ভারত ও মিয়ানমারের রপ্তানি আদেশ বাংলাদেশের দিকে ঝুঁকছে

মিয়ানমারের গভীর রাজনৈতিক সংকট ও ভারতে করোনা মহামারির লাগামহীন পরিস্থিতিতে আন্তর্জাতিক খুচরা বিক্রেতা ও ব্র্যান্ডগুলোর ক্রয়াদেশ বাংলাদেশের দিকে ঝুঁকছে।

বাংলাদেশে সংক্রমণের দ্বিতীয় ঢেউয়ে তুলনামূলক কম প্রভাব পড়ায় তারা এদেশমুখী হচ্ছে।

সাম্প্রতিক মাসগুলোতে কোভিড-১৯ এর সংক্রমণের হার ও মৃত্যুর রেকর্ড বাড়ায়, দেশজুড়ে আংশিক পরিবহন লকডাউনের কারণে বাংলাদেশ এখন ভারতসহ এই অঞ্চলের অনেক দেশের তুলনায় তুলনামূলক ভালো পরিস্থিতিতে আছে।

রাজনৈতিক স্থিতিশীলতার কারণে বিশ্বব্যাপী সরবরাহ প্রক্রিয়াকে প্রভাবমুক্ত রাখতে কম দামে পণ্য উৎপাদনের জন্য আন্তর্জাতিক খুচরা বিক্রেতা ও ব্র্যান্ডগুলোর কাছে বাংলাদেশ একটি নিরাপদ জায়গা হিসেবে বিবেচিত হচ্ছে।

গত ১ ফেব্রুয়ারি মিয়ানমারের সেনাবাহিনী ক্ষমতা দখল করার পর থেকে দেশটিতে ব্যাপক বিক্ষোভ চলছে। নির্বাচিত নেতা অং সান সু চি ও তার ন্যাশনাল লীগ ফোর ডেমোক্রেসি দলের সদস্যদের আটক করে রাখা হয়েছে। ইতোমধ্যে শিশুসহ শতাধিক মানুষ নিহত হয়েছেন।

করোনার দ্বিতীয় ঢেউয়ের কারণে ভারত বিপর্যস্ত হয়ে যাওয়ায় সেখানকার হাসপাতাল ও শ্মশানগুলোতে চাপ বেড়েছে। দেশটিতে অক্সিজেন ও ওষুধের ব্যাপক সংকট দেখা দিয়েছে।

প্রতিবেশী দেশগুলো থেকে ক্রয়াদেশে স্থানান্তরিত হওয়ায় চলতি অর্থবছরের জুলাই থেকে এপ্রিলের মধ্যে বাংলাদেশের রপ্তানি আয় বৃদ্ধির ইঙ্গিত পাওয়া গেছে।

মার্চে অনেক পণ্য রপ্তানির আদেশ ফিরে আসায় দেশের বার্ষিক রপ্তানি ১২ দশমিক ৫৯ শতাংশ বেড়ে তিন দশমিক সাত বিলিয়ন ডলারে দাঁড়িয়েছে। এটি সম্ভব হয়েছে মূলত পশ্চিমের দেশগুলোতে লকডাউন শিথিল করার কারণে। যা আগের কয়েক মাসের তুলনায় পোশাকের চালান ধীরে ধীরে পুনরুদ্ধারের দিকে ধাবিত করছে।

এপ্রিলে রপ্তানি পুনরুদ্ধার অব্যাহত থাকার ফলে পণ্য চালানের আয় উল্লেখযোগ্য হারে বেড়ে চলেছে।

মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র ও ইউরোপীয় অর্থনীতি আবার চালু হওয়ায় তৈরি পোশাক রপ্তানি আয় বছরে ছয় গুণ বেড়ে এ বছরের এপ্রিলে তিন দশমিক ১৩ বিলিয়ন ডলারে পৌঁছেছে।

মহামারির মধ্যেও চলতি অর্থবছরের এপ্রিল পর্যন্ত ১০ মাসে গার্মেন্টস খাতে রপ্তানির পরিমাণ ছয় দশমিক ২৪ শতাংশ বেড়ে ২৬ বিলিয়ন ডলারে দাঁড়িয়েছে।

