অফিসিয়াল সিক্রেটস অ্যাক্ট: নতুন আইন ও সংবিধান পরিপন্থী

সাংবাদিক রোজিনা ইসলাম। ছবি: আনিসুর রহমান

যে অফিসিয়াল সিক্রেটস অ্যাক্টের আওতায় সাংবাদিক রোজিনা ইসলামের বিরুদ্ধে অভিযোগ এনে তাকে জেলে পাঠানো হয়েছে, তা সরাসরি তথ্য অধিকার আইন, জনস্বার্থ সংশ্লিষ্ট তথ্য প্রকাশ (সুরক্ষা প্রদান) আইন ও সংবিধানের চেতনা পরিপন্থী।

আইন বিশেষজ্ঞরা বলছেন, ২০০৯ ও ২০১১ সালে এই আইন দুটি প্রণীত হওয়ার পর প্রায় শতবর্ষ পুরনো অফিসিয়াল সিক্রেটস অ্যাক্টের কার্যকারিতা হারিয়েছে। কারণ নতুন আইন সব সময়ই অগ্রাধিকার পাবে।

১৯২৩ সালে ব্রিটিশ উপনিবেশিক আমলে তখনকার শাসকদের বিবেচনায় রাষ্ট্রের বিরুদ্ধে গুপ্তচরবৃত্তি প্রতিহত করার জন্য অফিসিয়াল সিক্রেটস অ্যাক্ট প্রণয়ন করা হয়েছিল। কিন্তু ১৯৭২ সালে প্রণীত বাংলাদেশের সংবিধান মানুষের মত প্রকাশের স্বাধীনতাকে মৌলিক অধিকার হিসেবে স্বীকৃতি দিয়েছে।

তাই অফিসিয়াল সিক্রেটস অ্যাক্টের ৩ ও ৫ নম্বর ধারা সংবিধানের ৩৯ নম্বর অনুচ্ছেদে বর্ণিত এই মৌলিক অধিকারকে লঙ্ঘন করে।

বিশেষজ্ঞদের অভিমত, এ ছাড়া তথ্যের অবাধ প্রবাহ ও মানুষের জানার অধিকার নিশ্চিত করার জন্য এবং জনগণের স্বার্থ সংশ্লিষ্ট তথ্য অবমুক্ত করার বিষয়ে কর্মকর্তাদের উৎসাহিত করার জন্য সরকার তথ্য অধিকার আইন ও ‘হুইসেল ব্লোয়িং’ হিসেবে পরিচিত জনস্বার্থ সংশ্লিষ্ট তথ্য প্রকাশ (সুরক্ষা প্রদান) আইন প্রণয়ন করেছে।

বিশিষ্ট আইনবিদ শাহদীন মালিক এ বিষয়ে দ্য ডেইলি স্টারকে বলেন, ‘হয়তো দুই-এক বার অফিসিয়াল সিক্রেটস অ্যাক্টটি ব্যবহার করা হয়েছে।’

শাহদীন মালিকের মতে, এ আইনের আওতায় করা মামলায় সাংবাদিক রোজিনা ইসলামের গ্রেপ্তারের ঘটনাটি সুস্পষ্টভাবে এর অপব্যবহার। কারণ রাষ্ট্রের বিরুদ্ধে গুপ্তচরবৃত্তি প্রতিহত করা ও শাস্তি নিশ্চিত করাই ছিল এই আইন প্রণয়নের মূল উদ্দেশ্য।

সুপ্রিম কোর্টের আইনজীবী জ্যোতির্ময় বড়ুয়া বলেন, ‘অফিসিয়াল সিক্রেটস অ্যাক্ট প্রণীত হয়েছিল ব্রিটিশ আমলের রাজনৈতিক ও আর্থ-সামাজিক অবস্থা এবং তখনকার বিচার ব্যবস্থার পরিপ্রেক্ষিতে। আর ব্রিটিশ শাসকরা এ দেশের মানুষদের বিশ্বাস করতো না।’

‘ব্রিটিশ আমলের এই আইন এখন অপ্রয়োজনীয়’ এমন মন্তব্য করে জ্যোতির্ময় বড়ুয়া আরও বলেন, ‘বাংলাদেশের সংবিধান এ দেশের জনগণকে সব ক্ষমতার উৎস হিসেবে রেখেছে। তাই এ দেশের মানুষকে অবিশ্বাস করার মতো কোনো প্রশ্ন থাকতে পারে না।’

