নাটোরে আবাদি জমিতে পুকুর, ৮ বছরে কমেছে সাড়ে ৮ হাজার হেক্টর ফসলি জমি
নাটোরে তিন ও চার ফসলি জমি কমছে উল্লেখযোগ্য হারে। উর্বর আবাদি জমিতে পুকুর খননের ফলে কৃষি পণ্য উৎপাদনে বিরূপ প্রভাব পড়ছে।
গত আট বছরে জেলায় উর্বর আবাদি জমি কমেছে প্রায় সাড়ে ৮ হাজার হেক্টর। ফলে শস্য ভাণ্ডারখ্যাত নাটোরের কৃষিজমি রক্ষা করা না গেলে ভবিষ্যতে দেশের সামগ্রিক কৃষি উৎপাদনেই এর প্রভাব পড়তে পারে মনে করছেন কৃষিবিদরা।
শুধু তাই নয়, অপরিকল্পিতভাবে এসব পুকুর খননের ফলে তৈরি হচ্ছে জলাবদ্ধতা। বৃষ্টি হলেই ডুবে যাচ্ছে বিল-ঝিল, ফসলি জমি। এমনকি, ঘরবাড়িও তলিয়ে যাচ্ছে আকস্মিক বন্যায়।
স্থানীয়দের অভিযোগ খোদ প্রশাসনের সহযোগিতায় চলছে আবাদি জমিতে পুকুর খনন।
নাটোরের কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তরের উপপরিচালক সুব্রত কুমার সরকার দ্য ডেইলি স্টারকে বলেন, ‘২০১৩-১৪ মৌসুমে নাটোর জেলায় মোট আবাদি জমি ছিল এক লাখ ৫৪ হাজার ৯৬১ হেক্টর। এ বছর তা কমে এক লাখ ৪৬ হাজার ৫২৪ হেক্টরে দাঁড়িয়েছে। এসব আবাদি জমির বেশির ভাগেই পুকুর খনন করা হয়েছে এবং খননকৃত পুকুরের মাটি পুড়িয়ে ভাটায় ইট তৈরি করা হয়েছে।’
সাময়িক বেশি লাভের আশায় কৃষকরা ফসল উৎপাদন না করে মাছ চাষের দিকে ঝুঁকে পড়ছেন। কিন্তু, যেসব জমিতে পুকুর খনন হচ্ছে তা আর কখনোই আবাদি জমিতে ফিরিয়ে আনা সম্ভব নয়। কেননা, মাটিগুলো পুড়িয়ে ইট তৈরি করা হচ্ছে।
২০১৯ সালে ঢাকার ল’ ইয়ারস সোসাইটি ফর ল’ নামের মানবাধিকার ও পরিবেশবাদী সংগঠনের পক্ষে এর মহাসচিব মেজবাহুল ইসলাম আতিক নাটোরের পাঁচ উপজেলা— নাটোর সদর, নলডাঙ্গা, সিংড়া, বাগাতিপাড়া ও গুরুদাসপুরে আবাদি জমিতে জনস্বার্থে পুকুর খনন বন্ধে আদেশ চেয়ে উচ্চ আদালতে রিট পিটিশন করেছিলেন।
শুনানি শেষে বিচারপতি আশফাকুল ইসলাম ও বিচারপতি মোহাম্মাদ আলীর হাইকোর্ট বেঞ্চ ওই বছরের ১২ মে ভূমি মন্ত্রণালয়ের সচিব, নাটোরের জেলা প্রশাসক, জেলা পুলিশ সুপার, সংশ্লিষ্ট পাঁচটি উপজেলায় কৃষি জমিতে অবৈধ পুকুর খনন বন্ধে তদারকি ও তাৎক্ষণিক ব্যবস্থা গ্রহণের জন্য নির্দেশ দেন। তবু বন্ধ হয়নি আবাদি জমিতে পুকুর খনন।
বাগান করলে ফসলি জমিতে ফেরানো যায়, কিন্তু পুকুর করলে সম্ভব না
