চা শ্রমিকের ‘মুল্লুকে চল’ আন্দোলনের রক্তমাখা দিন

১৯২১ সালের ২০ মে। চা শ্রমিকদের ওপর ব্রিটিশ ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানির অব্যাহত নির্যাতন-নিপীড়নের প্রতিবাদে পণ্ডিত গঙ্গাচরণ দীক্ষিত ও পণ্ডিত দেওসরন ‘মুল্লুকে চল’ (দেশে চল) আন্দোলনের ডাক দেন। সেই ডাকে সাড়া দিয়ে সিলেট থেকে পায়ে হেঁটে চাঁদপুরের মেঘনা স্টিমার ঘাটে পৌঁছান এ অঞ্চলের ৩০ হাজারের বেশি চা শ্রমিক। কিন্তু, ব্রিটিশ সেনাদের গুলিতে শ্রমিকদের জাহাজে চড়ে দেশে ফেরার স্বপ্ন শেষ যায়। মেঘনার জলে ভাসতে থাকে শত শত চা-শ্রমিকের মরদেহ। আর যারা গুলির মুখ থেকে স্টিমার ঘাট থেকে পালালেন, আন্দোলনে শামিল হওয়ার অপরাধে তাদের ওপরেও নেমে আসে নির্মম নির্যাতন।
সাধারণ শ্রমিকদের অব্যাহত দাবির মুখে শতবর্ষেও মেলেনি দিবসটির রাষ্ট্রীয় স্বীকৃতি। ছবি: স্টার

১৯২১ সালের ২০ মে। চা শ্রমিকদের ওপর ব্রিটিশ ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানির অব্যাহত নির্যাতন-নিপীড়নের প্রতিবাদে পণ্ডিত গঙ্গাচরণ দীক্ষিত ও পণ্ডিত দেওসরন ‘মুল্লুকে চল’ (দেশে চল) আন্দোলনের ডাক দেন। সেই ডাকে সাড়া দিয়ে সিলেট থেকে পায়ে হেঁটে চাঁদপুরের মেঘনা স্টিমার ঘাটে পৌঁছান এ অঞ্চলের ৩০ হাজারের বেশি চা শ্রমিক। কিন্তু, ব্রিটিশ সেনাদের গুলিতে শ্রমিকদের জাহাজে চড়ে দেশে ফেরার স্বপ্ন শেষ যায়। মেঘনার জলে ভাসতে থাকে শত শত চা-শ্রমিকের মরদেহ। আর যারা গুলির মুখ থেকে স্টিমার ঘাট থেকে পালালেন, আন্দোলনে শামিল হওয়ার অপরাধে তাদের ওপরেও নেমে আসে নির্মম নির্যাতন।

ওই ঘটনার পর কেটে গেছে পুরো একটা শতাব্দী। তখন থেকেই রক্তাক্ত ওই দিনটিকে পালন করা হচ্ছে চা-শ্রমিক দিবস হিসেবে। কিন্তু, সাধারণ শ্রমিকদের অব্যাহত দাবির মুখে শতবর্ষেও মেলেনি দিবসটির রাষ্ট্রীয় স্বীকৃতি।

সিলেট অঞ্চলে কর্মরত বিভিন্ন চা বাগানের শ্রমিক ও এই খাত সংশ্লিষ্ট বিভিন্ন সংগঠনের নেতা-কর্মীরা বলছেন, প্রতি বছর নানা আয়োজনের ভেতর দিয়ে দিবসটি পালিত হয়। দাবি তোলা হয় রাষ্ট্রীয় স্বীকৃতির। কিন্তু, এ ব্যাপারে এখন পর্যন্ত আনুষ্ঠানিক কোনো উদ্যোগ নেয়নি চা-শ্রমিকদের একমাত্র রেজিস্টার্ড সংগঠন বাংলাদেশ চা-শ্রমিক ইউনিয়ন।