সুপ্রিম কোর্টের এই আইনজীবীর অভিমত, তথ্য অধিকার আইন ও জনস্বার্থ সংশ্লিষ্ট তথ্য প্রকাশ (সুরক্ষা প্রদান) আইন কার্যকর হওয়ার পর উপনিবেশিক এই আইনটি তার কার্যকারিতা হারিয়েছে।

জ্যোতির্ময় বড়ুয়া বলেন, ‘অফিসিয়াল সিক্রেটস অ্যাক্টের আওতায় সাংবাদিক রোজিনা ইসলামের গ্রেপ্তারের ঘটনাটি এই পেশার ওপর একটা বড় আঘাত। যা বিচার ব্যবস্থাকে হাস্যকর করে তুলেছে।’

আইন ও সংবিধান বিষয়ক গবেষণা প্রতিষ্ঠান ল ল্যাব’র প্রধান আইনজীবী মোহাম্মদ শিশির মনির বলেন, ‘অফিসিয়াল সিক্রেটস অ্যাক্টের ৩ ও ৫ নম্বর ধারা সংবিধানের ৩৯ নম্বর অনুচ্ছেদ ও জনস্বার্থ সংশ্লিষ্ট তথ্য প্রকাশ (সুরক্ষা প্রদান) আইন-২০১১ এর সঙ্গে সাংঘর্ষিক।’

শিশির মনিরের ভাষ্য, সংবিধানের ৩৯ নম্বর অনুচ্ছেদ রাষ্ট্রের নিরাপত্তা ও অন্য দেশের সঙ্গে সম্পর্কের ক্ষেত্রে যুক্তিসঙ্গত কিছু বিধিনিষেধ রেখে সংবাদপত্রের স্বাধীনতা নিশ্চিত করেছে। সে ক্ষেত্রে নির্দিষ্ট কিছু কর্মকর্তার দুর্নীতি ও অনিয়মের ঘটনা উদঘাটনে তথ্য সংগ্রহের বিষয়টি রাষ্ট্রীয় নিরাপত্তা ও অন্য দেশের সঙ্গে বন্ধুত্বপূর্ণ সম্পর্ককে কখনোই প্রভাবিত করতে পারে না।

এই আইনজীবীর মতে, জনস্বার্থ সংশ্লিষ্ট তথ্য প্রকাশ (সুরক্ষা প্রদান) আইন প্রামাণিক তথ্য উদঘাটনে উৎসাহ দেওয়ার পাশাপাশি যারা এ ধরনের তথ্য অবমুক্ত করতে চায় তাদের নিরাপত্তা দেয়। এ ছাড়া এই আইনে সুনির্দিষ্ট কোনো তথ্যের ভিত্তিতে অপরাধ প্রমাণিত হলে সেই তথ্যদাতা কিংবা তথ্য উদঘাটনকারীদের পুরস্কৃত করার বিধান আছে।

আইনমন্ত্রী আনিসুল হক অফিসিয়াল সিক্রেটস অ্যাক্ট ব্যবহারের বিষয়ে কোনো মন্তব্য করতে অস্বীকৃতি জানান। দ্য ডেইলি স্টারকে তিনি বলেন, ‘এটা এখন আদালতের বিষয়। আমি যদি এখন এই বিষয়ে কোনো মন্তব্য করি, তাহলে তা বিচারপ্রক্রিয়াকে প্রভাবিত করতে পারে।’

সংবিধান কী বলছে

অফিসিয়াল সিক্রেটস অ্যাক্টের ৩ নম্বর ধারা অনুসারে, নিষিদ্ধ স্থানে যদি কেউ যায় বা যেতে উদ্যত হয় কিংবা ওই স্থানের কোনো নকশা বা স্কেচ তৈরি করে বা কোনো গোপন তথ্য সংগ্রহ বা প্রকাশ করে তবে সে অপরাধী হবে। এই ধারায় বলা হয়েছে, নিষিদ্ধ স্থানের কোনো ফটো, স্কেচ বা নকশা কেউ প্রকাশ করতে পারবে না।

