মহামারিতে তথ্য ও সহযোগিতার অভাবে জাপানি বিনিয়োগ বৃদ্ধিতে বাধা

করোনাভাইরাস মহামারির সময়ে জাপান থেকে বাংলাদেশে বিনিয়োগের প্রবাহ কমে যাওয়ার আশঙ্কা তৈরি হয়েছে। বিনিয়োগ বাধাগ্রস্ত হওয়ার জন্য বাংলাদেশি সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষের কাছ থেকে যথাযথ তথ্য ও সহযোগিতার অভাব সহ বেশ কিছু চ্যালেঞ্জকে দায়ী বলে মনে করা হচ্ছে। বিনিয়োগকারীদের ভাষ্য এবং একটি সাম্প্রতিক সমীক্ষা থেকে এসব প্রতিবন্ধকতার কথা উঠে এসেছে।

এছাড়াও, সরকারি অফিসগুলোতে অহেতুক বিলম্ব ও বারবার নীতিমালা পরিবর্তনের বিড়ম্বনা জাপানি বিনিয়োগকারীদেরকে বাংলাদেশে ব্যবসা চালু করার ক্ষেত্রে নিরুৎসাহিত করে।

ডিসেম্বর ২০১৯ পর্যন্ত পাওয়া তথ্যে জানা যায়, জাপানের প্রায় ৩১০টি প্রতিষ্ঠান বাংলাদেশে ব্যবসায়িক কার্যক্রম পরিচালনা করছে, যাদের সম্মিলিত বিনিয়োগের পরিমাণ ৩৮৬ মিলিয়ন মার্কিন ডলারের কাছাকাছি। এক দশক আগেও দেশে মাত্র ৮২টি জাপানি প্রতিষ্ঠান কার্যক্রম চালাচ্ছিল।

বাংলাদেশ ব্যাংক ও বাংলাদেশ বিনিয়োগ উন্নয়ন কর্তৃপক্ষের (বিডা) কাছে জাপান থেকে আসা সরাসরি বৈদেশিক বিনিয়োগের (এফডিআই) পরিমাণের হালনাগাদ তথ্য নেই।

জাপান সরকারের বৈদেশিক বাণিজ্য সংস্থা জাপান এক্সটারনাল ট্রেড অর্গানাইজেশন (জেট্রো) সম্প্রতি মহামারির মাঝে কার্যক্রম পরিচালনার ক্ষেত্রে সবচেয়ে বড় চ্যালেঞ্জগুলোর জানার জন্য তাদের দেশের ৭৫টি প্রতিষ্ঠানের ওপর সমীক্ষা চালিয়েছে।

সমীক্ষার ফলাফলে দেখা গিয়েছে যে ৬৭ শতাংশ জাপানি প্রতিষ্ঠান বাণিজ্যিক ফ্লাইট স্থগিত হওয়া কিংবা ফ্লাইটের সংখ্যা কমে যাওয়ার কারণে আর ৬৪ শতাংশ প্রতিষ্ঠান বাংলাদেশে আসার পর ১৪ দিনের বাধ্যতামূলক কোয়ারেন্টিন থাকার ব্যাপারটি নিয়ে সমস্যায় ভুগছে।

৬৩ শতাংশ প্রতিষ্ঠান করোনাভাইরাসের সংক্রমণ প্রতিরোধের ক্ষেত্রে সমস্যায় ভুগেছে, ৬১ শতাংশ প্রতিষ্ঠান সংক্রমণ পরবর্তী সমস্যায় (চিকিৎসা ব্যবস্থা এবং হাসপাতালে শয্যার প্রাপ্যতা) ভুগেছে এবং ৬১ শতাংশ প্রতিষ্ঠান দেশে ব্যবসায়িক ভিসার মাধ্যমে দেশের বাইরে থেকে কর্মী ও কারিগরি প্রশিক্ষকদের বাংলাদেশে নিয়ে আসতে সমস্যার মুখে পড়েছে।

৬০ শতাংশ প্রতিষ্ঠান বলেছে যে তারা বাংলাদেশের বাইরে ভ্রমণ করার ক্ষেত্রে ভোগান্তিতে পড়েছে এবং ৫৭ শতাংশ জানিয়েছে জাপান থেকে আসা বিদেশি কর্মীদের টিকার ব্যবস্থা করতে তারা সমস্যায় পড়েছে।