রাজশাহীর বরেন্দ্র মহাবিদ্যালয়ের শিক্ষক কৃষিবিদ সৈয়দা বদরুন নেসা ডেইলি স্টারকে বলেন, ‘নাটোর-রাজশাহী অঞ্চলের কৃষকরা তাদের জমিতে বছরে তিন থেকে চারটি করে ফসল উৎপাদন করেন। এমন উর্বরা জমি দেশের খুব কম অঞ্চলে আছে।
‘যত্রতত্র অপরিকল্পিত পুকুর খননের ফলে একদিকে যেমন আবাদি জমি ভয়ানক হারে কমে যাচ্ছে অন্যদিকে পুকুরগুলোতে খরা মৌসুমে পানি সংকট দেখা দেওয়ায় চাষিরা ভূগর্ভস্থ পানি দিয়ে মাছ চাষের দিকে ঝুঁকছেন। ফলে এই অঞ্চলের ভূগর্ভস্থ পানির ওপরও মারাত্মক চাপ পড়ছে এবং মাছ চাষের উৎপাদন খরচ বেড়ে যাওয়ায় কৃষকরা লোকসানে পড়ছেন।’
‘যেসব আবাদি জমির মাটি ভাটায় ব্যবহার করে ইট তৈরি হচ্ছে তাতে দেশের অপূরণীয় ক্ষতি হচ্ছে। এসব পুকুর আর কোনো দিন ফসলি জমিতে রূপান্তর সম্ভব নয়। জমিতে বাগান করলে তা পুনরায় ফসলি জমিতে ফেরানো যায়। পুকুর করলে তা সম্ভব হয় না।’
তিনি আরও বলেন, ‘নাটোর অঞ্চলের কৃষকরা তাদের জমিতে মুগ, ভুট্টা, ধান, রসুন, আখ, ড্রাগন, পেয়ারা থেকে শুরু করে সবজি জাতীয় ফসল উৎপাদনে দেশের প্রথম সারির জেলা। এখানকার কৃষকরা চলনবিলেও তিনটি ফসল ফলায়। যদিও চলনবিলের জমিগুলো বছরের ছয় মাস পানির নিচে ডুবে থাকে।’
‘চলনবিলে কৃষকরা রোপা আমন ধান কেটে সেই জমিতে বিনা চাষে রসুন উৎপাদন করে। রসুনের জমিতেই আবার তরমুজ, বাঙ্গি, ক্ষিরা রোপন করে। বছরের বাকি ছয় মাস কৃষকরা চলনবিলে মাছ শিকার করে উপার্জন করে,’ যোগ করেন তিনি।
নাটোর জেলা মৎস্য কর্মকর্তা মো. জাহাঙ্গীর আলম ডেইলি স্টারকে বলেন, ‘তিন-চার ফসলি জমিতে পুকুর খনন করে মাছ চাষ কোনোভাবেই সমর্থন করা যায় না। এক ফসলি বা অনাবাদি জমিতে পুকুর করে মাছ চাষের বিষয়ে কৃষকদের উদ্বুদ্ধ এবং তিন-চার ফসলি জমিতে পুকুর খননে নিবৃত করতে চাষিদের পরামর্শ দিয়ে আসছে মৎস্য বিভাগ।’
তিনি আরও বলেন, ‘মাছ যেমন দরকার একইভাবে ফসল উৎপাদনও দরকার। নাটোর জেলায় গত ১০ বছরে প্রায় ২০ হাজার মেট্রিক টন মাছ উৎপাদন বেড়েছে। ২০১০-১১ মৌসুমে যেখানে জেলায় মোট মাছের উৎপাদন ছিল ৪০ হাজার মেট্রিক টন বর্তমানে ২০২০-২১ মৌসুমে তা বেড়ে ৬৪ হাজার মেট্রিক টনে দাঁড়িয়েছে।’
নাটোরের বাগাতিপাড়া উপজেলার কাকফো গ্রামের কৃষক শামীম হোসেন ডেইলি স্টারকে জানান, তিনি প্রায় ২০ বিঘা জমিতে নানা ফসল আবাদ করেন। ফসল উৎপাদন করে তার উৎপাদন খরচ বাদ দিয়ে তেমন লাভ হয় না। সে জন্য তিনি তার জমিতে পুকুর খনন করে মাছ চাষ করতে চান।
