২১ মে ১৯৭১: বঙ্গবন্ধুর মুক্তি চেয়ে প্রবাসী সরকারের বিবৃতি
মুক্তিযুদ্ধের ২১ মে ছিল ঘটনাবহুল একটি দিন। এই দিনে বঙ্গবন্ধুর মুক্তির দাবি জানিয়ে মার্কিন সরকার, সোভিয়েত ইউনিয়ন, ব্রিটেন, ভারত এবং জাতিসংঘের সমর্থন ও হস্তক্ষেপ কামনা করে প্রবাসী বাংলাদেশ সরকার।
জাতিসংঘে পাকিস্তানের স্থায়ী প্রতিনিধি তার বক্তব্যে স্পষ্ট করেন, আসলেই পূর্ব পাকিস্তান থেকে বিপুল সংখ্যক মানুষ শরণার্থী হিসেবে ভারতে আশ্রয় নিয়েছে।
চীনের কোনসাল জেনারেল চ্যাং ইন এক বিবৃতিতে বলেন, পূর্ব পাকিস্তানে যা ঘটছে তা পাকিস্তানের একান্তই অভ্যন্তরীণ বিষয়। এই বিষয়ে চীনের মন্তব্য শোভা পায় না।
এই দিনে বাগেরহাটের মংলার পেড়িখালি ইউনিয়নের ডাকরা গ্রামে রাজাকারদের পৈশাচিক গণহত্যায় শহীদ হন ৬৪৬ নিরীহ হিন্দু ধর্মাবলম্বী সাধারণ মানুষ।
বঙ্গবন্ধুর মুক্তির দাবিতে প্রবাসী বাংলাদেশ সরকারের বিবৃতি
প্রবাসী বাংলাদেশ সরকারের স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী এ এইচ এম কামরুজ্জামান কলকাতা থেকে এক বিবৃতিতে বলেন, বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানকে যে পাকিস্তানের সামরিক প্রশাসন আটক করেছে এই ব্যাপার এখন সন্দেহাতীতভাবে প্রমাণিত। এ সময় তিনি বলেন, স্বাধীন বাংলাদেশের রাষ্ট্রপতি ও বাংলাদেশের অবিসংবাদিত নেতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের মুক্ত চাইছি।
তিনি তার বক্তব্যে যুক্তরাষ্ট্র, যুক্তরাজ্য, সোভিয়েত ইউনিয়ন, জাতিসংঘ ও ভারতের দৃষ্টি আকর্ষণ করেন।
পাকিস্তানে প্রেসিডেন্ট ইয়াহিয়া ও পিপলস পার্টির জুলফিকার আলী ভুট্টোর বৈঠক
২১ মে এক বিজ্ঞপ্তিতে পাকিস্তানের প্রেসিডেন্ট জেনারেল ইয়াহিয়া খান দেশের মানুষকে পূর্ব পাকিস্তান থেকে ভারতে আশ্রয় নেওয়া শরণার্থীদের বিষয়ে না ভাবতে আহ্বান জানান।
একই সঙ্গে তিনি বলেন, স্বাভাবিক জীবনযাত্রা চালিয়ে যেতে ও তাদের কথায় কান না দিতে। পাকিস্তান সরকার তাদের দেশে ফিরিয়ে আনতে বদ্ধ পরিকর। মূলত মুক্তিবাহিনীর উসকানিতেই কিছু সাধারণ মানুষ দেশত্যাগ করেছে। পূর্ব পাকিস্তানের নিরাপত্তা ফিরিয়ে আনতে ও জীবনযাত্রা দ্রুত স্বাভাবিক করতে সামরিক বাহিনী দৃঢ় হস্তে কাজ চালিয়ে যাচ্ছে।
এ সময় তিনি দেশের মানুষকে নিজ নিজ কর্মস্থলে পূর্ণ মনোযোগ দিতে আহ্বান জানান।
২১ মে পাকিস্তান পিপলস পার্টির প্রধান জুলফিকার আলী ভুট্টো সাংবাদিকদের বলেন, দেশের রাজনৈতিক ও অর্থনৈতিক পরিস্থিতি নিয়ে আগের দিন ইয়াহিয়ার সঙ্গে তার আলোচনা হয়েছে। তার দৃঢ় ধারণা, দেশের বর্তমান সমস্যা সমাধানের একমাত্র পথ জনপ্রতিনিধিদের হাতে ক্ষমতা হস্তান্তর। যারা মনে করেন পাকিস্তানের দুই অংশেই একসঙ্গে জনপ্রতিনিধিদের হাতে ক্ষমতা হস্তান্তর করা উচিত, তিনি তাদের সঙ্গে একমত নন।
