জাতীয় নাক কান গলা ইনস্টিটিউট

হাসপাতাল ধুঁকছে, রোগীরা ভুগছে

প্রয়োজনীয় জনবলের অভাবে জাতীয় নাক কান গলা ইনস্টিটিউটের নিবিড় পরিচর্যা কেন্দ্রটি (আইসিইউ) কয়েক বছরেও চালু করা যায়নি। ফলে এখানে চিকিৎসা নিতে আসা রোগীরা দিনের পর দিন আইসিইউ সেবা থেকে বঞ্চিত হচ্ছেন।
National ENT Institute.jpg
জাতীয় নাক কান গলা ইনস্টিটিউট। ছবি: সংগৃহীত

প্রয়োজনীয় জনবলের অভাবে জাতীয় নাক কান গলা ইনস্টিটিউটের নিবিড় পরিচর্যা কেন্দ্রটি (আইসিইউ) কয়েক বছরেও চালু করা যায়নি। ফলে এখানে চিকিৎসা নিতে আসা রোগীরা দিনের পর দিন আইসিইউ সেবা থেকে বঞ্চিত হচ্ছেন।

অন্যদিকে, আইসিইউ’র জন্য অতি প্রয়োজনীয় ব্যয়বহুল আর্টিফিশিয়াল রেসপিরেটরি ভেন্টিলেটর (এআরভি) যন্ত্রগুলোও প্রায় দুই বছর ধরে অব্যবহৃত অবস্থায় পড়ে আছে।

বিশেষায়িত এই হাসপাতালের স্টোররুমে পড়ে থাকা ধূলামলিন আটটি এআরভি যন্ত্রসহ আনুষঙ্গিক যন্ত্রপাতি ও অচল আইসিইউ’র বিষয়টি গত বছরের মার্চে পরিকল্পনা কমিশনের বাস্তবায়ন, পরিবীক্ষণ ও মূল্যায়ন বিভাগের (আইএমইডি) এক প্রতিবেদনে উঠে আসে।

ওই প্রতিবেদনে বলা হয়, জটিল অপারেশনের পর অনেক গুরুতর রোগীর জন্য আইসিইউ’র দরকার হয়। কিন্তু রোগীরা এই হাসপাতালে সেবাটি পাচ্ছেন না।

এ ছাড়া, প্রতিবেদনে হাসপাতালের একটি বায়োকেমিস্ট্রি সেমি অটো এনালাইজার, এলিজা অটো ওয়াসার, এলিজা প্লেট ইনকিউবেটর, আটটি আইসিইউ ভেন্টিলেটর, একটি করে সিওটু লেজার ও ডিওডি লেজার মেশিন এবং এক ইউনিট স্লিপ ল্যাব যন্ত্রপাতি অচল পড়ে থাকার কথাও বলা হয়।

আইএমইডি’র ওই প্রতিবেদন প্রকাশের পর কেটে গেছে এক বছরেরও বেশি সময়। খোঁজ নিয়ে জানা গেছে, এখনো রাজধানীর তেজগাঁও এলাকায় অবস্থিত এই হাসপাতালটির অবস্থার তেমন কোনো পরিবর্তন হয়নি।

‘এস্টাবলিস্টমেন্ট অব ন্যাশনাল ইনস্টিটিউট অব ইএনটি ফার্স্ট ফেজ ইন ঢাকা’ শীর্ষক প্রকল্পের আওতায় ৬২ কোটি ৪১ লাখ টাকা ব্যয়ে আধুনিক যন্ত্রপাতি সম্বলিত নাক কান গলার জন্য বিশেষায়িত দেশের একমাত্র এই হাসপাতালটি গড়ে তুলে সরকার।

২০১৪ সালে প্রকল্পটি আনুষ্ঠানিকভাবে শেষ হলেও হাসপাতালে বেশিরভাগ যন্ত্রপাতি পৌঁছায় ২০১৮ সালে।

আইএমইডি’র প্রতিবেদনে বলা হয়, তখন থেকেই আটটি দামী এআরভি যন্ত্র হাসপাতালের স্টোররুমে পড়ে ছিল। আর এ সময়ের মধ্যে হাসপাতালের অনেক যন্ত্রপাতি নষ্ট হয়ে যায়।

হাসপাতাল সূত্রে জানা যায়, প্রয়োজনীয় মেরামতের পর গত বছরের এপ্রিল মাসে ছয়টি এআরভি মেশিন করোনা আক্রান্ত রোগীদের জন্য যশোর জেনারেল হাসপাতালে পাঠানো হয়েছে।

