করোনাকালের ‘রেড ভলান্টিয়ার’

রেড ভলান্টিয়ার। ছবি: সংগৃহীত

বিধানসভায় ভোটের ফল প্রকাশের পর থেকে বেশ মন মরা ছিলেন বামপন্থি কর্মী অরিজিৎ। ভোটে এমন বেহাল দশা হবে তা স্বপ্নেও ভাবতে পারেনি মধ্যবিত্ত ঘরের এই টগবগে তরুণ। মায়ের অসুখ। ভালো ডাক্তারের খোঁজের সঙ্গেই ভোটটাকেও একই গুরুত্ব দিয়ে দেখেছিলেন। নিজে না বললেও বুঝতে পারছিলাম, গত বছরের লকডাউনের পর ওষুধ কোম্পানির চাকরিটাও তার হয়তো আর নেই। কারণ, অরিজিৎ এখন একটা স্বল্প পুঁজির ব্যবসা করে, ঘিয়ের।

হঠাৎ অনেক রাতে ছেলেটার ফোন— দাদা, যে করেই হোক একটা অক্সিজেন সিলিন্ডার জোগাড় করে দিতে হবে। হাসপাতালে বেড নেই। ডাক্তাররা যা সাহায্য করছেন, তা সবার কাছে পৌঁছে দেওয়া যাচ্ছে না পরিকাঠামোর অভাবে। অক্সিজেনের ব্যবস্থা করা গেলে কিছু মানুষকে বাঁচানো যাবে। 

রেড ভলান্টিয়ার। ছবি: সংগৃহীত


দুটি বাল্ক সিলিন্ডারের ব্যবস্থা করা গেল। সিলিন্ডার দুটোর রেগুলেটর নেই। ঘড়ি নেই। নেই তো কী হয়েছে? মানুষের পাশে থাকার ইচ্ছে থাকলে সব ‘নেই’ কেও যে ‘আছে’ করে নেওয়া যায় সেটাই প্রমাণ করলো ভাটপাড়ার অরিজিৎ, কচিরা। তারা প্রত্যেকেই বামপন্থি কর্মী। একমাস আগেও বিধানসভা ভোটে বামপন্থিদের জেতা-হারা ঘিরে তাদের ভাবনা ঘুরপাক খাচ্ছিল। এখন তারা সবাই ‘রেড ভলান্টিয়ার’। তাদের একমাত্র লক্ষ্য এলাকায় করোনা আক্রান্ত মানুষকে অক্সিজেন, ওষুধ ও খাবার পৌঁছে দেওয়া। সম্ভব হলে হাসপাতালে ভর্তি করানো।

কোচবিহার থেকে কাকদ্বীপ নেতারা নন, বামপন্থি কর্মীরাই এখন ‘রেড ভলান্টিয়ার’ হিসেবে কার্যত সরকারি পরিষেবার একটা নির্ভরযোগ্য বিকল্প হয়ে উঠেছে। এই রেড ভলান্টিয়ারদের সেবা কাজের ভেতর দিয়ে পশ্চিমবঙ্গের রাজনীতির ক্ষেত্রেই কেবল নয়, সামাজিক ক্ষেত্রেও নতুন পরিবেশ তৈরি হচ্ছে।

মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় বিরোধী রাজনীতির মানুষ সম্পর্কে তৈরি করেছিলেন বিদ্বেষের পরিবেশ। রাষ্ট্রীয় স্বয়ংসেবক সঙ্ঘ আর বিজেপি মুসলমান বিদ্বেষকে একমাত্র সম্বল করে তৈরি করেছিল ধর্মীয় বিভাজন।

বামপন্থার সমর্থক-কর্মীরা বেশিরভাগই নিজেদের এলাকায় প্রতিষ্ঠিত নেতা নন। দলীয় সভ্যের মর্যাদা পেয়েছেন এমন তরুণ, যুবকও বেশ কমই আছে এই রেড ভলান্টিয়ারদের ভেতরে।

কিন্তু, এসব স্বেচ্ছাসেবকেরা মমতার বিরোধী রাজনীতির ওপর বিদ্বেষ আর বিজেপির সাম্প্রদায়িক বিভাজনের ভেতর দিয়ে সামাজিক দূরত্ব তৈরির চেষ্টাকে যেভাবে রুখে দিতে সমর্থ হয়েছে দল-মত-জাতি-ধর্ম-ভাষা-ধনী-দরিদ্র কোনো কিছুর তোয়াক্কা না করে, তা এখানকার সামাজিক বিন্যাসের এক দশকের ব্যাধির প্রতিকার হিসেবে উঠে আসতে শুরু করেছে।

