প্রবাসীরা প্রতি ক্ষেত্রে শোষিত, নির্যাতিত ও অসম্মানিত

প্রবাসী কর্মীরা আমাদের জন্য ঈশপের রূপকথার সোনার ডিম পাড়া রাজহাঁসের মতো। আমাদের কোনো সহায়তা ছাড়াই এবং আমাদের কাছ থেকে অবিরত অপমানের শিকার হয়েও তারা এই কাজটি বছরের পর বছর করে যাচ্ছেন। ২০১৬ থেকে ২০১৯ সালে (জানুয়ারি থেকে ডিসেম্বর) দেশের বাইরে থেকে আসা বাৎসরিক গড় রেমিট্যান্সের পরিমাণ ছিল ১৫ দশমিক ২৫ বিলিয়ন মার্কিন ডলার। ২০২০ সালে তা বেড়ে গিয়ে ২১ দশমিক সাত বিলিয়নে পৌঁছায়। বিশ্বব্যাপী মহামারি, সার্বক্ষণিক চাকরি নিয়ে সমস্যা ও আর্থিক ক্ষতির মুখেও এ বছরের প্রথম চার মাসে (২০২১ সালের জানুয়ারি থেকে এপ্রিল) আমরা সাত দশমিক সাত বিলিয়ন ডলার রেমিট্যান্স পেয়েছি। প্রবাসী কর্মীদের নিজ পরিবার ও দেশের প্রতি নিষ্ঠার কোনো তুলনা হয় না।
গত ২৪ মে রাজধানীর হোটের সোনারগাঁওয়ের সৌদিয়া অফিসের সামনে সৌদি আরবগামী প্রবাসী কর্মীরা। ছবি: প্রবীর দাশ

প্রবাসী কর্মীরা আমাদের জন্য ঈশপের রূপকথার সোনার ডিম পাড়া রাজহাঁসের মতো। আমাদের কোনো সহায়তা ছাড়াই এবং আমাদের কাছ থেকে অবিরত অপমানের শিকার হয়েও তারা এই কাজটি বছরের পর বছর করে যাচ্ছেন। ২০১৬ থেকে ২০১৯ সালে (জানুয়ারি থেকে ডিসেম্বর) দেশের বাইরে থেকে আসা বাৎসরিক গড় রেমিট্যান্সের পরিমাণ ছিল ১৫ দশমিক ২৫ বিলিয়ন মার্কিন ডলার। ২০২০ সালে তা বেড়ে গিয়ে ২১ দশমিক সাত বিলিয়নে পৌঁছায়। বিশ্বব্যাপী মহামারি, সার্বক্ষণিক চাকরি নিয়ে সমস্যা ও আর্থিক ক্ষতির মুখেও এ বছরের প্রথম চার মাসে (২০২১ সালের জানুয়ারি থেকে এপ্রিল) আমরা সাত দশমিক সাত বিলিয়ন ডলার রেমিট্যান্স পেয়েছি। প্রবাসী কর্মীদের নিজ পরিবার ও দেশের প্রতি নিষ্ঠার কোনো তুলনা হয় না।

এই বিলিয়ন ডলারের বৈদেশিক মুদ্রা অর্জনের ক্ষেত্রে সরকারকে একটি টাকাও খরচ করতে হয় না। কর্মীরাই সব খরচ বহন করেন। একদিকে তারা সব ধরনের ফি (বলাই বাহুল্য, এর মধ্যে ঘুষও অন্তর্ভুক্ত) এবং মাত্রাতিরিক্ত প্লেন ভাড়া (পাদটীকা দেখুন) বহন করেন, আর অপরদিকে আমরা এতটাই বিপুল পরিমাণ বৈদেশিক মুদ্রার রিজার্ভ রাখার সুবিধা উপভোগ করছি যে আমরা শ্রীলঙ্কাকে ৫০০ মিলিয়ন মার্কিন ডলার দিয়ে সহায়তা করতে পারছি। (একজন বাংলাদেশি নাগরিক হিসেবে আমি গর্ব বোধ করছি যে আমরা এখন একটি প্রতিবেশী রাষ্ট্রকে সাহায্য করতে সক্ষম। কিন্তু আমাদের প্রবাসী কর্মীরা, যারা সৌদি আরবে যাওয়ার জন্য হঠাৎ করে আসা বাধ্যবাধকতা পূরণের জন্য হন্যে হয়ে মহাজনদের কাছ থেকে ঋণ নিচ্ছেন কিংবা তাদের যৎসামান্য সহায়-সম্পত্তি বিক্রি করে দিতে বাধ্য হচ্ছেন। তাদের জন্য কি আমরা সেই রিজার্ভের সামান্য অংশটুকুও ব্যয় করতে পারি না?)