আবার এই ধারায় গুপ্তচরবৃত্তির শাস্তির কথা উল্লেখ করে বলা হয়েছে, যদি কোনো ব্যক্তি রাষ্ট্রের নিরাপত্তা অথবা স্বার্থের পরিপন্থী কোনো উদ্দেশ্যে নিষিদ্ধ এলাকায় গমন করে, শত্রু পক্ষের উপকারে আসার মতো কোনো স্কেচ, প্ল্যান, মডেল অথবা নোট তৈরি করে কিংবা কোনো অফিসিয়াল গোপন কোড অথবা পাসওয়ার্ড অথবা নোট অথবা অন্য কোনো দলিলপত্র অথবা তথ্য আহরণ করে, রেকর্ড করে, প্রকাশ করে অথবা অন্য কোনো ব্যক্তির কাছে পাচার করে, তবে সে এই ধারার অপরাধে অপরাধী হবে।

আইনটির ৫ নম্বর ধারায় ‘কর্মকর্তাদের অনৈতিক যোগাযোগ’ ও ‘নিষিদ্ধ এলাকায়’ প্রবেশের কথা বলা হয়েছে।

এদিকে, জনস্বার্থ সংশ্লিষ্ট তথ্য প্রকাশ (সুরক্ষা প্রদান) আইন-২০১১ এর ৪ নম্বর ধারা বলছে, যে কোনো হুইসেল ব্লোয়ার/তথ্য উন্মোচনকারী জনস্বার্থ সংশ্লিষ্ট তথ্য অবমুক্ত করতে পারে, যদি তা যুক্তিসঙ্গত মনে হয়, উপযুক্ত কর্তৃপক্ষ যদি যুক্তির ভিত্তিতে তথ্যটি বিশ্বাস করে।

একই আইনের ৫ নম্বর ধারায় বলা হয়েছে, যদি কোনো হুইসেল ব্লোয়ার প্রামাণিক/বিশ্বাসযোগ্য কোনো তথ্য প্রকাশ করে, তাহলে অনুমতি ছাড়া তাদের পরিচয় প্রকাশ করা যাবে না।

এখানে আরও বলা হয়েছে, জনস্বার্থ সংশ্লিষ্ট তথ্য প্রকাশের জন্য হুইসেল ব্লোয়ারের বিরুদ্ধে কোনো ক্রিমিনাল অথবা সিভিল কিংবা বিভাগীয় মামলা দায়ের করা যাবে না।

যদি ওই হুইসেল ব্লোয়ার চাকরিজীবী হন তাহলে পদাবনতি, হয়রানিমূলক বদলি কিংবা জোরপূর্বক অবসরে পাঠানো অথবা অন্য কোনো ব্যবস্থা তার বিরুদ্ধে নেওয়া যাবে না। যা তার মানসিক, অর্থনৈতিক অথবা সামাজিক অবস্থানের ক্ষেত্রে ক্ষতির কারণ হতে পারে। অথবা কেবল জনস্বার্থ বিষয়ক তথ্য অবমুক্ত করার জন্য তার বিরুদ্ধে কোনো বিভাগীয় ব্যবস্থা নেওয়া যাবে না কিংবা বৈষম্যমূলক আচরণ করা যাবে না।

এ ছাড়াও,  সংবিধানের ৩৯-এর (১) অনুচ্ছেদে সবার চিন্তা ও বিবেকের স্বাধীনতা নিশ্চিত করা হয়েছে।

আবার ৩৯-এর (২) অনুচ্ছেদে বলা হচ্ছে, ‘রাষ্ট্রের নিরাপত্তা, বিদেশি রাষ্ট্রগুলোর সঙ্গে বন্ধুত্বপূর্ণ সম্পর্ক, জনশৃঙ্খলা, শালীনতা ও নৈতিকতার স্বার্থে কিংবা আদালত-অবমাননা, মানহানি বা অপরাধ-সংঘটনে প্ররোচনা সম্পর্কে আইনের দ্বারা আরোপিত যুক্তিসঙ্গত বাধানিষেধ-সাপেক্ষে প্রত্যেক নাগরিকের বাক ও ভাব প্রকাশের স্বাধীনতার অধিকারের এবং সংবাদ ক্ষেত্রের স্বাধীনতার নিশ্চয়তা দেওয়া হলো।’

প্রতিবেদনটি ইংরেজি থেকে অনুবাদ করেছেন মামুনুর রশীদ

Comments

The Daily Star  | English

'Our task is to tell the truth in transparent, compelling way'

Says CA’s press secretary on Trump’s comment on Bangladesh

3h ago