পোশাক খাত থেকে প্রাপ্ত আয়ের মধ্যে নিটওয়্যার আইটেমের রপ্তানি আয় থেকে ১৩ দশমিক ৯৯ বিলিয়ন ডলার এসেছে। এখানে বছরভিত্তিক প্রবৃদ্ধি ১৫ দশমিক ৩৪ শতাংশ রেকর্ড করা হয়েছে। তবে, ওভেন পণ্যের আয় দুই দশমিক ৭১ শতাংশ কমে ১২ বিলিয়ন ডলারে দাঁড়িয়েছে।

নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক বাংলাদেশের এক ইউরোপীয় ক্রেতা দ্য ডেইলি স্টারকে বলেছেন, ‘এটা সত্য যে মিয়ানমার থেকে ক্রয়াদেশ বাংলাদেশে স্থানান্তরিত হচ্ছে।’

তার কোম্পানি সামরিক শাসনে থাকা কোনো দেশের সঙ্গে ব্যবসা চালিয়ে নিতে চায় না। তাই, রাজনৈতিক উত্তেজনা ও মানবিক কারণে প্রতিষ্ঠানটি অন্যান্য দেশে ক্রয়াদেশ সরিয়ে নিচ্ছে এবং দীর্ঘমেয়াদে তা অব্যাহত থাকবে বলেও তিনি মন্তব্য করেছেন।

তিনি ক্রয়াদেশের কত শতাংশ বাংলাদেশের স্থানান্তরিত করেছেন, তা সঠিকভাবে বলতে পারেননি। তবে জানিয়েছেন, এ জাতীয় চুক্তিতে বাংলাদেশ একটা বড় অংশ পাচ্ছে।

ভারতের পরিস্থিতি সম্পর্কে তিনি বলেন, কোভিড-১৯ এর কারণে সাময়িকভাবে বাংলাদেশের কাছে ক্রয়াদেশ স্থানান্তরিত করা হয়েছে। কারণ, ভারত তার কোম্পানির জন্য একটি বড় সোর্সিং হাব ছিল।

কম্বোডিয়ার ক্ষেত্রেও একই কথা। দক্ষিণপূর্ব এশিয়ার দেশটিতে লকডাউনের কারণে কিছু ক্রয়াদেশ অন্য দেশে সাময়িকভাবে স্থানান্তরিত করা হয়েছে। কম্বোডিয়াও তার প্রতিষ্ঠানের জন্যে একটি বড় সোর্সিং হাব ছিল বলেও জানিয়েছেন তিনি।

লাগেজ, ফাস্ট ফ্যাশন ও ফুটওয়্যারের সুপরিচিত পশ্চিমের ব্র্যান্ডগুলোর সরবরাহের জন্য মিয়ানমার একটি গুরুত্বপূর্ণ লিংক হয়ে উঠেছে।

উদাহরণস্বরূপ: আল-জাজিরার প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, মিয়ানমার থেকে আমেরিকার আমদানি ২০২০ সালের ৩০ নভেম্বর পর্যন্ত ১২ মাসে এক দশমিক ০৬ বিলিয়ন ডলারে পৌঁছেছে, যা ২০১৬ সালে ছিল ২৪৫ মিলিয়ন ডলার।

এর মধ্যে পোশাক ও ফুটওয়্যারের পরিমাণ ৪১ শতাংশের বেশি। লাগেজ আমদানি ছিল প্রায় ৩০ শতাংশ ও মাছের পরিমাণ ছিল চার দশমিক চার শতাংশ।

মিয়ানমারে সেনা অভ্যুত্থানের কারণে তার ব্যবসায় প্রভাব পড়েছে কি না, জানতে চাইলে এইচঅ্যান্ডএমের মুখপাত্র আলরিকা ইসাকসন আল-জাজিরাকে এক বিবৃতিতে বলেছেন, ‘আমরা মনে করি মিয়ানমারে আমাদের উৎপাদনে প্রভাব পড়বে। আমাদের সরবরাহকারীদের সঙ্গে ঘনিষ্ঠভাবে যোগাযোগ করছি এবং সেখানকার পরিস্থিতি পর্যবেক্ষণ করছি।’

এক প্রশ্নের জবাবে ইসাকসন বলেন, ‘যদিও আমরা মিয়ানমারের পরিস্থিতি নিয়ে উদ্বিগ্ন এবং পরিস্থিতি ঘনিষ্ঠভাবে পর্যবেক্ষণ করছি, তবুও সেখানে আমাদের উপস্থিতির বিষয়ে যেকোনো তাৎক্ষণিক সিদ্ধান্ত নেওয়া থেকে বিরত থাকছি।’