সমীক্ষায় অংশগ্রহণকারী প্রতিষ্ঠানগুলোর অর্ধেকই জানিয়েছে যে তারা সরকারের কাছ থেকে বৈদেশিক ভ্রমণ ও ব্যাবসায়িক কার্যক্রম পরিচালনা সংক্রান্ত নীতিমালার হালনাগাদ তথ্য জানতে গিয়ে জটিলতায় পড়েছে।

৩১ শতাংশ প্রতিষ্ঠান আমদানি ও রপ্তানির ক্ষেত্রে বিলম্ব, ২৪ শতাংশ প্রতিষ্ঠান অর্ডার বাতিল ও কমে যাওয়ার সমস্যা, ৯ শতাংশ ওয়ার্কিং ক্যাপিটালের স্বল্পতা এবং ৮ শতাংশ তামাদি হয়ে যাওয়া লেটার অফ ক্রেডিটের নিষ্পত্তির ক্ষেত্রে ঝামেলার কথা উল্লেখ করেছে।

রোহতো-মেনথোল্যাটাম (বাংলাদেশ) এর ব্যবস্থাপনা পরিচালক প্রদীপ দাস বলেন, ‘বাংলাদেশে ব্যবসা করতে আসা জাপানি প্রতিষ্ঠানগুলো শুরুতে তাদের নিজ ব্যবসার ক্ষেত্রগুলোতে সঠিক তথ্যের অভাবে চ্যালেঞ্জের মুখে পড়ে।’

বিনিয়োগকারীরা সরকারি অফিস কিংবা বেসরকারি কনসালটেন্সি প্রতিষ্ঠানগুলো থেকে সঠিক তথ্য পায় না এবং বিভিন্ন ব্যবসায়িক প্রতিষ্ঠান ও সম্ভাব্য অংশীদারদের সঙ্গে যোগাযোগ স্থাপন করিয়ে দেওয়ার মতো বেসরকারি প্রতিষ্ঠানও নেই দেশে, জানান তিনি।

তিনি বলেন, ব্যবসা শুরু করার জন্য সকল পর্যায়ের শ্রমিক ও কর্মী খুঁজে পাওয়া গেলেও এর ব্যবস্থাপনার কাজ চালানোর জন্য যোগ্য কর্মী পেতে সমস্যায় পড়তে হয়।

প্রদীপ বলেন, তারা এমনকি ব্যাংকিং সংক্রান্ত তথ্য, সিএন্ডএফ এজেন্ট ও পরিবেশকদের তালিকাও পান না, যদিও এর প্রতিটিই ব্যবসা পরিচালনার জন্য অত্যাবশক তথ্য।

আয়কর জমা দেওয়া ও মূল্য সংযোজন করের (ভ্যাট) হিসাব করার জন্য জাপানি প্রতিষ্ঠানগুলোকে আমলাতান্ত্রিক জটিলতা ও বেশ কঠিন কিছু নিয়ম কানুনের মধ্য দিয়ে যেতে হয় এবং অনেক ধরনের কাগজপত্র জমা দিতে হয়। 

প্রদীপ বলেন, ‘জাপানি প্রতিষ্ঠানগুলো নিষ্ঠার সঙ্গে নীতিমালাগুলো মেনে চলে এবং তারা প্রতিটি ধাপে স্বচ্ছতা প্রত্যাশা করে।’ 

তিনি বিশ্বাস করেন যে সমগ্র প্রক্রিয়াটিকে আরও উন্নত করার সুযোগ রয়েছে, যা আরও নতুন জাপানি বিনিয়োগকারীদেরকে আকৃষ্ট করবে।

বাংলাদেশে ব্যবসায়িক কার্যক্রম শুরু করার প্রক্রিয়াকে উন্নত এবং পরিচালনা করার প্রক্রিয়াকে আরও মসৃণ করার প্রয়োজনীয়তার কথা বলেন বাংলাদেশ হোন্ডা প্রাইভেট লিমিটেড (বিএইচএল)-এর ফাইন্যান্স এবং কমার্শিয়াল বিভাগের প্রধান শাহ মুহাম্মদ আশেকুর রহমান।