বর্তমান সংকটের মূলে রয়েছে যেসব শ্রমিক সৌদি আরবে তাদের কর্মস্থলে যোগ দিতে যাওয়ার জন্য প্রস্তুত ছিলেন, তাদেরকে সময়মতো ভ্যাকসিন না দেওয়া। আমরা সুনির্দিষ্টভাবে জানতাম কয়জন কর্মী যাবেন এবং বেশ কয়েক মাস আগে থেকেই তাদের বুকিং নিশ্চিত করা ছিল। সকল নিয়োগদাতা প্রতিষ্ঠানের মুখপাত্র বাংলাদেশ অ্যাসোসিয়েশন অব ইন্টারন্যাশনাল রিক্রুটিং এজেন্সি (বায়রা) মন্ত্রণালয় ও অন্যান্য সব সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষের কাছে মিনতি করে বলেছিল, যেসব কর্মী মে’তে দেশত্যাগ করবেন, তাদের জন্য বিশেষ টিকাদান কর্মসূচির আয়োজন করতে। তাদের সে অনুরোধে কেউ কর্ণপাত করেনি। কারণ যতদিন পর্যন্ত অর্থের প্রবাহ অবিচ্ছিন্ন থাকে, ততদিন পর্যন্ত আমরা এসব দুর্ভাগা কর্মীদের নিয়তি নিয়ে চিন্তিত হই না।

সৌদি কর্তৃপক্ষ যখন জানতে পারলেন যে, আমাদের কর্মীরা ভ্যাকসিন নেননি, তখন তারা বাধ্যতামূলক কোয়ারেন্টিনের বিধিনিষেধ আরোপ করেন এবং বর্তমান সংকটের সূচনা হয়। আমরা যদি শুধু তাদেরকে সময়মতো ভ্যাকসিনের দুটি ডোজ দিতাম এবং টিকাদান সনদটি দিয়ে দিতাম, তাহলেই আমাদের কর্মীরা ভোগান্তি এড়িয়ে তাদের বুকিং দেওয়া নিয়মিত ফ্লাইট ধরতে পারতেন। বিমানকেও ফ্লাইট বাতিল করে বড় আকারের আর্থিক ক্ষতির মুখে পড়তে হতো না। এটি ছিল প্রবাসী কল্যাণ ও বৈদেশিক কর্মসংস্থান মন্ত্রণালয়ের দায়িত্ব এবং তারা এ বিষয়ে কিছুই করেনি। তাদের একমাত্র কাজ হতো স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয়ের সঙ্গে সমন্বয় করে আমাদের কর্মীদেরকে অগ্রাধিকার ভিত্তিতে ভ্যাকসিন দেওয়া এবং সেক্ষেত্রে বর্তমান সংকটের উদ্ভব হতো না। তাদেরকে কি এ ঘটনার জন্য দায়ী করা সম্ভব হবে?