বাংলাদেশের লেদারগুডস অ্যান্ড ফুটওয়্যার ম্যানুফ্যাকচারারস অ্যান্ড এক্সপোর্টার্স অ্যাসোসিয়েশনের সভাপতি মো. সাইফুল ইসলাম ডেইলি স্টারকে জানিয়েছেন, গত কয়েক মাস ধরে এই খাতে ক্রয়াদেশ বেড়েছে।

তিনি বলেন, ‘রাজনৈতিক অনিশ্চয়তার কারণে অনেক চামড়া ও চামড়াজাত পণ্যের প্রতিষ্ঠানগুলো মিয়ানমার থেকে বাংলাদেশে অর্ডার স্থানান্তর করেছে।’

সম্প্রতি চামড়া ও চামড়াজাত পণ্যের চালান পুনরুদ্ধারে এটি উল্লেখযোগ্যভাবে সহায়তা করেছে।

জুলাই থেকে এপ্রিলের মধ্যে চামড়া ও চামড়াজাত পণ্য চালানের আয় বছরে আট দশমিক ৫৬ শতাংশ বেড়ে ৭৬০ দশমিক ৯২ মিলিয়ন ডলারে দাঁড়িয়েছে।

বাংলাদেশ গার্মেন্টস ম্যানুফ্যাকচারার্স অ্যান্ড এক্সপোর্টার্স অ্যাসোসিয়েশনের (বিজিএমইএ) সভাপতি ফারুক হাসান ডেইলি স্টারকে জানিয়েছেন, কিছু কাজের আদেশ মিয়ানমার থেকে বাংলাদেশে এসেছে। তবে, বাংলাদেশের তুলনায় মিয়ানমারের মোট পোশাক রপ্তানির পরিমাণ খুব কম ছিল।

করোনার কারণে ভারতে ক্রয়াদেশ কিছুটা কমে গেছে উল্লেখ করে তিনি বলেন, ‘এই স্থানান্তর বাংলাদেশের পোশাক খাতে খুব একটা প্রভাব ফেলেনি।’

এর মানে এই নয় যে, মহামারির কারণে বাংলাদেশ ভারতের ক্রয়াদেশ পাচ্ছে, তিনি জানান।

বিজিএমইএর সাবেক সভাপতি রুবানা হক ডেইলি স্টারকে জানিয়েছেন, গত বছরের তুলনায় গত ১৫ দিনে রপ্তানি ১৬ শতাংশ কমেছে।

একমাত্র নিটওয়্যারের রপ্তানি বেড়েছে। অন্যদিকে ২০ আগস্ট থেকে ২১ এপ্রিলের মধ্যে ওভেন পণ্য প্রায় ছয় শতাংশ কমেছে।

রুবানা হক আরও বলেন, ‘আমি মনে করি না সামগ্রিকভাবে পোশাকশিল্প খাত পুনরুদ্ধার হয়েছে। তবে, নিটওয়্যার কিছুটা ভালো করছে।’

নারীদের বিশেষ পোশাক ও কৃত্রিম ফাইবার-ভিত্তিক পশমি কাপড়ের রপ্তানি উল্লেখযোগ্য হারে বেড়েছে। এখনো তুমুল প্রতিযোগিতা রয়েছে। করোনা পরিস্থিতি এই শিল্পের দুর্ভোগকে বাড়িয়ে তুলেছে বলেও মন্তব্য করেন তিনি।

বিশ্বব্যাংকের ঢাকা অফিসের সাবেক শীর্ষস্থানীয় অর্থনীতিবিদ জাহিদ হোসেন ডেইলি স্টারকে বলেন, ‘আমি মনে করি, বাইরে থেকে এত তাড়াতাড়ি কোনো সিদ্ধান্তে পৌঁছানো ঠিক না।’

ইংরেজি থেকে অনুবাদ করেছেন সুমন আলী

Comments

The Daily Star  | English

Interest payments, subsidies soak up almost half of budget

Interest payments and subsidies have absorbed nearly half of Bangladesh’s total budget expenditure in the first seven months of the current fiscal year, underscoring growing fiscal stress and raising concerns over public finances.

2h ago