দুর্যোগের আগে ফসল কাটতে মরিয়া চলনবিলের কৃষক
চলনবিলের পাবনার চাটমোহর উপজেলার নিমাইচরা গ্রামের কৃষক কাজেম প্রামাণিক গত বছর দুই বিঘা জমির পাকা ধান কাটার আগেই আঘাত হানে ঘূর্ণিঝড় আম্পান। এরপর শুরু হয় আগাম বন্যা। তলিয়ে যায় তার সব ধান।
আশায় বুক বাধা এই কৃষক এ বছরও ধানের আবাদ করেছেন। আবহাওয়া অনুকূলে থাকায় ধানের ফলনও হয়েছে বাম্পার। জমির ৬০ ভাগ ধান ইতোমধ্যে কাটার উপযোগী হয়েছে।
ঘূর্ণিঝড় ইয়াশ ধেয়ে আসছে উপকূলের দিকে। আঘাত হানতে পারে এ সপ্তাহেই।
আসন্ন দুর্যোগের আশংকায় কাজেম প্রামাণিক তার জমির আধপাকা ধান কেটে ঘরে তুলছেন। কারণ ঘূর্ণিঝড় ব্যাপকভাবে আঘাত হানলে জমির প্রায় পুরো ধান মাটিতে নুইয়ে পরবে। একই সঙ্গে যদি আগাম বন্যা হয় তাহলে একমুঠো ধানও ঘরে তুলতে পারবেন না তিনি।
তার মতো একই অবস্থা চলনবিলের বেশিরভাগ কৃষকের। দুর্যোগের আশংকায় ক্ষেতের কাঁচা-পাক ধান কেটে ঘরে তুলছেন চলনবিলের তিনটি জেলার আট উপজেলার কৃষক। তবে ইচ্ছা থাকলেও অনেকেই দুর্যোগের আগে ধান কাটার কাজ শুরু করতে পারছেন না পর্যাপ্ত শ্রমিকের অভাবে।
কৃষক মজিবর রহমান দ্য ডেইলি স্টারকে বলেন, ‘সাড়ে তিন বিঘা জমির মধ্যে দুই বিঘা জমির ধান কাটা এখনও বাকি। শ্রমিক না পেয়ে ধান কাটতে পারছি না।’
ধান কাটতে না পেরে দুশ্চিন্তিত মজিবর আরও বলেন, ‘এ বছর বিঘা প্রতি প্রায় ৩০ মন ধানের ফলন হয়েছে। কিন্তু দুর্যোগের আগে ধান ঘরে না তুলতে পারলে কিছুই পাব না।’
চলনবিলের পাবনা, নাটোর ও সিরাজগঞ্জের বিভিন্ন এলাকা ঘুরে কৃষকদের সঙ্গে কথা বলে জানা গেছে, ধান কাটার ভরা মৌসুমে প্রতিবছরই ধান কাটা শ্রমিক সংকটে পরে উত্তরাঞ্চলের অন্যতম প্রধান শস্যভাণ্ডার হিসেবে পরিচিত চলনবিল এলাকার কৃষক।
কৃষি বিভাগ সূত্রে জানা যায়, চলনবিলের পাবনা জেলার চাটমোহর, ভাঙ্গুরা ও ফরিদপুর উপজেলা, নাটোর জেলার গুরুদাসপুর, বরাইগ্রাম ও সিংরা উপজেলা এবং সিরাজগঞ্জের তারাশ ও রায়গঞ্জ উপজেলায় এ বছর ধানের বাম্পার ফলন হয়েছে।
এসব এলাকার কৃষি কর্মকর্তারা জানান, পাবনা, নাটোর ও সিরাজগঞ্জ জেলার আটটি উপজেলার এক দশমিক এক লাখ হেক্টর জমিতে এ বছর বোরো আবাদ করা হয়েছে। এর থেকে প্রায় চার দশমিক পাঁচ লাখ মেট্রিক টন চাল উৎপাদনের লক্ষ্যমাত্রা ধরা হলেও, এ বছর উৎপাদন চার দশমিক ৭৫ লাখ মেট্রিক টন ছাড়িয়ে যাবে।
তবে ফলনের এই সফলতা পেতে যথাসময়ে ফসল কাটতে হবে।
সরেজমিনে দেখা যায়, সিংরা ও রায়গঞ্জ উপজেলার বেশিরভাগ ধান কাটা হলেও এখনও অনেক ধান কাটা বাকি রয়েছে।
নাটোরের গুরুদাসপুর উপজেলার পিপলা গ্রামের কৃষক ফিরোজ আলী জানান, গত বছর বন্যার পানি নামার পর সরিষা আবাদ করে, তারপর ধানের আবাদ করা হয়। ফলে ধান লাগাতে কিছুটা দেরি হয়। ধান কাটা শুরু করতে আরও প্রায় দুই সপ্তাহ লাগে। তবে, প্রকৃতি কী আচরণ করবে তার ওপর নির্ভর করছে কতটা ধান এ বছর ঘরে তোলা যাবে।
গুরুদাসপুর উপজেলা কৃষি কর্মকর্তা হারুনুর রশিদ দ্য ডেইলি স্টারকে বলেন, ‘এ অঞ্চলের বেশিরভাগ কৃষক সরিষা ঘরে তোলার পর বোরো ধানের আবাদ করে। ফলে, বোরো আবাদে কিছুটা দেরি হয়।’
একই অবস্থা পাবনার ফরিদপুর উপজেলায়। ফরিদপুর উপজেলা কৃষি কর্মকর্তা মো. রোকনুজ্জামান দ্য ডেইলি স্টারকে বলেন, ‘ফরিদপুর উপজেলার মাত্র ৪৫ শতাংশ জমির ধান কাটা হয়েছে।’
চলনবিলের অন্যতম প্রধান ধান উৎপাদনকারী এলাকা পাবনার চাটমোহর উপজেলার কৃষি কর্মকর্তা মো. মাসুম বিল্লা দ্য ডেইলি স্টারকে বলেন, ‘প্রায় ৮০ শতাংশ জমির ধান ইতোমধ্যে কাটার উপযোগী হয়েছে। তবে শ্রমিক সংকটের কারণে আনেকেই সময় মতো ধান ঘরে তুলতে পারছেন না। আসন্ন দুর্যোগের কথা বিবেচনা করে ইতোমধ্যে কৃষকদের পাকা ধান কেটে ঘরে তোলার আহ্বান জানিয়ে মাইকিং করা হয়েছে।’
শ্রমিক সংকটের কারণে চলনবিলের বেশিরভাগ এলাকায় পুরুষের পাশাপাশি নারীরাও ধান কাটা ও মাড়াইয়ের কাজ করছেন।
নিমাইচরা এলাকার রোজি বেগম দ্য ডেইলি স্টারকে বলেন, ‘পুরুষরা মাঠ থেকে ধান কেটে আনে আর আমরা ধান মারাই, ধান ঝারা, শুকানো ও ব্যাগে ভরার কাজ করি। চলনবিলের প্রায় প্রতিটি এলাকায় নারীরা এভাবেই ধান কাটার ভরা মৌসুমে কাজ করে।’
চলনবিলের বিশাল এলাকা জুড়ে দুর্যোগের আগে ধান কেটে ঘরে তোলার জন্য কৃষকরা মরিয়া হয়ে কাজ করলেও আসন্ন দুর্যোগের হাত থেকে কতটা ফসল রক্ষা করতে পারবে তা নিয়ে উদ্বিগ্ন।
Comments