গত ১০ মে সৌদি সরকার আমাদেরকে জানায় যে ২০ মে থেকে কর্মীদেরকে একটি নতুন স্বাস্থ্য নির্দেশনা মেনে চলতে হবে, যার মধ্যে রয়েছে বাধ্যতামূলকভাবে সাত দিন হোটেলে কোয়ারেন্টিনে থাকা, যার জন্য প্রত্যেককে আলাদা করে অগ্রিম ৬০ থেকে ৭০ হাজার টাকা জমা দিতে হবে।

উভয় বিমান সংস্থা এ নির্দেশনা মেনে চলার জন্য ১০ দিনের অগ্রিম নোটিশ পেয়েছে। যদিও যাত্রীদেরকে শেষ মুহূর্তের ভোগান্তিতে পড়তে হয়েছে, সৌদি এয়ারলাইনস তাদের জন্য ২৪ মে পর্যন্ত হোটেল কোয়ারেন্টিনের ব্যবস্থা করে দিয়েছে (অবশ্যই অর্থ পরিশোধের বিনিময়ে) এবং তারা একটি ফ্লাইটও মিস করেনি। তবে, গত মঙ্গলবার থেকে সৌদি এয়ারলাইনস এ বিষয়ে কাজ করতে অস্বীকৃতি জানিয়ে আসছে এবং সৌদি বেসামরিক বিমান চলাচল কর্তৃপক্ষের নির্দেশনা অনুযায়ী হোটেল বুকিংয়ের দায়িত্বটি যাত্রীদের ঘাড়ে চাপিয়ে দিয়েছে।

অপরদিকে, পরিস্থিতির উন্নয়নে কাজ করার বদলে বিমান ২০ মে থেকে সৌদি আরবগামী সব ফ্লাইট বাতিল করে দিয়েছে এবং তা করেছে যাত্রীদের বিভিন্ন রকম অনিশ্চয়তার মুখে রেখে। যেমন: তাদের ভিসা ও ওয়ার্ক পারমিটের মেয়াদ শেষ হয়ে যাওয়া, ইত্যাদি। আমাদের জাতীয় বিমান সংস্থার ফ্লাইট আগামীকাল থেকে পুনরায় চালু হতে যাচ্ছে। বিমান ১০ মে নতুন নির্দেশনা আরোপ হওয়ার পর থেকে কোনো উদ্যোগ নেয়নি এবং তারাও বুকিংয়ের  বাড়তি ঝামেলা যাত্রীদের ওপর ছেড়ে দিয়েছে।

আমাদের অনুমান অনুযায়ী প্রায় পাঁচ হাজার কর্মী দেশে আটকে আছেন এবং তারা জানেন না তারা কী করবেন, কোথায় যাবেন এবং তাদেরকে সহায়তা করার জন্য কে বা কারা আছেন। আরও ৩৩ হাজার সৌদিগামী কর্মী ভিসা ও নিশ্চিত করা টিকিটসহ জুনে ভ্রমণের জন্য অপেক্ষা করছেন। তারা যদি সময়মতো টিকা পেতেন, তাহলে তাদের যাত্রা নির্বিঘ্ন হতো। এখন ভ্রমণ করার জন্য তাদেরকে হোটেল কোয়ারেন্টিনের টাকা খরচ করতে হবে এবং তা পরিশোধ করতে হবে বৈদেশিক মুদ্রায়।

তাহলে কেন রেমিট্যান্স প্রেরক, রিজার্ভ পরিপূরণকারী ও কখনো কোনো কিছু দাবি করেন না, এমন কর্মীদের সঙ্গে এত নির্দয় আচরণ করা হচ্ছে? কেন সরকার, সংশ্লিষ্ট মন্ত্রণালয়, ওয়েজ আর্নার্স কল্যাণ বোর্ড (ডব্লিউইডব্লিউবি), জনশক্তি, কর্মসংস্থান ও প্রশিক্ষণ ব্যুরো (বিএমইটি) কর্মীদের এই সংকটের মুহূর্তে তাদের দিকে সহায়তার হাত বাড়িয়ে দিচ্ছে না? বিশেষত, যখন তারা কর্মীদের উপার্জন করা হাজারো কোটি টাকার ওপর বসে আছে, যা সংগ্রহই করা হয়েছে এ ধরনের পরিস্থিতি মোকাবিলার জন্য।