প্রতি বছর নানা আয়োজনের ভেতর দিয়ে দিবসটি পালিত হয়। ছবি: সংগৃহীত

বিভিন্ন সূত্রে জানা যায়, ১৮৫৪ সালে সিলেটের মালনীছড়া চা-বাগান প্রতিষ্ঠার মধ্য দিয়ে ব্রিটিশ কোম্পানিগুলো এ অঞ্চলে বাণিজ্যিকভাবে চা-বাগান তৈরি শুরু করে। সুন্দর ও উন্নত জীবনের প্রলোভন দেখিয়ে কোম্পানিগুলো দালালের মাধ্যমে দক্ষিণ ও মধ্য ভারতের উড়িষ্যা, মাদ্রাজ, বিহার, মধ্যপ্রদেশের অভাবপীড়িত ও অনুর্বর অঞ্চল থেকে হাজার হাজার মানুষকে নিয়ে আসে। এদের আসাম ও বৃহত্তর সিলেট অঞ্চলের গহীন জঙ্গলে চা-বাগান তৈরির অমানুষিক কাজে বাধ্য করা হয়। কিন্তু, এক বেলাও পেট পুরে খাবার জুটত না এসব শ্রমিকের। পাশাপাশি চলত নানান শারীরিক নির্যাতন। সব মিলিয়ে অচিরেই তাদের সুন্দর জীবনের মোহ কেটে যায়।

চা-বাগানের শ্রমিকদের নিয়ে কাজ করা নাট্য ব্যক্তিত্ব সুনীল বিশ্বাস দ্য ডেইলি স্টারকে বলেন, ‘আমরা চা- শ্রমিক দিবসের রাষ্ট্রীয় স্বীকৃতি চেয়ে আজও উপেক্ষিত হয়ে আছি। চা-শ্রমিক ইউনিয়নের নেতারা এখন পর্যন্ত এ ব্যাপারে সরকারের কাছে আনুষ্ঠানিক প্রস্তাব রাখতে পারেননি। আলোচনা করা তো দূরের কথা।’

রক্তাক্ত ওই দিনটিকে পালন করা হচ্ছে চা-শ্রমিক দিবস হিসেবে। ছবি: স্টার

জুলেখা চা বাগানের শ্রমিক মেনকা সাঁওতাল বলেন, ‘এত বছরেও চা-বাগানের শ্রমিকদের ভাগ্যের কোনো পরিবর্তন হয়নি। উন্নয়নের ছোঁয়া লাগেনি তাদের জীবনযাত্রায়। এমনকি মৌলিক কোনো অধিকারও তাদের নেই। চা বাগানের এই জনগোষ্ঠী এখনো ব্রিটিশ সামন্তবাদ আর স্থানীয় বাবু-সাহেবদের বেড়াজাল ছিন্ন করতে পারেনি।’

চা-শ্রমিক ইউনিয়নের দেওয়া তথ্য অনুযায়ী, দেশে মোট চা-শ্রমিকের সংখ্যা প্রায় সাত লাখ। এর মধ্যে নিবন্ধিত শ্রমিক মাত্র ৯৪ হাজারের মতো। একজন চা শ্রমিকের সাপ্তাহিক বেতন ৮৪০ টাকা। সপ্তাহে দেওয়া হয় ৩ কেজি ২৭০ গ্রাম চাল বা আটা।

কমলগঞ্জ উপজেলার দেওরাছড়া চা বাগানের শ্রমিক ব্রিটিশ ঘাটুয়ালের কথায় উঠে আসে এখানকার শ্রমিকদের মানবেতর জীবনের কথা।

তিনি বলেন, ‘এখানে পাঁচ-ছয় সদস্যের অনেক পরিবার আছে। এর মধ্যে একজন হয়তো কাজ পাচ্ছে। বাকিরা দৈনিক ১২০ টাকার ওপর নির্ভর করেই দিন চালাচ্ছে। চা-বাগানের শ্রমিকরা গবাদি পশু ও সন্তানদের নিয়ে একই ভাঙাচোরা ঘরে থাকেন। বাগান কর্তৃপক্ষের ঘর মেরামত করে দেওয়ার কথা থাকলেও বছরের পর বছর তা হয় না।’