সরেজমিন পরিদর্শনের পর গত বছরের মার্চে আইএমইডি’র প্রতিবেদনে বলা হয়, লোকবল সংকটের কারণে আইসিইউটি এখন পর্যন্ত চালু হয়নি।

প্রতিবেদনে একইসঙ্গে হাসপাতালের যন্ত্রপাতিগুলো যথাসময়ে সরবরাহ ও তা স্থাপনে ব্যর্থতার জন্য এর ক্রয় প্রক্রিয়ার সঙ্গে যুক্ত কেন্দ্রীয় ঔষধাগারকে (সিএমএসডি) দায়ী করা হয়।

প্রতিবেদনে দেওয়া তথ্য অনুসারে, প্রতিটি এআরভি যন্ত্র কেনা হয়েছিল ৭০ লাখ টাকা করে। যা একবারের জন্যও ব্যবহার করা হয়নি।

ট্রান্সপারেন্সি ইন্টারন্যাশনাল বাংলাদেশ’র নির্বাহী পরিচালক ড. ইফতেখারুজ্জামানের অভিমত, বিষয়টি দুর্নীতি ও অনিয়মের নানামুখী চিত্রকেই তুলে ধরেছে।

ড. ইফতেখারুজ্জামান দ্য ডেইলি স্টারকে বলেন, ‘সুস্পষ্টভাবেই এখানে যথাযথ পরিকল্পনার অভাব ছিল। তার চেয়ে গুরুত্বপূর্ণ হচ্ছে, দায়বদ্ধতার অভাবও ছিল তীব্র। বিষয়টি প্রকল্প বাস্তবায়নে ক্রয় প্রক্রিয়ার ক্ষেত্রে সরবরাহকারীদের সঙ্গে সম্পর্কের ভিত্তিতে অবৈধভাবে বিপুল মুনাফা অর্জনের বিষয়টিকেও সামনে এনেছে।’

এ বিষয়ে স্বাস্থ্যসেবা বিভাগের পরিচালক (হাসপাতাল ও ক্লিনিক) ডা. ফরিদ হোসেন মিয়া বলেন, ‘জাতীয় নাক কান গলা ইনস্টিটিউটকে একটা পূর্ণাঙ্গ প্রতিষ্ঠান হিসেবে গড়ে তুলতেই যন্ত্রপাতিগুলো কেনা হয়েছিল।’  

গত বুধবার ফরিদ হোসেন দ্য ডেইলি স্টারকে বলেন, ‘সম্ভবত ওগুলোর (যন্ত্রপাতি) প্রয়োজন হয়নি। তাই ব্যবহার করা হয়নি। কিন্তু কেউ বলতে পারবে না যে এটা সরকারি টাকার অপচয়।’

এই বক্তব্যের পরিপ্রেক্ষিতে টিআইবির ইফতেখারুজ্জামান বলেন, ‘এই বক্তব্য ন্যুনতম দায়িত্বশীলতার অভাবকেই প্রকট করে তুলেছে। যা ঘটছে অভ্যন্তরীণ নিয়ন্ত্রণ ও জবাবদিহিতা না থাকার সুযোগে।’

উদাহরণ তৈরির জন্য সরকারি সম্পদের এমন নিদারুণ অপচয়ের সঙ্গে জড়িতদের বিচারের দাবি জানান টিআইবির নির্বাহী পরিচালক। তার মতে, এটা না হলে এমন ঘটনা আরও ঘটতে থাকবে।

হাসপাতালটিতে একইসঙ্গে ক্যান্সার রোগীদের জন্য রেডিওথেরাপি ও কেমোথেরাপির সুযোগ থাকা জরুরি।

আইএমইডি’র প্রতিবেদন বলছে, হাসপাতালটিতে অস্ত্রোপচার হওয়া রোগীদের পরিসংখ্যান অনুসারে এর ৫৬ শতাংশই ক্যান্সারের রোগী। অনেক ক্ষেত্রে অস্ত্রোপচারের আগে ও পরে এসব রোগীদের রেডিওথেরাপির দরকার হয়।

২০১৩ সালের ১৯ জুন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা হাসপাতালটি উদ্বোধন করেন। ঢেলে সাজানোর আগে এটি ১০০ শয্যার একটি হাসপাতাল হিসেবে চালু হয়েছিল।

নাক কান গলার চিকিৎসার জন্য এই হাসপাতালটি এখন রোগীদের একটি পছন্দের ঠিকানা। প্রতিদিন এর বহির্বিভাগে অন্তত ৫০০ থেকে ৬০০ রোগী চিকিৎসা নেন। কর্তৃপক্ষের ভাষ্য অনুসারে, হাসপাতালটির ১৩৫ শয্যার ইনডোর ইউনিটে ভর্তি রোগীর হার ১০০ শতাংশ।