প্রবাসী কল্যাণ ও বৈদেশিক কর্মসংস্থান মন্ত্রণালয় গঠন করা হয়েছে প্রবাসী কর্মীদের কল্যাণের জন্য। কিন্তু, তারা এ যাবত লজ্জাজনকভাবে নীরবতা পালন করে এসেছে। তাদের ক্ষেত্রে টিকাদানের আয়োজন না করা এবং কর্মীদের সহায়তায় এগিয়ে না আসাকে আইনগত ও নৈতিক, উভয় দৃষ্টিকোণ থেকেই দায়িত্বে চূড়ান্ত অবহেলা হিসেবে বিবেচনা করা যায়।

সৌদি সরকার ভ্রমণ নির্দেশিকা দেওয়ার সঙ্গে সঙ্গেই মন্ত্রণালয় চাইলে কর্মীদের পাশে দাঁড়িয়ে তাদেরকে সব ধরনের সহায়তা দেওয়ার আশ্বাস দিতে পারত। তারা কর্মীদের সাহায্য করার জন্য নিয়োগদাতা প্রতিষ্ঠান ও ট্রাভেল এজেন্সির প্রতিনিধি এবং অন্যান্য সংশ্লিষ্টদের সঙ্গে নিয়ে জেদ্দা ও রিয়াদে আমাদের দূতাবাস, বিমান বাংলাদেশ এবং ঢাকার সৌদি দূতাবাসের সঙ্গে সম্মিলিতভাবে কাজ করতে পারত।

এক্ষেত্রে মন্ত্রণালয় ও ওয়েজ আর্নার্স কল্যাণ বোর্ড যে ভূমিকা পালন করেছে, তা ব্যাখাতীত ও ক্ষমার অযোগ্য। তারা খুব সম্ভবত কর্মীদের উপার্জন করা তিন হাজার কোটি টাকারও বেশি পরিমাণ তহবিলের ওপর বসে আছেন। কিন্তু, কেন তারা কর্মীদের এই সংকটাপন্ন মুহূর্তে এগিয়ে আসছেন না এবং তাদের প্রয়োজন অনুযায়ী কেন আর্থিক সহায়তার হাত বাড়িয়ে দিচ্ছেন না, তা অবশ্যই নিন্দনীয়।

আমরা কল্যাণ তহবিলের ব্যবস্থাপনাকারী প্রতিষ্ঠান ওয়েজ আর্নার্স কল্যাণ বোর্ডের ওয়েবসাইট ঘেঁটে দেখেছি। কিন্তু, সেখানে কোথাও তাদের আর্থিক অবস্থানের পরিষ্কার কোনো চিত্র খুঁজে পাইনি। সেখানে তাদের সম্পদ ও দায়ের পরিমাণ দেওয়া নেই, যে তথ্যটি জবাবদিহি ও স্বচ্ছতায় বিশ্বাস করে এরকম যেকোনো প্রতিষ্ঠানের কাছ থেকে প্রাথমিক চাহিদা হিসেবে বিবেচিত। আমরা শুধু বাৎসরিক প্রতিবেদনগুলো খুঁজে পাই এবং সেখানেও শুধু বিভিন্ন খাতে ব্যয়ের হিসেব দেওয়া আছে, আয়ের হিসেব নেই।

কেন তাহলে এই তহবিলের সামগ্রিক আর্থিক অবস্থানের ক্ষেত্রে এত গোপনীয়তা? এর কারণ কি তাহলে এটাই যে, কর্মীরা, যারা এই তহবিলের প্রকৃত মালিক, তাদের নিজেদের মালিকানাধীন টাকার প্রকৃত পরিমাণ সম্পর্কে জেনে যাবে এবং সঙ্গে এটাও জেনে যাবে যে, সেখান থেকে কী পরিমাণ টাকা তছরুপ হয়েছে?