‘রেড ভলান্টিয়ার’ হিসেবে কিছুটা অপরিকল্পিত, অগোছালোভাবেই কাজে নেমেছেন বাম কর্মী-সমর্থকেরা। কারণ, নেতৃত্ব তাদের প্রতি সমর্থন-সহানুভূতি দেখালেও সেবা কাজের পরিকাঠামো তৈরির বিষয়ে তেমন মনোযোগ দেয়নি। 
রেড ভলান্টিয়ার। ছবি: সংগৃহীত


বেশিরভাগ রেড ভলান্টিয়ারদেরই ন্যূনতম স্বাস্থ্য প্রশিক্ষণের ব্যবস্থা করেনি বামপন্থি দলগুলো। কেন্দ্রীয় স্তরে একটা আধটা শিবির বা ভার্চুয়াল প্রশিক্ষণ অবশ্যই হয়েছে। কিন্তু, প্রতিটি এলাকাতে যে কয়জন ‘রেড ভলান্টিয়ার’ আছে, সমর্থক চিকিৎসকদের দিয়ে তাদের জন্যে ছোট-ছোট প্রশিক্ষণ শিবির করানোটা খুব জরুরি ছিল। কারণ, এসব তরুণ, যুবকরা বেশিরভাগ ক্ষেত্রেই নিজেদের সংক্রমণ এড়ানোর সরঞ্জাম ছাড়াই করোনা রোগীদের সেবা করে চলেছে। ইতোমধ্যেই উত্তর চব্বিশ পরগণার গাইঘাটার এক রেড ভলান্টিয়ার করোনায় আক্রান্ত হয়ে মারা গেছেন।

বামেদের বিরোধী দল, তৃণমূল বা বিজেপির কর্মীরা আক্রান্ত হলে বা তাদের আত্মীয়-স্বজনরা সংক্রমিত হলে কোনরকম রাজনৈতিক ছুৎমার্গ ছাড়া এই রেড ভলান্টিয়াররা যেভাবে নিজেদের জীবন বিপন্ন করে ঝাঁপিয়ে পড়ছেন, এই সংকীর্ণতামুক্ত মানসিকতাকে যদি ধরে রাখা যায় তবে তা পশ্চিমবঙ্গের সামগ্রিক সামাজিক পরিবেশকে একটা নতুন বিন্যাসে উপস্থাপিত করবে বলে অনেকের আশা।

সামাজিক কার্যক্রমের ভেতর দিয়েই বাংলার মানুষের হৃদয়ে এককালে স্থান করে নিয়েছিল বামপন্থিরা। জাতপাত আর সাম্প্রদায়িকতার বিষে গত শতকের চারের দশকে বাংলা যখন জর্জরিত, ১৯৪৩ সালের মন্বন্তরে মানুষ ভিক্ষাতে ভাত চাইতেও ভুলে গেছে, তখন ‘নারী আত্মরক্ষা সমিতি’র মাধ্যমে লঙ্গরখানা খুলেছিল বামপন্থিরা। 
রেড ভলান্টিয়ার। ছবি: সংগৃহীত


দুর্ভিক্ষের সময় বর্ধমানে সেই লঙ্গরখানার সঙ্গে যুক্ত ছিলেন সুফিয়া কামালও। পরবর্তীতে ১৯৪৬ সালের দাঙ্গায় সম্প্রীতি রক্ষায় সুচিত্রা মিত্র ও কলিম শরাফীরা যে সামাজিক কর্মসূচি নিয়েছিলেন তা কলকাতায় শান্তি ফেরাতে বিশেষ ভূমিকা নিয়েছিল। সেসময়ে বামপন্থিদের সামাজিক কর্মসূচি দাঙ্গার আগুনকে ছড়াতে দেয়নি গ্রাম-বাংলায়।

সামাজিক কর্মসূচি বামপন্থিদের অনেকখানি রাজনৈতিক সুবিধা করে দিয়েছিল মানুষকে নিজেদের দিকে টেনে আনতে। কিন্তু, সেই সামাজিক কাজের ধারাবাহিকতা পরবর্তীতে বজায় থাকেনি। বামপন্থিরা ক্ষমতায় থাকাকালে প্রশাসনিক দক্ষতার জন্যে দাঙ্গা আটকানো সম্ভব হয়। কিন্তু, সাম্প্রদায়িক বিভাজনের মানসিকতা যে মানুষের ভেতরে ঢুকছে, জাতপাতের দীর্ণতায় যে মানবতা গভীর সংকটে পড়ছে— সে দিকগুলোর প্রতি আন্তরিকতার সঙ্গে পরিপূর্ণ নজর দেওয়া যায়নি।