তিনি বলেন, ‘আমরা যদি কার্যক্রম পরিচালনা করার ক্ষেত্রে ন্যুনতম লিড টাইম বজায় রাখতে পারি আর আমদানি পণ্য দ্রুত খালাসের ব্যবস্থা করতে পারি, তাহলে ব্যবসা করার খরচ, মূলধন যন্ত্রপাতি ও কাঁচামালের খরচ, ইত্যাদি প্রতিযোগিতামূলক পর্যায়ে থাকবে।’ 

আইশিন ইন্টারন্যাশনালের ব্যবস্থাপনা পরিচালক হিরোকি ওয়াতানাবে বলেন, ‘জাপানি প্রতিষ্ঠানগুলো তাদের নিজ দেশে লভ্যাংশ ফিরিয়ে নিয়ে যাওয়ার ক্ষেত্রে হয়রানির শিকার হন।’ 

তিনি বলেন, ‘বাংলাদেশে বিনিয়োগ করা খুব সহজ হলেও, নিজের দেশে লভ্যাংশ ফিরিয়ে নিয়ে যাওয়ার প্রক্রিয়াটি খুবই কঠিন, যা বিনিয়োগের জন্য ক্ষতিকর।’

লভ্যাংশ স্থানান্তরের ক্ষেত্রে প্রতিষ্ঠানগুলোকে অনেক ধরনের আনুষ্ঠানিকতার মধ্য দিয়ে যেতে হয়, যাতে অনেক সময় ব্যয় হয়। তিনি বলেন, ‘সরকারের উচিত এই ব্যাপারটিতে নজর দেওয়া।’  

এছাড়াও, বিনিয়োগকারীদের ভিসা ও ওয়ার্ক পারমিট পাওয়ার ক্ষেত্রেও অনেক জটিলতার মুখোমুখি হতে হয় এবং প্রায়ই তাদেরকে অনেক লম্বা সময় ধরে অপেক্ষায় থাকতে হয়, জানান ওয়াতানাবে।

বিডা'র নির্বাহী চেয়ারম্যান মো. সিরাজুল ইসলাম বলেন, বিডা'র ওয়ান-স্টপ সেবা প্ল্যাটফর্মের মাধ্যমে ভিসার আবেদন করলে বিনিয়োগকারী এবং বিদেশি বিশেষজ্ঞরা কোনো ধরনের হয়রানির শিকার হন না। 

প্রয়োজনীয় তথ্যের অপ্রতুলতার দাবিকে নাকচ করে দিয়ে দিয়ে তিনি বলেন, বিডা বিনিয়োগ সংক্রান্ত সব ধরনের তথ্য দিয়ে থাকে।

বাংলাদেশ ইকোনোমিক জোন অথরিটির (বেজা) চেয়ারম্যান পবন চৌধুরী বলেন বাংলাদেশে ব্যবসা করার পরিবেশের উন্নয়ন করার সুযোগ রয়েছে এবং কিছু নিয়ম ও নীতিমালাকে শিথিল করলে তা আরও বেশি এফডিআই আকৃষ্ট করবে।

তিনি বলেন, বাংলাদেশ ব্যাংক, জাতীয় রাজস্ব বোর্ড এবং বাণিজ্য মন্ত্রণালয় ইতোমধ্যেই বিনিয়োগের নীতিমালা শিথিল করে কিছু প্রজ্ঞাপন জারি করেছে।

‘তবে সকল বিনিয়োগকারীদের প্রত্যাশা মেটানোর জন্য আরও সময় প্রয়োজন, কারণ তারা সব সময় যেকোনো দেশে বিনিয়োগ করার ক্ষেত্রে অতিরিক্ত যত্নবান থাকেন’, বলেন তিনি।

পবন চৌধুরী জানান, বাংলাদেশ এফডিআই এর জন্য একটি আকর্ষণীয় গন্তব্যে পরিণত হচ্ছে।

তিনি বলেন, নারায়ণগঞ্জের আড়াইহাজারে ডেডিকেটেড অর্থনৈতিক অঞ্চলে প্রায় ১ দশমিক ৫ বিলিয়ন ডলারের জাপানি বিনিয়োগ হবে। আগামী বছর থেকে সেখানে কারখানা স্থাপনের কাজ শুরু হবে।

প্রতিবেদনটি ইংরেজি থেকে অনুবাদ করেছেন মোহাম্মদ ইশতিয়াক খান

 

Comments