২০১৮-২০১৯ সালের প্রতিবেদন অনুসারে (ওয়েবসাইট উৎস), বোর্ড ১৮৩ দশমিক ৩৭ কোটি টাকা ব্যয় করেছে, যার মধ্যে ১৬২ দশমিক ৪৬ কোটি টাকা কর্মীদের বিভিন্ন রকম সেবা দেওয়ার জন্য ব্যয় করা হয়েছে এবং বাকি ২০ দশমিক ৯১ কোটি টাকা তাদের নিজেদের প্রশাসনিক ও অন্যান্য খরচ হিসেবে দেখানো হয়েছে। খরচের দ্বিতীয় অংশের মধ্যে ছয় দশমিক ৬৬ কোটি টাকা প্রশাসনিক খরচ (প্রশাসনিক, আইটেম ২) হিসেবে এবং ১২ দশমিক ২৯ কোটি টাকা খরচ দেখানো হয়েছে ক্রয় ও সেবা (সরবরাহ ও সেবা, আইটেম ৩) খাতে।

আমরা দুই নম্বর আইটেমের (প্রশাসনিক খরচ) একটু গভীরে গেলে দেখতে পাই, মাসিক বেতন খাতে এক দশমিক ৮৬ কোটি টাকা, কর্মীদের বেতন খাতে এক দশমিক ৪০ কোটি টাকা, বাড়ি ভাড়া খাতে এক দশমিক আট কোটি টাকা, উৎসব বোনাস খাতে ৬০ লাখ টাকা, চিকিৎসা ভাতা খাতে ২১ লাখ টাকা ও বিশেষ ভাতা (গাড়ি) খাতে ২৪ লাখ টাকা খরচ দেখানো হয়েছে।

তিন নম্বর আইটেমে (ক্রয় ও সেবা) দেখা যায়, ডাটা এন্ট্রি খাতে দুই কোটি টাকা, চুক্তিভিত্তিক/সাময়িক কর্মী খাতে চার কোটি টাকা, ভ্রমণ খাতে ৯০ লাখ টাকা, পেট্রোল/গ্যাস খাতে ৮০ লাখ টাকা, নিরাপত্তা কর্মী খাতে ৬০ লাখ টাকা ও ওভারটাইম খাতে ২০ লাখ টাকা খরচ ধরা হয়েছে।

এ ছাড়াও, বিভিন্ন খাতে লাখো টাকার অসংখ্য খরচ দেখানো হয়েছে, যা গুনে শেষ করা যায় না। এ খরচগুলোর পেছনের যুক্তিগুলো বেশিরভাগ ক্ষেত্রেই সন্দেহ জাগায় অথবা দুর্বল ভিত্তির ওপর প্রতিষ্ঠিত। যেমন: চুক্তিভিত্তিক ও সাময়িক কর্মীদের জন্য চার কোটি টাকা, ডাটা এন্ট্রির জন্য দুই কোটি টাকা, ইন্টারনেট বিলের জন্য ২০ লাখ টাকা এবং গাড়ি, আসবাবপত্র ও অফিস সাজানোর জন্য টাকা, ইত্যাদি।

আপাতদৃষ্টিতে মনে হয় যেন মন্ত্রণালয় ও ওয়েজ আর্নার্স কল্যাণ বোর্ডের মাঝে বাজেট সংক্রান্ত বিষয় সুপরিকল্পিতভাবে ধোঁয়াশাচ্ছন্ন করে রাখা হয়েছে। এ কারণে কর্মকর্তারা বিভিন্ন খাতে খরচ দেখাতে পারেন এবং তহবিলের উৎসগুলোকে মিলিয়ে ফেলতে পারেন। আমাদেরকে বলা হয়েছে, তহবিলগুলোর অডিট হয়। কিন্তু, তা জনসম্মুখে প্রকাশ করার প্রমাণ নেই। এই তহবিলের অডিট কি পেশাদার ও স্বনামধন্য চার্টার্ড অ্যাকাউন্ট্যান্ট প্রতিষ্ঠান করে থাকে, নাকি নামকাওয়াস্তে অডিটররা এই কাজটি করে থাকেন? আমাদের ১৯৯০ সাল থেকে শুরু করে আজ পর্যন্ত তহবিলটির সম্পূর্ণ তথ্য জানা দরকার, যার অনুমিত অর্থ তিন হাজার কোটি টাকার চেয়েও বেশি।