তাই আমরা দেখেছি পশ্চিমবঙ্গের বাংলাদেশ সীমান্ত লাগোয়া উত্তর চব্বিশ পরগণার বসিরহাটে ধারাবাহিক জালসার মাধ্যমে বিদ্বেষ ছড়িয়েছে বাংলাদেশের কুখ্যাত যুদ্ধাপরাধী দেলোয়ার হোসেন সাঈদী। সিপিআইএমের সাপ্তাহিক মুখপত্রে বিষয়টি আলোচিত হয়েছে। তবুও প্রশাসন কিছু করেনি।

হুগলীর আরামবাগ মহকুমার রাধানগর, রামমোহনের জন্মস্থান। সেখানকার ঘণ্টেশ্বর শিবের মন্দির লাগোয়া শ্মশানে নিম্নবর্গীয় হিন্দুদের শবদাহ ঘিরে যে ভয়ঙ্কর জাতপাতের বিভাজন গত ১৯৯০ এর দশকেও ছিল, তা থেকেই বোঝা যায়, গ্রামীণ জীবনে বেড়াজাল ভাঙতে যে সামাজিক উদ্যোগের প্রয়োজন ছিল, তা ভোটকেন্দ্রিক বামপন্থিরা চিন্তাই করেননি। অথচ এই আরামবাগেরই বড়দোঙ্গল গ্রামের ‘ভট্টাচার্য পুকুর’-এ ব্রিটিশ আমলে ব্রাহ্মণ ছাড়া অন্য জাতের মানুষ পানি ব্যবহার করতে পারতেন না। গান্ধীবাদী প্রফুল্লচন্দ্র সেন আন্দোলন করে সেই পুকুরটি সবার জন্যে উন্মুক্ত করেছিলেন। 
রেড ভলান্টিয়ার। ছবি: সংগৃহীত


রেড ভলান্টিয়াররা করোনা রোগীদের সেবার ভেতর দিয়ে সাম্প্রতিক পশ্চিমবঙ্গের ধর্ম-জাতপাত আর রাজনীতির যে বিভাজন— তাকে ভাঙছে। সেই ভাঙন আসছে একদম নবীন প্রজন্মের হাত ধরে। কিছুকাল আগে দিল্লিতে এনআরসির বিরুদ্ধে শাহিনবাগের প্রতিরোধ, কৃষি আইন সংশোধনের প্রতিবাদে কৃষকদের প্রতিরোধ যেভাবে রাজনৈতিক দলের ধরাবাঁধা গণ্ডির বাইরে থেকে উঠে এসেছিল, সেভাবেই উঠে আসছেন ‘রেড ভলান্টিয়ার’রা।

বাম দলগুলোর একাংশের আত্মপ্রচার লোভী নেতারা রেড ভলান্টিয়ারদের কৃতিত্বকে নিজেদের ঝুলিতে ভরতে চাচ্ছেন। কিন্তু, করোনার সঙ্গে যুঝবার জন্যে এই রেড ভলান্টিয়াররে প্রশিক্ষণ, সরঞ্জাম ইত্যাদি বিতরণকালে ফটো তুলে ফেসবুকে পোস্ট করা ছাড়া তাদের তেমন কোনো ভূমিকা নেই বলে মনে করেন অনেকে।

পরিশেষে একটি ছোট্ট ঘটনা। লেখার শুরুতে বলা অরিজিৎয়ের পাশের শহরে গত ভোটে যিনি বাম প্রার্থী ছিলেন তার দাদার কথা, ‘আমরা তো প্রতি রাতে রেড ভলান্টিয়ারদের সব কিছু বুঝিয়ে দিচ্ছি। আমরা যদি ফিল্ডে নামি, রোজ তাদের বোঝাবে কে?’

পাঠক, রবীন্দ্রনাথের ‘রামকানাইয়ের নির্বুদ্ধিতা’র বরদাসুন্দরী দেবীর গৃহপোষ্য মামাতো ভাইয়ের উক্তি স্মরণ করুন; ‘লোকটাকে কেমন ঠেসে ধরেছিলুম!’

Comments

The Daily Star  | English

All customs houses open this weekend to clear backlog

All customs houses across the country will remain open for import and export activities this weekend – today and tomorrow..The customs policy wing of the National Board of Revenue (NBR) yesterday issued directives to the customs houses in Chattogram, Dhaka, Benapole, Mongla, Customs House

38m ago