সম্প্রীতির অতন্দ্র প্রহরী অন্নদাশঙ্কর

বাংলার নবজাগরণের শেষ প্রতিনিধি অন্নদাশঙ্কর রায়ের মনের গহীনে বাংলাদেশ ছিল বিরাট জায়গা জুড়ে। বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান সপরিবারে শাহাদাত বরণের পর গোটা পশ্চিমবঙ্গের রাজনীতি এবং সংস্কৃতি দুনিয়া যখন আশ্চর্য নীরবতা পালন করছে তখন অন্নদাশঙ্করের উদ্যোগেই এই বর্বরোচিত হত্যাকাণ্ডের প্রথম প্রতিবাদ উচ্চারিত হয়েছিল কলকাতাতে।
Annada Sankar Roy
অন্নদাশঙ্কর রায়। ছবি: সংগৃহীত

বাংলার নবজাগরণের শেষ প্রতিনিধি অন্নদাশঙ্কর রায়ের মনের গহীনে বাংলাদেশ ছিল বিরাট জায়গা জুড়ে। বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান সপরিবারে শাহাদাত বরণের পর গোটা পশ্চিমবঙ্গের রাজনীতি এবং সংস্কৃতি দুনিয়া যখন আশ্চর্য নীরবতা পালন করছে তখন অন্নদাশঙ্করের উদ্যোগেই এই বর্বরোচিত হত্যাকাণ্ডের প্রথম প্রতিবাদ উচ্চারিত হয়েছিল কলকাতাতে।

অন্নদাশঙ্করের প্রতিজ্ঞা ছিল বঙ্গবন্ধু হত্যার বিচার না হলে তিনি আর বাংলাদেশে যাবেন না। ১৯৯৬ সালে শেখ হাসিনা প্রথমবার প্রধানমন্ত্রী হওয়ার পর যখন ইনডেমনিটি অধ্যাদেশ বাতিল হয় তখন বাংলাদেশের স্বাধীনতার রজতজয়ন্তী উপলক্ষে অন্নদাশঙ্করকে আমন্ত্রণ জানানোর জন্য প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার কাছে অনুরোধ জানান সুফিয়া কামাল, শামসুর রাহমান, কবীর চৌধুরী। সানন্দে সেই আবেদনে সম্মতি দিয়েছিলেন শেখ হাসিনা।

১৯৯৬ এর ১৪ ডিসেম্বর সকালে বাংলাদেশ বিমানে ঢাকার উদ্দেশে বসেই বিমানের আসনে রাখা বাংলাদেশের খবরের কাগজগুলি তুলে নেন অন্নদাশঙ্কর। শহীদ বুদ্ধিজীবীদের ছবি দেখে মুনীর চৌধুরী আর মোফাজ্জল হায়দার চৌধুরীর স্মৃতিতে স্মৃতিকাতর হয়ে পড়েন অন্নদাশঙ্কর।

সেই সফরে বাংলা একাডেমিতে ছাত্ররা তাকে ধরলো একটি নিজের কবিতা পাঠের জন্যে। নজরুলকে নিয়ে লেখা কবিতা পড়লেন অন্নদাশঙ্কর,

‘ভুল হয়ে গেছে বিলকুল/ আর সব কিছু ভাগ হয়ে গেছে/ ভাগ হয়নি কো নজরুল। সেই ভুলটুকু বেঁচে থাক/ বাঙালি বলতে একজন আছে/ দুর্গতি তার ঘুঁচে যাক।’

কবিতাটি আবৃত্তির পর একটু থেমে একমুখ হাসি ছড়িয়ে অন্নদাশঙ্কর বললেন, ‘আর একজন ভাগ হয়নি, সেইজন আমি।’

বাংলাদেশ, সার্বিকভাবে বাঙালির জন্যে বুকভরা ভালোবাসা নিয়েও বিশ্বমানব হিসেবে যেভাবে নিজেকে মেলে ধরতে পেরেছিলেন অন্নদাশঙ্কর, তার সমসাময়িককালে এপার বাংলায় তা ছিল দুর্লভ। শঙ্খ ঘোষের মতো মানুষ চিরজীবন দুই বাংলার সাংস্কৃতিক ঐক্যে বিশ্বাসী হয়েও বাংলাদেশ, সেখানকার নাগরিকেরা যখন সঙ্কটে পড়েছেন, মহান মুক্তিযুদ্ধের পরবর্তী সময়ে কিন্তু নীরবতাই পালন করে গিয়েছেন। অন্নদাশঙ্করের কাছে যেটা সত্য বলে মনে হয়েছে, ন্যায় বলে তিনি সাব্যস্ত করেছেন, তাতে কে খুশি হবে, কে বিরক্ত হবে— এসব কোনো কিছুর তিনি ধার ধারেননি।