ওয়েজ আর্নার্স কল্যাণ বোর্ড ১৯৯০ সালে ওয়েজ আর্নার্স ওয়েলফেয়ার ফান্ড নামে গঠিত হয় এবং তখন থেকেই সেখানে স্বচ্ছতার অভাব দেখা গিয়েছে। এই তহবিলের সুবিধা নিতে প্রবাসী কর্মীকে শুরুতে অল্প পরিমাণ টাকা দিতে হলেও বর্তমানে এর পরিমাণ তিন হাজার ৫০০ টাকা। ২০১৩ সালে প্রতিষ্ঠিত হওয়ার পর থেকেই জনশক্তি কর্মসংস্থান ও প্রশিক্ষণ ব্যুরো সীমিত পরিমাণ মাথাপিছু ব্যয়ের মাধ্যমে তহবিলের ব্যবস্থাপনা করছিল। তবে, বর্তমানে এ সংস্থার রয়েছে ২০০ জনেরও বেশি কর্মকর্তা, যাদের পেছনে বাৎসরিক ব্যয় ২০ কোটি টাকারও বেশি। কর্মীদের কাছ থেকে না নিয়ে সরকার কেন এ খরচ নিজে বহন করছে না? এ ছাড়াও, কেন এই সংস্থায় কর্মরত ডেপুটেশানে থাকা বিসিএস ক্যাডারের কর্মীরা সরকারের নিজস্ব বাজেটের পরিবর্তে এসব গরিব প্রবাসী কর্মীদের তহবিল থেকে বেতন পাবেন?

মজার বিষয় হলো, ১৬ সদস্যের বোর্ডে কর্মীদের মধ্য থেকে মাত্র তিন জন প্রতিনিধি রয়েছেন (কার্যত একজন, কারণ দুটি পদ খালি রয়েছে)। বিভিন্ন মন্ত্রণালয়ের প্রতিনিধি হিসেবে ১২ জন এবং নিয়োগদাতা প্রতিষ্ঠানের প্রতিনিধি হিসেবে একজন আছেন বোর্ডে। এখান থেকে সহজেই অনুমান করা যায় যে, প্রবাসীদের কল্যাণের বিষয়টি এই বোর্ডের বিবেচনায় কতটা কম প্রাধান্য পেয়ে থাকে। এই বোর্ড যাদের টাকার ব্যবস্থাপনা করে থাকে, সেই টাকার ‘মালিকদের’ প্রতিনিধিত্ব এত কম কেন সেখানে? আর্থিক সুবিধার সঙ্গে সম্পর্কযুক্ত কোনো বিষয়ের ক্ষেত্রে এ ধরনের ক্ষমতার জোরদখল কে কি কেউ, কোথাও মেনে নেবে? এক্ষেত্রে এটি সম্ভব হয়েছে, কারণ প্রবাসী কর্মীদের জোরালো কণ্ঠের অভাব এবং তাদের অধিকারবোধ নিম্ন পর্যায়ে। এ কারণেই তাদের সঙ্গে এ ধরনের ঔদ্ধত্য দেখানো যায় এবং তাদের প্রতি অবিচার করা যায়।

রেমিট্যান্সের মাধ্যমে দেশে আসা অর্থের ওপর দুই শতাংশ প্রণোদনা দেওয়ার সরকারি উদ্যোগ প্রশংসার দাবি রাখে। আমরা আমাদের রপ্তানি শিল্পকে যে পরিমাণ সুযোগ-সুবিধা দিচ্ছি, যেমন: ব্যাংক ঋণ, ক্যাশব্যাক প্রণোদনা, কর মওকুফ, ইত্যাদি, তার সঙ্গে তুলনা করলে এই প্রণোদনাকে পাঁচ শতাংশে উন্নীত করা উচিত। এরকম একটি উদ্যোগ নেওয়া হলে অপ্রাতিষ্ঠানিক মাধ্যম, যেমন হুন্ডি থেকে অর্থ স্থানান্তরের পরিবর্তে প্রাতিষ্ঠানিক ব্যাংকিং চ্যানেলের মাধ্যমে অর্থ স্থানান্তরের পরিমাণ বাড়বে। রেমিট্যান্সের প্রাপকদের তারল্যের পরিমাণ বেড়ে যাবে এবং পল্লী অর্থনীতি প্রবৃদ্ধির হার বেড়ে যাবে।