আবাদি জমিতে পুকুর খননের বিধিনিষেধ থাকায় নিজেরা ব্যর্থ হয়ে এখন তিনি ভাটা মালিকদের দারস্থ হয়েছেন। ভাটা মালিকরা মাটি কেটে নিয়ে যাচ্ছে এবং পুকুর খনন করে পাড় বেঁধে দিয়ে যাচ্ছে। মাটির কোনো দাম তারা দিচ্ছেন না। তবুও তিনি খুশি।
প্রশাসনের বিরুদ্ধে অভিযোগ
ইছলাবাড়ী গ্রামের কৃষক মনি ইসলামের অভিযোগ, ‘প্রশাসনকে ম্যানেজ করেই ভাটা মালিকরা পুকুরের মাটি ভাটায় নিয়ে যাচ্ছেন।’
তিনি ডেইলি স্টারকে বলেছেন, ‘ইউএনও ও পুলিশের লোকজন এসে তদন্ত করে পুকুর কাটার অনুমতি দিয়েছেন বলেই পুকুর কাটা হচ্ছে।’
এ বিষয়ে সদর উপজেলা নির্বাহী অফিসার (ইউএনও) জাহাঙ্গীর আলম ডেইলি স্টারকে বলেন, ‘ভাটা মালিকরা জেলা প্রশাসকের কাছে আবেদন করেছিল যে ইট বানানোর মাটির জন্যে তারা অনাবাদি জমিতে পুকুর খনন করতে চান। এর ভিত্তিতে আমাদের তদন্ত করে প্রতিবেদন দিতে বলা হয়েছিল। সে জন্যেই আমরা গিয়েছিলাম। এখনো কোনো প্রতিবেদন দেওয়া হয়নি। জেলা প্রশাসনও পুকুর কাটার অনুমতি দেয়নি।’
নাটোর জেলা আওয়ামী লীগের সভাপতি ও নাটোর-৪ আসনের সংসদ সদস্য আব্দুল কুদ্দুস ডেইলি স্টারকে বলেন, ‘আবাদি জমি রক্ষা এবং অপরিকল্পিত পুকুর খনন বন্ধে সব সময় কথা বলেছি। প্রশাসনের অসহযোগিতায় তা বন্ধ করা যাচ্ছে না। জেলা আইন-শৃঙ্খলা সভায় যত কথাই বলি না কেন প্রশাসন কোনো ব্যবস্থাই নেয় না। তাদের মনে যা আছে তারা তাই করে। সে কারণে আইন-শৃঙ্খলা সভায় আর যাই না। আমি নিজে আবাদি জমি রক্ষায় সব সময় সোচ্চার। এখন সাধারণ জনগণ পুকুর খনন বন্ধের দাবিতে প্রতিবাদ সভা ও মানববন্ধন করছে।’
তবে এসব অভিযোগ নাকচ করেছেন জেলা প্রশাসক মোহাম্মদ শাহারিয়াজ ও জেলা পুলিশ সুপার লিটন কুমার সাহা।
ইটভাটা মালিকদের সঙ্গে যোগসাজোশের অভিযোগ বিষয়ে জানতে চাইলে জেলা প্রশাসক মোহাম্মদ শাহারিয়াজ ডেইলি স্টারকে বলেন, ‘প্রশাসনের কোনো কর্মকর্তা আবাদি জমিতে পুকুর খননের সঙ্গে জড়িত থাকতে পারবেন না। অভিযোগের সত্যতা পাওয়া গেলে ব্যবস্থা নেওয়া হবে।’
তিনি আরও বলেন, ‘আবাদি জমি রক্ষায় প্রধানমন্ত্রী কড়া নির্দেশ দিয়েছেন। পাশাপাশি উচ্চ আদালতের আদেশ আছে আবাদি জমিতে পুকুর খনন বন্ধ করতে হবে। সেই মোতাবেক প্রশাসন নিয়মিত অভিযান চালাচ্ছে। কোনোভাবেই আবাদি জমিতে পুকুর খনন করতে দেওয়া হবে না।’
Comments