লোকবল নিয়োগের আবেদন উপেক্ষিত

নাক কান গলা ইনস্টিটিউটের পরিচালক ও অধ্যক্ষ ডা. মোহাম্মদ আবু হানিফ বলেন, ‘প্রয়োজনীয় লোকবলের অভাবে যন্ত্রপাতি ও ইউনিট পরিচালনার পাশাপাশি  রোগীরাও দুর্ভোগ পোহাচ্ছেন। আইসিইউ পরিচালনার জন্য চিকিৎসক ও নার্স চেয়ে গত পাঁচ বছরে স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয়ে অনেকগুলো চিঠি পাঠানো হয়েছে।’

২০২০ সালের ১২ জানুয়ারি হাসপাতাল কর্তৃপক্ষ অ্যানেসথেসিয়া বিভাগের শূন্য পদে একজন সহযোগী অধ্যাপক ও তিন জন জুনিয়র কনসালটেন্ট নিয়োগের জন্য মন্ত্রণালয়ের অধীন স্বাস্থ্যসেবা বিভাগের সচিব বরাবর চিঠি পাঠায়। চিঠিতে একইসঙ্গে আট জন মেডিকেল অফিসার/কনসালটেন্ট নিয়োগের আবেদনও জানানো হয়।

একইদিনে আইসিইউ চালুর জন্য আট জন সিনিয়র স্টাফ নার্স চেয়ে নার্সিং অ্যান্ড মিডওয়াইফারি অধিদপ্তরের মহাপরিচালক বরাবরও একটা চিঠি পাঠায় হাসপাতাল কর্তৃপক্ষ।

এর আগে, ২০১৬ সালে নাক কান গলা ইনস্টিটিউট আইসিইউ চালুর জন্য অ্যানেসথেসিস্ট ও নার্স চেয়ে স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয়ের সচিবকে দুটি পৃথক চিঠি লেখে।

ওই বছরের ৩ এপ্রিল পাঠানো চিঠিতে স্বাক্ষর করেন ইনস্টিটিউটের তৎকালীন পরিচালক অধ্যাপক ডা. মাহমুদুল হাসান। তিনি বলেন, ‘প্রয়োজনীয় সংখ্যক অ্যানেসথেসিস্ট ও প্রশিক্ষিত নার্সের অভাবে আইসিইউ সেবা চালুর জন্য হাসপাতাল কর্তৃপক্ষ বিপত্তির মুখে পড়ছে।’

একইসঙ্গে ওই চিঠিতে জরুরিভিত্তিতে রোগীদের চিকিৎসার জন্য শূন্য পদের বিপরীতে একজন সহযোগী অধ্যাপক (অ্যানেসথিওলজি) ও কিছু অ্যানেসথেসিস্ট/নার্স নিয়োগের আবেদন জানানো হয়।

৩ নভেম্বর পাঠানো আরেক চিঠিতে অধ্যাপক মাহমুদুল হাসান একজন সুপারিন্টেনডেন্ট, দুজন ডেপুটি সুপারিন্টেনডেন্ট এবং ১০ জন নার্সিং সুপারভাইজারসহ ২৩ জন নার্স নিয়োগের আবেদন জানান।

কিন্তু এখন পর্যন্ত নিয়োগের বিষয়টি উপেক্ষিতই থেকে গেছে।

জানতে চাইলে হাসপাতালের বর্তমান পরিচালক আবু হানিফ বলেন, ‘আমরা এখন পর্যন্ত কোনো নার্স কিংবা অ্যানেসথেসিস্টের নিয়োগ পাইনি।’

তিনি জানান, অ্যানেসথেসিয়া বিভাগের সহযোগিতা নিয়ে ২০১৯ সালের ফেব্রুয়ারিতে তিনি একবার সীমিত পরিসরে আইসিইউ চালুর চেষ্টা করেছিলেন। তখন তিনি জানতে পারেন যে, সবগুলো এআরভি যন্ত্র ঠিক নেই।

আর রেডিওথেরাপি বিভাগের প্রয়োজনীয়তা সম্পর্কে জানতে চাইলে আবু হানিক বলেন, এ বিষয়েও যথাযথ কর্তৃপক্ষকে চিঠি দেওয়া হয়েছে।

প্রতিবেদনটি ইংরেজি থেকে অনুবাদ করেছেন মামুনুর রশীদ

Comments

The Daily Star  | English
Detained opposition activists

The flipside of the democracy carnival

Bereft of the basic rights to assemble and express, let alone protest, the people of Bangladesh are currently bearing the brunt of the coercive apparatuses of the state.

10h ago