প্রবাসী কর্মীদের প্রতি সব সময়ই অবহেলা, নির্লিপ্ততা ও অসম্মান প্রদর্শন করা হয় এবং বর্তমান সংকট যার আরেকটি প্রমাণ। এই পরিস্থিতিতে মন্ত্রণালয় ও ওয়েজ আর্নার্স কল্যাণ বোর্ডের কার্যধারার নিরীক্ষণ করা এখন সময়ের দাবি। কোন প্রক্রিয়ায় আমাদের প্রবাসী কর্মীদের নিয়োগ ও প্রশিক্ষণ দেওয়া হয়, কীভাবে তাদেরকে বিদেশে পাঠানো হয়, বিদেশে তাদের দেখভাল কীভাবে করা হচ্ছে এবং বিপদের সময় কীভাবে তাদের সেবা করা যায়, এই সমগ্র প্রক্রিয়ার একটি সার্বিক নিরীক্ষণের বিষয়টি সবচেয়ে বেশি প্রাধান্য পাওয়া উচিত। এই নিরীক্ষায় মৌলিক মানবাধিকার রক্ষা, কর্মীদের স্বাস্থ্য সুরক্ষা ও দেশে ফিরে আসার পর তাদের সহায়তা দেওয়া, এসব বিষয় অন্তর্ভুক্ত থাকা উচিত। শুরুতে আমাদেরকে সংশ্লিষ্ট মন্ত্রণালয়ের সব কার্যকলাপের সঙ্গে প্রবাসী কর্মীদের অংশগ্রহণ নিশ্চিত করতে হবে। ওয়েজ আর্নার্স কল্যাণ বোর্ডেও কর্মীদের অংশগ্রহণ বাড়াতে হবে এবং কর্মীদের তহবিল ব্যবহারের ক্ষেত্রে বাধ্যতামূলক স্বচ্ছতা নিশ্চিত করতে হবে।

এখনই সময় আমাদের প্রবাসী কর্মীদের প্রতি যথাযোগ্য শ্রদ্ধা প্রদর্শন করার ও তাদেরকে তাদের প্রাপ্য সম্মান দেওয়ার। কারণ, তারা নীরব চালিকাশক্তি হিসেবে আমাদের দেশকে গড়ে তুলছেন।

পাদটীকা

২৪ এপ্রিল দ্য ডেইলি স্টারে প্রকাশিত প্রতিবেদন অনুযায়ী ওমান, সংযুক্ত আরব আমিরাত ও কাতারের একটি বিমান টিকিটের দাম বর্তমানে ৮০ হাজার থেকে এক লাখ টাকা। সৌদি আরবের টিকিটের দাম ২০ হাজার টাকা বেড়ে ৯৫ হাজারে পৌঁছেছে। তুলনামূলকভাবে, কলকাতা থেকে রিয়াদের টিকিটের দাম ১৩ হাজার টাকা এবং মুম্বাই থেকে দুবাই টিকিটের দাম ১৭ হাজার টাকা। নেপাল থেকে রিয়াদ যেতে ৩৫ হাজার টাকা খরচ হয় এবং দুবাই যেতে ২০ হাজার টাকা খরচ হয় (সূত্র: অ্যাসোসিয়েশন অব ট্রাভেল এজেন্টস অব বাংলাদেশ)।

মাহফুজ আনাম: সম্পাদক ও প্রকাশক, দ্য ডেইলি স্টার

ইংরেজি থেকে অনুবাদ করেছেন মোহাম্মদ ইশতিয়াক খান

Comments

The Daily Star  | English

Fire breaks out at shoe factory in Ctg

A fire broke out at a factory that produces shoe accessories on Bayezid Bostami Road in Chattogram city this afternoon

43m ago