বঙ্গবন্ধু হত্যা, জেল হত্যাকাণ্ড থেকে শুরু করে যুদ্ধাপরাধীদের বিচার- কখনো নিশ্চুপ দর্শক অন্নদাশঙ্কর ছিলেন না। দেশভাগ উত্তরকালে পশ্চিমবঙ্গের গণমাধ্যম যখন সুফিয়া কামালের মতো মানুষকে ভুলে থাকতে চেয়েছে, অন্নদাশঙ্করই এপার বাংলার একমাত্র বুদ্ধিজীবী, যিনি ‘সুফিয়া বোন আমার’ শিরোনামে কলম ধরেছেন। শহীদ জননী জাহানারা ইমাম সম্পর্কে কলকাতার মিডিয়া নিশ্চুপ, সেই নীরবতাকে ভাঙতে বাধ্য করেছিলেন অন্নদাশঙ্কর নিজের লেখা দিয়ে।

১৯৫৩ সালে শান্তিনিকেতনে সাহিত্য মেলা করে এপার বাংলার সাহিত্য জগতের কাছে শামসুর রাহমানকে প্রথম পরিচিত করেন অন্নদাশঙ্কর। আবার জীবন সায়াহ্নে, কলকাতার সাহিত্য পরিমণ্ডলের কাছে আখতারুজ্জামান ইলিয়াসকে তুলে ধরবার মূলেও ছিলেন অন্নদাশঙ্কর। তিনি যেভাবে অখণ্ড বাঙালি জাতিসত্তায় বিশ্বাসী ছিলেন, তেমন আন্তরিক বিশ্বাস এপার বাংলার বুদ্ধিজীবীদের ভেতরে তিনি ছাড়া বিশেষ কাউকে দেখা যায়নি।

বিরানব্বই বছর বয়সে ঢাকায় গিয়েও বোন সুফিয়া কামালকে তার ধানমন্ডির বাড়ি গিয়ে দেখে আসতে তিনি ভোলেননি। আবার কলকাতায় ফিরেই সুফিয়ার কন্যা শিল্পী সাঈদা কামাল টুলুর চিত্র প্রদর্শনীর উদ্বোধন করতে যেতেও ক্লান্তি ছিল না অন্নদাশঙ্করের।

মানবতার সঙ্কট বিশ্বের যে দেশেই দেখা দিক না কেন সরব হয়েছেন অন্নদাশঙ্কর। ভারত-চীন সীমান্ত সমস্যার সময়ে সাগরময় ঘোষকে লেখা  চিঠি, যা ‘যোগভ্রষ্ট’ শিরোনামে প্রকাশিত হয়েছিল, তার জন্যে ভারত সরকার তার পেনশন বন্ধের জোগার করেছিল। বঙ্গবন্ধু হত্যার প্রতিবাদে তার লেখা ‘কাঁদো প্রিয় দেশ’ প্রবন্ধটি ‘দেশ’ পত্রিকাতে প্রকাশ করতে দেয়নি পশ্চিমবঙ্গের তৎকালীন মুখ্যমন্ত্রী সিদ্ধার্থশঙ্কর রায়।

এমনকি, সিদ্ধার্থশঙ্কর জরুরি অবস্থার সুযোগ নিয়ে অন্নদাশঙ্করকে গ্রেপ্তারের ষড়যন্ত্র পর্যন্ত করেছিলেন। দমানো যায়নি অন্নদাশঙ্করকে।

বঙ্গবন্ধু হত্যার প্রতিবাদে লেখা সরকার ছাপতে দিচ্ছে না ‘দেশ’-এ, অন্নদাশঙ্কর আরও কয়েকটি প্রবন্ধ জড়ো করে ওই শিরোনামেই নিজের উদ্যোগে লেখাগুলি বই আকারে প্রকাশ করে দিলেন।

১৯৯৬ সালের জানুয়ারিতে আনন্দবাজারে লিখলেন, ‘অনুপ্রবেশের সমস্যা সব যুগে ও সব দেশেই দেখতে পাওয়া যায়।’ আর যায় কোথায়? তাকে সরানোর ছক কষলো রাষ্ট্রীয় স্বয়ংসেবক সঙ্ঘ, বিজেপি। বুদ্ধদেব ভট্টাচার্য নিজে উদ্যোগী হলেন সুরক্ষা দিতে অন্নদাশঙ্করকে। তিনি রাজি হলেন না। গোয়েন্দা সূত্রে বুদ্ধদেববাবু জেনেছেন হিন্দু সাম্প্রদায়িক শক্তির ফন্দি ফিকির। শেষমেষ অন্নদাশঙ্করের ফ্ল্যাট ‘সুখবতী ভবন’র নিচে পুলিশ পোস্টিং করলেন। অন্নদাশঙ্কর কিন্তু নিজের অবস্থান থেকে একচুলও নড়লেন না।

Comments

The Daily Star  | English

Banks mostly gave loans to their owners rather than creditworthy borrowers

Bangladesh’s banking sector was not well-managed in recent years. Banks mostly gave loans to their owners, rather than to creditworthy entities. Consequently, several banks are now in difficulty.

10h ago