এই দিনে পিপলস পার্টির সহসভাপতি মাহমুদ আলী কাসুরি তার বক্তব্যে বলেন, যারা পূর্ব পাকিস্তানে বিদ্রোহ করছে এবং অস্থিতিশীল পরিস্থিতির সৃষ্টি করছে তাদের বাদ দিয়ে বাকিরা এখনো জাতীয় পরিষদের সদস্য হিসেবে নিয়োজিত আছেন। ক্ষমতার পালাবদল কেবল আমাদের কেন্দ্র থেকেই নির্ধারিত হবে। আর পূর্ব পাকিস্তান থেকে নির্বাচিত জনপ্রতিনিধিরা জাতীয় পরিষদ ও প্রাদেশিক পরিষদের সদস্য।
ভারতে মুক্তিযুদ্ধের এই দিন
২১ মে বাংলাদেশ থেকে ভারতের পশ্চিমবঙ্গে পাড়ি দেওয়া স্কুল, কলেজ ও বিশ্ববিদ্যালয় শিক্ষকেরা কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ের আশুতোষ হলে বৈঠকে বসে বাংলাদেশ শিক্ষক সমিতি নামে একটি সংগঠন গঠন করেন। এর সভাপতি করা হয় চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্য ড. এ আর মল্লিককে। এই সমিতি তাদের লক্ষ্য হিসেবে বাংলাদেশ থেকে আগত বিভিন্ন পর্যায়ের শিক্ষকদের একত্র করে মুক্তিযুদ্ধকে সাহায্য করা এবং জনমত গড়ে তোলাসহ শরণার্থী শিক্ষকদের সাময়িক পুনর্বাসনের ব্যবস্থা করার কথা বলে। প্রায় ৩০০ থেকে ৩৫০ শিক্ষক এই দিন উপস্থিত ছিলেন।
২১ মে ভারতের সর্বদয় নেতা জয়প্রকাশ নারায়ণ যুগোস্লাভিয়ার রাষ্ট্রপতি মার্শাল টিটোর সঙ্গে দেখা করে বাংলাদেশের প্রকৃত অবস্থা তুলে ধরেন। তিনি এ সময় মার্শাল টিটোকে অনুরোধ করেন, তার সরকার কর্তৃক পাকিস্তানের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নিতে।
ভারতে নিযুক্ত বাংলাদেশের কূটনৈতিক মিশনের প্রধান হোসেন আলী কলকাতায় এক সংবর্ধনা অনুষ্ঠানে বলেন, জাতিসংঘের মহাসচিব উ থান্ট কর্তৃক শরণার্থীদের জন্য মানবিক আবেদনই প্রমাণ করে কতোটা বিপর্যস্ত এখন বাংলাদেশ। বাংলাদেশের স্বাধীনতা আদায়ে তিনি বিশ্ব সম্প্রদায়ের প্রতি আবেদন জানান। তিনি তার বক্তব্যে স্পষ্টভাষায় উল্লেখ করেন, বাংলাদেশ স্বাধীন হলেই শরণার্থীরা বাংলাদেশে ফিরে যাবেন।
শরণার্থীদের জন্য ব্রিটিশ সাহায্য ঘোষণা
২১ মে ব্রিটিশ সরকার ভারতে আশ্রয় নেওয়া পূর্ব বাংলার শরণার্থীদের জন্য এক কোটি ৮০ লাখ ভারতীয় মুদ্রার সমপরিমাণ সাহায্যের ঘোষণা দেয়। দেশটির পররাষ্ট্র দপ্তরের এক মুখপাত্র বলেন, জাতিসংঘ মহাসচিব গত বুধবার যে আবেদন জানিয়েছিলেন, তাতে সাড়া দিয়ে এই সাহায্য দেওয়া হয়েছে।
জাতিসংঘে ভারত ও পাকিস্তানের স্থায়ী প্রতিনিধির বক্তব্য
