানীর বিরুদ্ধে আনা অভিযোগের জবাব দেওয়ার জন্য সামরিক আদালতে হাজির হওয়ার নির্দেশ দেন। এদিন পাকিস্তানি হানাদারেরা পাবনার ডেমরায় গণহত্যা চালায়। হানাদারদের চালানো এই গণহত্যায় শহীদ হন ৩৫০ জন সনাতন ধর্মাবলম্বী। পাকিস্তানি হানাদারেরা গণহত্যা চালায় মুন্সিগঞ্জের সাতানিখিল গ্রামে।
১৩ মে ঢাকায়
১৩ মে পূর্ব পাকিস্তানের সামরিক আইন প্রশাসক টিক্কা খান মুক্তিবাহিনীর প্রধান সেনাপতি কর্নেল ওসমানীকে পাকিস্তান দণ্ডবিধির ১২১, ১২৩, ১৩১ এবং ১৩২ ধারা এবং ১০ ও ১৪ নম্বর সামরিক বিধির আওতায় তার বিরুদ্ধে আনীত অভিযোগের জবাব দেওয়ার জন্য ২০ মের মধ্যে ১ নম্বর সামরিক আদালতে হাজির হওয়ার নির্দেশ দেন। অন্যথায় তার অনুপস্থিতিতেই বিচার শুরু হবে বলে জানানো হয়।
১৩ মে মুক্তিবাহিনীর সাথে কয়েক দফা সংঘর্ষের পর পাকিস্তানি হানাদার বাহিনী ঢাকা জেলার লৌহজং ও টঙ্গীবাড়ি দখল করে।
দেশব্যাপী গণহত্যা ও প্রতিরোধ যুদ্ধ
ডেমরা গণহত্যা
অপারেশন সার্চ লাইটের অংশ হিসেবে পাকিস্তানি হানাদার বাহিনী যখন ঢাকা থেকে অন্যান্য জেলাগুলোর দিকে ছড়িয়ে পড়ে তখন লোকেরা তাদের বাড়িঘর ছেড়ে পালাতে শুরু করেন। সবার পথ তখন সীমান্তের ওপারে ভারতে শরণার্থী হিসেবে আশ্রয় নেয়া।
পাবনার ফরিদপুর থেকে আগত শরণার্থীদেরও লক্ষ্য ছিল সীমান্তে পৌঁছানো। হাঁটার এক পর্যায়ে তারা ডেমরা ইউনিয়নের বাঁশগাড়ি নামের এক প্রত্যন্ত গ্রামে আশ্রয় নিয়েছিলেন।
স্থানীয় রাজাকারদের সহযোগিতায় এদিন পাকিস্তানি হানাদার বাহিনী বড়াল নদী দিয়ে ওই অঞ্চলে প্রবেশ করেছিল। তারা বাঁশগাড়ি ও রূপসী গ্রাম ঘেরাও করে। মূলত আসাদ নামে এক তরুণ পাকিস্তানি হানাদারদের বাঁশগাড়ি গ্রামে নিয়ে গিয়েছিল। ১৩ মে রাতে হানাদার ও রাজাকারেরা গ্রামের পুরুষদের তাদের বাড়ি থেকে টেনে এনে সারিবদ্ধভাবে লাইনে দাঁড় করায়। রাজাকারদের সহায়তায় পাকিস্তানি হানাদারেরা তাদের সামনেই উম্মুক্ত স্থানে নারীদের ধর্ষণ করে। তারপর নারী, পুরুষ সবাইকে গুলি করে হত্যা করে গান পাউডার দিয়ে বাড়ি জ্বালিয়ে দেয়। হানাদারদের নির্মম গণহত্যায় এদিন শহীদ হন প্রায় ৩৫০ সনাতন ধর্মাবলম্বী মানুষ।
সাতানিখিল গণহত্যা
১৩ মে রাত সাড়ে তিন টায় হানাদারেরা মুন্সিগঞ্জের সদর উপজেলার কেওয়ার চৌধুরীবাড়ি ঘিরে ফিলে। তারপর ওই বাড়ি থেকে চিকিৎসক সুরেন্দ্র চন্দ্র সাহা, তার দুই ছেলে শিক্ষক সুনীল কুমার সাহা ও দ্বিজেন্দ্র লাল সাহা, অধ্যাপক সুরেশ ভট্টাচার্য, শিক্ষক দেব প্রসাদ ভট্টাচার্য, পুলিশের সাব-ইন্সপেক্টর শচীন্দ্র নাথ মুখার্জিসহ ১৭ জন বুদ্ধিজীবীকে ধরে নিয়ে যায়। এরপর ১৪ মে সকাল ১০টায় কেওয়ার সাতানিখিল গ্রামের খালের পাড়ে নিয়ে গিয়ে চোখ বেঁধে ১৬ জনকে ব্রাশফায়ার করে হত্যা করে হানাদারেরা। হানাদার বাহিনী চিকিৎসক সুরেন্দ্র চন্দ্র সাহাকে ধরে নিয়ে যায় হরগঙ্গা কলেজের সেনাক্যাম্পে। তারপর আর তার খোঁজ পাওয়া যায়নি। গুলিবিদ্ধ অবস্থায় ভাগ্যক্রমে বেঁচে যায় জিতু ভৌমিকসহ দুজন। এ গণহত্যার দুদিন পর ১৬ মে পাকিস্তানি হানাদারেরা এসে ১৪টি লাশ পার্শ্ববর্তী ব্রহ্মপুত্র নদীতে ভাসিয়ে দেয়। অবস্থা এমন ছিল যে, লাশগুলো দাহ করার লোকও খুঁজে পাওয়া যায়নি।
