‘মেহমানখানায়’ অন্যরকম ঈদ

ঈদের দিন শুক্রবার দুপুর দেড়টা। ঢাকার লালমাটিয়ায় ডি ব্লকের একটি রাস্তার দুপাশে সারি সারি রিকশা। চালকের আসন ছেড়ে পেছনে আরাম করে বসে আছেন রিকশাচালকরা। আরেকদল মানুষ বসে আছেন ফুটপাতে। কিছুক্ষণের মধ্যেই তাদের প্রত্যেকের হাতে পৌঁছে গেল খিচুড়ি আর মাংসের প্লেট।
নিম্নআয়ের মানুষকে বিনামূল্যে ঈদের দিনে খাওয়ানোর এই আয়োজন করেছে একদল স্বেচ্ছাসেবক। ছবি: শরিফুল হাসান/স্টার

ঈদের দিন শুক্রবার দুপুর দেড়টা। ঢাকার লালমাটিয়ায় ডি ব্লকের একটি রাস্তার দুপাশে সারি সারি রিকশা। চালকের আসন ছেড়ে পেছনে আরাম করে বসে আছেন রিকশাচালকরা। আরেকদল মানুষ বসে আছেন ফুটপাতে। কিছুক্ষণের মধ্যেই তাদের প্রত্যেকের হাতে পৌঁছে গেল খিচুড়ি আর মাংসের প্লেট।

খুব স্বস্তি নিয়ে খাচ্ছেন তারা। খাওয়ার শেষের দিকে একজন মাইকে জানালেন, ‘সেমাই আছে। সেমাই খেয়ে যাবেন।’

ইট-পাথরের এই শহরে নিম্নআয়ের মানুষকে বিনামূল্যে ঈদের দিনে খাওয়ানোর এই আয়োজন করেছে একদল স্বেচ্ছাসেবক।

শুধু ঈদের দিন নয়, রমজান মাসে প্রতিদিন দেড় থেকে দুই হাজার মানুষ এই মেহমানখানায় ইফতার করেছেন বিনামূল্যে।

সাধারণ মানুষকে খাওয়ানোর এই আয়োজনে ২০ থেকে ২৫ জন স্বেচ্ছাসেবক কাজ করছেন। ছবি: শরিফুল হাসান/স্টার

এই মেহমানখানার মেহমান হচ্ছেন— এতিম, অসহায়, গরিব, রিকশাচালক, দিনমজুর, হকার ও লকডাউনে কর্মহীন হয়ে পড়া নিম্নআয়ের মানুষ। আবার লোকলজ্জার ভয়ে আসতে পারেননি এমন অন্তত ৪০০ জনকে প্রতিদিন বাসায় ইফতার দেওয়া হতো। এই সব সাধারণ মানুষের জন্যই ঈদের দিনেও মেহমানদারির বিশেষ আয়োজন করা হয়েছে।

দুপুরে ঘণ্টা দুয়েক ঘটনাস্থলে থেকে দেখা গেল, স্বেচ্ছাসেবকরা কেউ খাবার দিচ্ছেন প্লেটে, কেউবা দিচ্ছেন সেমাই। কেউ আগতদের বসাচ্ছেন।

আগতদের মধ্যে নারী, পুরুষ, তরুণ, বৃদ্ধ, শিশু সবাই আছেন। আছেন নানা শ্রেণী-পেশার মানুষ। সবাই একসঙ্গে খাচ্ছেন, কোথাও কোনো বিশৃঙ্খলা নেই।

কথা হয় এখানে আসা শতাধিক মানুষের সঙ্গে। ঈদের দিন এমন আয়োজনে তারা সবাই খুব খুশি। তাদেরই একজন রংপুর থেকে আসা রিকশাচালক রাজু মিয়া। দ্য ডেইলি স্টারকে তিনি বলেন, ‘খুব বেশি আয় করতে পারিনি। এবারের ঈদে বাড়িও যেতে পারিনি। মনটা খারাপ ছিল। কিন্তু এই আয়োজনে মনটা ভালো হয়ে গেছে।’

রাজু মিয়ার ঠিক সামনের একটি রিকশায় দেখা গেল একজন পুরুষ, একজন স্ত্রী ও এক শিশু মাংস-খিচুড়ি খাচ্ছেন। রিকশাচালক নিজের নাম জানালেন মাহবুব হোসেন। ঢাকায় তিনি পরিবার নিয়ে থাকেন। রোজার মাসে মাঝে মাঝে এখানে ইফতার করেছেন তিনি। ঈদের দিনে মাংস কিনে খাওয়ার সামর্থ্য নেই বলে, স্ত্রী ও সন্তানকে নিয়ে এসেছে খেতে।

খাওয়া শেষ করে স্ত্রী-কন্যাকে নিজের রিকশায় চড়াবেন মাহবুব। আজ যে ঈদ!