২১ মে জাতিসংঘে ভারতের স্থায়ী প্রতিনিধি সমর সেন এক বক্তব্যে বলেন, ভারতে আশ্রয় নেওয়া পূর্ববঙ্গ থেকে আগত শরণার্থীদের জন্য জরুরিভিত্তিতে সহায়তা এখন ভীষণ প্রয়োজন। এ সময় তিনি আরও বলেন, শরণার্থীদের অবস্থা এখন শোচনীয়। ভারত সরকার নিজের সাধ্যমত সাহায্য করলেও দিনে দিনে শরণার্থীর সংখ্যা বাড়ছে। যা ভারতের জন্য ভয়াবহ অবস্থার সৃষ্টি করেছে। বিশ্ব সম্প্রদায়ের উচিৎ শরণার্থীদের দিকে এগিয়ে আসা। পাকিস্তানের ওপর ক্রমাগত চাপ সৃষ্টি করা। শরণার্থীদের দেশে ফেরত যাওয়ার জন্য অনুকূল অবস্থার সৃষ্টি করা।
অন্যদিকে বৈঠকে দেওয়া বক্তব্যে জাতিসংঘে পাকিস্তানের স্থায়ী প্রতিনিধি আগা শাহী তার বক্তব্যে স্বীকার করেন, পূর্ব পাকিস্তান থেকে বহু মানুষ দেশত্যাগ করে ভারতে আশ্রয় নিয়েছেন। তিনি তার বক্তব্যে স্পষ্ট করেন যে, দেশত্যাগকারী মানুষদের ফিরিয়ে নিতে তার সরকার বিশেষ ঘোষণাও দিয়েছে। তিনি বলেন, পূর্ব পাকিস্তানে কিছু মানবতাবিরোধী অপরাধ সংগঠিত হয়েছে। তিনি একই সঙ্গে ভারত ও মুক্তিবাহিনী বিরুদ্ধে দেশের সার্বভৌমত্বে আঘাতের প্রসঙ্গ তোলেন।
ডাকরা গণহত্যা
২১ মে শুক্রবার বাগেরহাটে রামপালের পেড়িখালি ইউনিয়নের ডাকরায় এক নির্মম গণহত্যা চালায় রাজাকারেরা। এই পৈশাচিক ও নিষ্ঠুর গণহত্যায় শহীদ হন ৬৪৬ জন হিন্দু ধর্মাবলম্বী নিরীহ ভক্ত ও গ্রামবাসী। গণহত্যার পর বেশ কয়েকজন তরুণীকে অপহরণ করা হয়।
মে মাসের ১১ তারিখ থেকে ডাকরা ও পেড়িখালি ইউনিয়নের হিন্দু ধর্মাবলম্বীরা দেশত্যাগ করতে শুরু করলে ডাকরা গ্রামের কালীবাড়ির প্রধান সেবায়েত বাদলচন্দ্র চক্রবর্তী ভক্তদের এখনই যেতে নিষেধ করেন। এরপর সবাই মিলে সিদ্ধান্ত নেন ২২ মে সুন্দরবনের ভেতর দিয়ে ভারতে যাওয়ার। ডাকরা গ্রামের কালীবাড়ি ছিল হিন্দু ধর্মাবলম্বীদের কাছে পরম পূজনীয় স্থান এবং সেবায়েত বাদলচন্দ্র চক্রবর্তীকে সবাই ভীষণ শ্রদ্ধা ও সম্মান করতেন।
আগের সিদ্ধান্ত অনুযায়ী ২২ মের কয়েক দিন আগ থেকে পার্শ্ববর্তী গ্রামগুলোর অসংখ্য হিন্দু পরিবার ডাকরা কালীবাড়ির আশেপাশে মংলা নদী, মাদারতলা নদী ও কুমারখালী খালের তীরে শতাধিক নৌকায় অবস্থান নেয়। ২১ তারিখের মধ্যে ডাকরা কালীবাড়ি ও চারপাশে জায়গা হয়ে উঠে অনেকটা ছোট শরণার্থী শিবিরের মতো। ডাকরা গ্রামের ইনাম আলী শেখ, জোনাব আলী শেখ ও দেলোয়ার হোসেন উপস্থিত হিন্দু ধর্মাবলম্বীদের পূর্ণ নিরাপত্তার আশ্বাস দেন। বাঁশতলী গ্রামের শান্তি কমিটির সদস্য আফসার উদ্দিনও এ সময়ে পাকিস্তানি বাহিনী কোনো সমস্যা করবে না বলে আশ্বাস দিয়েছিলেন।
এ দিকে তারাই হিন্দু ধর্মাবলম্বী এই মানুষদের হত্যার জন্য এক মেডিকেল ছাত্রের মাধ্যমে বাগেরহাটের রাজাকার কমান্ডার রজ্জব আলী ফকিরের কাছে একটি চিঠি পাঠান।