ব্রিটিশ ঘাটুয়াল আরও বলেন, ‘আমাদের নিজস্ব কোনো জায়গা নেই। বাগানে কাজ না করলে থাকার জায়গাও হারাতে হবে।’

বিশ্ববিদ্যালয় চা ছাত্র সংসদের সাধারণ সম্পাদক রাজু নুনিয়া দ্য ডেইলি স্টারকে বলেন, ‘এত কষ্টের মধ্যেও সবচেয়ে বেশি কষ্ট লাগে, যখন সমাজের একটা বড় অংশ বলে যে আমরা ভারতীয়। আমরা যখন বঙ্গে আসি তখনো ভারতবর্ষ ভাগ হয়নি। এখানে সবার একটা পরিচয় আছে। কিন্তু চা-শ্রমিকদের সেটা নেই। আবার আমাদের নিজস্ব ভাষা-সংস্কৃতি থাকলেও নেই কোনো স্বীকৃতি।’

রক্তাক্ত ওই দিনটিকে পালন করা হচ্ছে চা-শ্রমিক দিবস হিসেবে। ছবি: স্টার

সিলেট চা জনগোষ্ঠী ছাত্র যুব কল্যাণ পরিষদের সহসভাপতি সুজিত বাড়াইকের অভিযোগ, একজন চা-শ্রমিক বাগানে কাজ না করলে তাকে থাকতে দেওয়া হয় না। অথচ প্রায় প্রতিটি বাগানে নিম্নমানের অ্যালকোহলের দোকান আছে। যাদের কোনো কাজ ছাড়াই থাকার জায়গাসহ সব ধরনের সুযোগ-সুবিধা দিচ্ছে মালিকপক্ষ।’

বাংলাদেশ চা সংসদ সিলেট ভ্যালির সভাপতি জি এম শিবলীর বলেন, ‘চা-শ্রমিকদের জীবনমান উন্নয়নের জন্য কাজ চলছে। প্রতিটি বাগানে প্রাথমিক বিদ্যালয় স্থাপন করা হচ্ছে।’

চা-শ্রমিক দিবসের স্বীকৃতির বিষয়ে শিবলী বলেন, ‘যে কেউ প্রস্তাব দিলেইতো হবে না। চা-শ্রমিকদের রেজিস্টার্ড সংগঠন বাংলাদেশ চা শ্রমিক ইউনিয়নের মারফতে সেটা আসতে হবে।’

এ বিষয়ে বিভাগীয় শ্রম অধিদপ্তরের (শ্রীমঙ্গল) উপপরিচালক মোহাম্মদ নাহিদুল ইসলাম দ্য ডেইলি স্টারকে বলেন, ‘আমি আড়াই বছর ধরে এখানে দায়িত্বে আছি। শ্রমিক নেতাদের সঙ্গে অনেক সভা হয়েছে। কিন্তু চা-শ্রমিক দিবসের স্বীকৃতি নিয়ে কেউ কোনো কথা বলেনি।’

বাংলাদেশ চা-শ্রমিক ইউনিয়নের কেন্দ্রীয় কমিটির সাংগঠনিক সম্পাদক ও সিলেট ভ্যালির সভাপতি রাজু গোয়ালাও বলেন, ‘এ রকম যে কোনো ধরনের প্রস্তাব ইউনিয়নের কেন্দ্রীয় কমিটির সভাপতি ও সাধারণ সম্পাদকের পক্ষ থেকে দেওয়ার কথা। আমার জানা মতে, তারা এ সংক্রান্ত কোন প্রস্তাব এখন পর্যন্ত দেননি।’

এ বিষয়ে কথা বলতে চা-শ্রমিক ইউনিয়নের কেন্দ্রীয় কমিটির সহসভাপতি পংকজ কন্দ ও সাধারণ সম্পাদক রামভজন কৈরির মুঠোফোনে যোগাযোগ করা হলেও তারা ফোন ধরেননি।

Comments

The Daily Star  | English

DMCH doctors threaten strike after assault on colleague

A doctor at Dhaka Medical College Hospital (DMCH) was allegedly assaulted yesterday after the death of a private university student there, with some of his peers accusing the physicians of neglecting their duty in his treatment

6h ago