বরিশালের আহমেদ হোসেন বয়সে তরুণ। তিনিও খাচ্ছিলেন। বললেন, ‘ঢাকায় নির্মাণ শ্রমিকের কাজ করি। একজনের কাছ থেকে শুনে এখানে চলে এসেছি। এভাবে যত্ন করে যে ঢাকায় আমাদের মতো মানুষকে যে কেউ খাওয়ায়, এখানে না এলে বিশ্বাস হতো না।’

দুপাশে সারি সারি রিকশা। চালকের আসন ছেড়ে পেছনে আরাম করে বসে খুব স্বস্তি নিয়ে খাচ্ছেন তারা। ছবি: শরিফুল হাসান/স্টার

বড় একটি পাতিল থেকে প্লেটে মাংস ঢালছিলেন ইজাজ আহমেদ। তিনি পেশায় প্রকৌশলী। এই মেহমানখানায় স্বেচ্ছাসেবী হিসেব জড়িয়ে আছেন ইজাজ আহমেদ। দ্য ডেইলি স্টারকে তিনি বলেন, ‘সামাজিক দায়িত্ববোধ থেকেই কাজটা করা। আমার জীবনে যতো আনন্দ আছে তার মধ্যে একটা বড় আনন্দ হচ্ছে মেহমানখানায় মানুষকে খাওয়ানো। আসলে সবকিছুর জন্য রাষ্ট্রের দিকে তাকিয়ে না থেকে আমাদেরও অনেক কিছু করার আছে।’

আয়োজকরা জানালেন, সাধারণ মানুষকে খাওয়ানোর এই আয়োজনে ২০ থেকে ২৫ জন স্বেচ্ছাসেবক কাজ করছেন। এই স্বেচ্ছাসেবকদের সমন্বয়ের কাজটি করছেন সৈয়দ শামসুল আলম।

তিনি জানান, ঈদের দিন প্রায় হাজার দেড়েক মানুষ যেন খেতে পারেন সেজন্য তারা আয়োজন করেছেন। নিজেরা গরু কিনেছেন। রাতে কাটা-ধোয়া থেকে শুরু করে রান্নার সব আয়োজন করা হয়েছে। সকালে মাংস ও খিচুড়ি রান্না শুরু হয়েছে। ১২টার পর থেকে সবাইকে খাওয়ানো হচ্ছে। উদ্দেশ্য, সবাই যেন গরম গরম খেতে পারেন।

হঠাৎ করে সাধারণ মানুষকে ঈদের দিন খাওয়ানোর ভাবনা কী করে আসলো? এই প্রশ্নের উত্তরে স্বেচ্ছাসেবকরা জানান, গত বছর কোভিডের সময় শুরু হয়েছিল এই মেহমানখানা। তখন ১১ জন স্বেচ্ছাসেবক থাকলেও এবার ২০ থেকে ২৫ জন কাজ করছেন।

মূল ভাবনাটা কার মাথা থেকে এসেছিল জানতে চাইলে স্বেচ্ছাসেবকরা বলেন, সবার সম্মিলিত প্রচেষ্টার এই উদ্যোগ।

থিয়েটার কর্মী আসমা আক্তার লিজা, বেসরকারি একটি সংস্থার কর্মী সৈয়দ সাইফুল আলম শোভন, সৈয়দ শামসুল আলম, ইজাজ আহমেদসহ অনেকেই আছেন এই উদ্যোগের শুরু থেকেই। 

ইফতারে প্রতিদিনের খরচের টাকা আত্মীয়-স্বজন, পরিচিত-অপরিচিত নানা মাধ্যম থেকে আসছে। ছবি: শরিফুল হাসান/স্টার

কেন এই মেহমানখানা শুরুর ভাবনা এলো জানতে চাইলে আসমা আক্তার লিজা দ্য ডেইলি স্টারকে বলেন, পরপর নিজের তিনটি নবজাতক মারা যাওয়ার পর তিনি সুবিধাবঞ্চিত ও এতিম শিশুদের জন্য কাজ করে যাচ্ছেন। এতিম ও পথশিশুদের মধ্যে তিনি নিজের সন্তানদের ছায়া দেখতে পান। কিন্তু গত বছর করোনা মহামারি শুরুর পর তার ভাবনা জগতে আলোড়ন তোলে নিম্নআয়ের মানুষরা।