২১ মে দুপুর ১টার দিকে রাজাকার রজ্জব আলী ফকিরের নেতৃত্বে রাজাকারের একটি দল বড় দুটি ছিপওয়ালা নৌকায় ডাকারে পৌঁছে। প্রতিটি নৌকায় ছিল ১৫ থেকে ২০ জন রাজাকার। রাজাকারদের প্রথম নৌকাটি কালীগঞ্জ বাজার অতিক্রম করে মাদারতলী খালের দিকে অগ্রসর হয়। দ্বিতীয় নৌকা কুমারখালী খাল বরাবর অগ্রসর হয় এবং তারপর মাদারতলী বরাবর চলে আসে।
দ্বিতীয় নৌকা থেকে রাজাকাররা নেমেই ভিড়ের মধ্যে নির্বিচারে গুলি চালাতে শুরু করে। ইতোমধ্যে প্রথম নৌকা থেকেও রাজাকাররা নিচে নেমে কালী মন্দিরের দিকে এগিয়ে ভিড়ের মধ্যে নির্বিচারে গুলি চালায়। এ সময় বৃষ্টির মতো দুদিক থেকে গুলির শব্দ শুনে নৌকা ও তীরে অবস্থানরত নিরীহ মানুষ দিশেহারা হয়ে পড়েন। প্রাণ বাঁচাতে তারা হিতাহিত জ্ঞান হারিয়ে ছুটতে থাকেন। দুদিক থেকে গুলিবিদ্ধ হয়ে বহু মানুষ মারা যান। যারা গুলিবিদ্ধ হয়ে বেঁচে ছিলেন, তাদেরকে জবাই করে হত্যা করে রাজাকারেরা।
অনেকে কালীবাড়িতে তাদের গুরুর কাছে হাজির হন। এ সময়ে রাজাকারেরাও দুদিক থেকে গুলি চালাতে চালতে কালীবাড়িতে এসে হাজির হয়। এ সময় সেখানে উপস্থিত নারী ও পুরুষদের আলাদা করা হয়। এরপর আরও পুরুষ আছে কি না তা পরীক্ষা করার জন্য কয়েকজন রাজাকার ঘরের ভেতরে ঢুকে শাড়ি পরা অবস্থায় কয়েকজন পুরুষকে খুঁজে পায়। তাদের টেনে হিঁচড়ে বাইরে এনে মন্দির চত্বরে লাইন ধরে ব্রাশফায়ার করে হত্যা করে।
বেলা ১টা থেকে শুরু হওয়া এই পৈশাচিক গণহত্যা থামে দুপুর ৩টায়। এ সময়ে কয়েকজন তরুণীকে রজ্জব আলীর নৌকায় তুলে নেয় রাজাকারেরা। স্থানীয় রাজাকারদের সঙ্গে নিয়ে রজ্জব আলী বাগেরহাটে ফিরে যান।
২১ মে ব্রাহ্মণবাড়িয়ার শালদা নদীতে পাকিস্তানি হানাদার বাহিনীর খাদ্য ও রসদবাহী একটি রেলওয়ে ট্রলির ওপর মুক্তিযোদ্ধারা অতর্কিত গেরিলা আক্রমণ চালায়।
২১ মে মুক্তিবাহিনীর একটি দল কুমিল্লার দেবীদ্বার থানায় আক্রমণ চালায়। এ সময় পুলিশের বেশ কয়েকজন সদস্য হতাহত হয়। মুক্তিযোদ্ধারা এ সময় থানা দখল না করে অস্ত্র নিয়ে চলে যান।
২১ মে কুমিল্লার দক্ষিণে গৌরীপুরে মুক্তিবাহিনী পাকিস্তান হানাদারদের একটি দলের ওপর অতর্কিত হামলা চালালে হানাদারদের নয় জন সৈন্য নিহত হয় এবং বেশ কয়েকজন আহত হয়।
সূত্র- বাংলাদেশের স্বাধীনতা যুদ্ধের দলিলপত্র সপ্তম, অষ্টম, নবম, ত্রয়োদশ ও চতুর্দশ খণ্ড
দৈনিক পাকিস্তান, ২২ মে ১৯৭১
দৈনিক অমৃতবাজার পত্রিকা, ২২ মে ১৯৭১
ডাকরা গণহত্যা- বিষ্ণুপদ বাগচী
১৯৭১ গণহত্যা- নির্যাতন আর্কাইভ ও জাদুঘর
আহমাদ ইশতিয়াক, [email protected]
Comments