দেশব্যাপী প্রতিরোধ যুদ্ধ
১৩ মে সিলেট ব্রাহ্মণবাড়িয়া সড়কের পাশে বাগসাইর গ্রামে তেলিয়াপাড়ার সড়কে লেফটেন্যান্ট মোরশেদের নেতৃত্বে ১২ জন মুক্তিযোদ্ধা নিয়ে হানাদার বাহিনীর একটি সামরিক কনভয়কে অ্যামবুশ করেন। এই অ্যামবুশে হানাদার বাহিনীর সৈন্য ভর্তি একটি জীপ এবং একটি ট্রাক ধ্বংস করা হয়।
১৩ মে কুমিল্লার সিঙ্গারবিল এলাকায় মুক্তিবাহিনীর সদস্যরা পাকিস্তানি হানাদারদের ওপর অতর্কিত অ্যামবুশ করে। এই অ্যামবুশে ৩ হানাদার বাহিনীর সদস্য নিহত হয়।
১৩ মে বরিশালের পূর্ব নবগ্রামে হানাদার বাহিনীর ৪ সদস্য সিদ্ধেশ্বর সরকারের বাড়িতে হঠাৎ হামলা চালায়। এরপর একই গ্রামের বিশ্বাসবাড়ী আক্রমণ করতে অগ্রসর হলে দু’জন মুক্তিযোদ্ধা নিজেদের তৈরি হাতবোমা নিয়ে হানাদারদের ওপর আক্রমণ চালায়। সংঘর্ষে চার জন হানাদারের মধ্যে সবাই নিহত হয়। অন্যদিকে সংঘর্ষে মুক্তিযোদ্ধা অমুল্য মল্লিক শহীদ হন।
১৩ মে মৌলভীবাজারের হিলালপুর গ্রামের লন্ডন প্রবাসী মোহাম্মদ উস্তার ও সিরাজুল ইসলামকে হানাদার বাহিনী রাষ্ট্রদ্রোহী সাব্যস্ত করে। এরপর সারা শহরে মাইকিং করে মনু নদীর ব্রিজের ওপর তাদের দাঁড় করিয়ে পৈশাচিক কায়দায় হানাদারেরা তাদের নির্যাতনের পর হত্যা করে। এরপর তাদের লাশ দুটো মনু নদীতে ভাসিয়ে দেয় তারা।
১৩ মে সিলেট জেলা, সিলেটের বিভিন্ন মহকুমা ও থানায় শান্তি কমিটির শাখা গঠিত হয়। নবগঠিত কমিটির আহ্বায়করা হলেন নাজমুল হোসেন- সিলেট, সাবেক এমপি হাজী এনামউল্লাহ ও মিসির উল্লাহ- মৌলভীবাজার, বদরুদ্দিন আহমদ ও মো. বাতির মিয়া- কুলাউড়া, হাজী আফতাব উদ্দিন আহমদ ও আক্কাস আলী সরকার- বড়লেখা, আবদুল গফুর, হাজী আজমল খান ও আবদুল করিম- রাজনগর, মুন্সী মো.আরিফ- কমলগঞ্জ ও হাজী আবদুল রশিদ- শ্রীমঙ্গল।
তথ্যসূত্র:
বাংলাদেশের স্বাধীনতা যুদ্ধের দলিলপত্র অষ্টম ও নবম খণ্ড।
দৈনিক অমৃতবাজার পত্রিকা ১৪ মে, ১৯৭১
দৈনিক পাকিস্তান, ১৪ মে ১৯৭১
আহমাদ ইশতিয়াক [email protected]
আরও পড়ুন-
১২ মে ১৯৭১: সাতবাড়িয়া গণহত্যা, মুক্তিযুদ্ধের পক্ষে আন্তর্জাতিক তৎপরতাময় দিন
৩ মে ১৯৭১: টাইম ম্যাগাজিনের প্রতিবেদন- ঢাকা এখন মৃত্যুপুরী
১ মে ১৯৭১: ‘বাংলাদেশ এখন একটি চিরন্তন সত্য ও বাস্তবতা’ ভারতীয় শিল্পমন্ত্রী
২৭ এপ্রিল ১৯৭১: কালীগঞ্জে গণহত্যা, ইপিআরের নাম পাল্টে ইপিসিএফ
সহযোদ্ধাদের বাঁচাতে যিনি উৎসর্গ করেছিলেন নিজের প্রাণ
১৯ এপ্রিল ১৯৭১: প্রবাসী বাংলাদেশ সরকারের ১৮ নির্দেশনা
Comments