আসমা আক্তার লিজা বলে চলেন, ‘গত বছর করোনা শুরুর সময় সবাইকে বলা হয় ঘরে থাকুন। আমি তখন কুকুরের জন্য খাবার নিয়ে যেতাম। নিতাম কাকেদের জন্য, পাখিদের জন্য। কারণ তারা খাবার সংকটে ছিল। একদিন দেখি ক্ষুধার যন্ত্রণায় কিছু শিশু কাতরাচ্ছে। মার্চের ২১ তারিখ। ওরা বলে, ওদের ক্ষুধা লেগেছে। ওরা কোথায় খাবে? তখন বাসায় এসে রান্না করে নানা জায়গায় দিয়ে আসতাম। প্রথমদিকে একশ-দুইশ মানুষ। আত্মীয়-স্বজনরা এগিয়ে এলো। এরপর রোজা। সবার সহযোগিতায় ইফতার খাওয়ানো হলো মেহমানদের। আত্মীয়-স্বজনের সহায়তায় ওই এলাকার দরিদ্র মানুষের জন্য কাজটা চালিয়ে নেই আমরা। নানা জায়গা থেকে বাকিতেও চাল-ডাল এনেছি। অনেক সময় বিভিন্নজন এসে চাল, চিড়া দিয়ে গেছেন। মানুষ চাইলেই ভালো কাজ করতে পারে।’

গত বছর রমজানের পরও প্রায় চার মাস ধরে প্রতিদিন একবেলা করে হাজারো মানুষের মুখে খাবার তুলে দেন লিজা আপা ও তার দল। পরে আর্থিক সংকটে আয়োজন চালানো সম্ভব না হলেও প্রতি শুক্রবারে ঠিকই মেহমানখানায় রাতের খাবার পেয়েছে ক্ষুধার্ত মানুষ।

এবার লকডাউন শুরু হলে ফের মাঠে নামেন তারা।

আসমা আক্তার লিজা বলেন, ‘মেহমানখানার কাজ করতে এসে আমার বারবার মুক্তিযুদ্ধের কথা মনে হয়। মৃত্যুর ভয় থাকার পরেও যুদ্ধ করেছেন তারা। আমার বাবা একজন মুক্তিযোদ্ধা। আমরা তো একদিন মরে যাব। কিন্তু মরে যাওয়ার আগে একটা প্রশান্তি যেন থাকে, মানুষের জন্য কিছু করেছি। আর আমি চাই, এই দেশে কেউ যেন না খেয়ে না থাকে।’

‘আরেকটা কথা, সবাইকে বলবো নিজেরা ভালো কাজ করেন। নিজের সন্তান ও স্বজনদের ভালো কাজে লাগান। তাহলে সব খারাপ থেকে দূরে থাকবে তরুণেরা,’ যোগ করেন তিনি।

আয়োজকরা জানান, রোজায় প্রতিদিন দেড় হাজারের বেশি মানুষ ইফতার করেছেন মেহমানখানায়। প্রথম দিকে লালমাটিয়ার ওই এলাকার আশেপাশের মানুষ আসতে শুরু করে। ধীরে ধীরে মেহমানের সংখ্যাও বাড়তে থাকে। মেহমানখানায় প্রতিদিনের ইফতারে ছিল শরবত, জিলাপি, খেজুর, পেঁয়াজু, শসা ও মুড়ি। তবে প্রতি শুক্রবারে থাকে গরুর মাংস, খিচুড়ি।

ইফতারে প্রতিদিনের খরচের ৩০ থেকে ৪০ হাজার টাকা কোথা থেকে আসছে? উত্তরে তারা জানান, তাদের আত্মীয়-স্বজন, পরিচিত-অপরিচিত নানা মাধ্যম থেকে। সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে দেখেও মোবাইলে অনেকে টাকা পাঠিয়ে দেন।

তবে তারা খুব বেশি টাকা নেন না। রোজ আয়োজনের জন্য যতটুকু লাগবে ততটুকুই নেন। ঈদের গরু থেকে শুরু করে সবকিছুই এভাবে হয়েছে।

সৈয়দ সাইফুল আলম শোভন বলেন, ‘আমাদের চেনা-অচেনা অসংখ্য মানুষ সহায়তার হাত বাড়িয়ে দিয়েছেন। আমরা এই মানবিক কাজে কোনো করপোরেট ট্যাগ লাগাতে চাইনি। আর স্বেচ্ছাসেবকরা যেভাবে সব কাজ করেছেন সেটা অতুলনীয়। কুষ্টিয়া থেকে একজন শিক্ষক আপা আমাদের সঙ্গে স্বেচ্ছাসেবী হিসেবে কাজ করতে চলে এসেছেন। চট্টগ্রাম থেকে এসেছেন এক শিক্ষার্থী। ঢাকার নানা পেশার একদল তরুণ-যুবক আছেন। সবার সম্মিলিত প্রচেষ্টায় চলছে এই মেহমানখানা। সাধারণ মানুষের জন্য আমাদের এই উদ্যোগ আমরা অব্যাহত রাখতে চাই।’

 

শরিফুল হাসান: ফ্রিল্যান্স সাংবাদিক

Comments

The Daily Star  | English

Rooppur Nuclear Power Plant: First unit to start production in Dec

One of the two units of the Rooppur Nuclear Power Plant will be commissioned this December if transmission lines are ready although the deadline for the project’s completion has been extended to 2027.

6h ago