দিন মাস বছর যায়, তাদের অপেক্ষা শেষ হয় না
রাস্তায় বা সম্মেলন কক্ষে নিখোঁজ বাবা পারভেজ হোসেনের ছবি হাতে দাঁড়ানো ছোট্ট আদিবা ইসলাম হৃদির খবর অন্তত পাঁচ বছর ধরে ছাপছে দ্য ডেইলি স্টার।
প্রতি বছর বাবার একটা ছবিই হৃদির হাতে দেখা যায়। কমলা রংয়ের টি-শার্ট ও সানগ্লাস পরে একটা লাল মোটরসাইকেলে বসে তোলা ওই ছবিটিই পরিবারের কাছে থাকা পারভেজের শেষ ছবি।
পরিবার ও বন্ধুদের দাবি, ২০১৩ সালের ২ ডিসেম্বর রাজধানীর বংশালের ছাত্রদল নেতা পারভেজকে আইন-শৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর সদস্যরা শাহবাগ থেকে তাদের সামনেই তুলে নিয়ে যায়।
গুমের শিকার ব্যক্তিদের পরিবারের সদস্যদের নিয়ে গঠিত সংগঠন ‘মায়ের ডাক’ আয়োজিত গতকালের এক মানববন্ধনে অংশ নেয় হৃদি।
জাতীয় প্রেসক্লাবের সামনে বসে ডেইলি স্টারকে সে বলে, ‘আমি গত আট বছর ধরে এখানে আসছি।’
চতুর্থ শ্রেণির ছাত্রী হৃদির বয়স এখন নয় বছর। প্রতি বছরই তার বয়স বাড়ছে। কিন্তু, একই দাবি নিয়ে তাকে প্রতি বছরই ফিরে আসতে দেখছে ডেইলি স্টার। বাবাকে ফিরে পেতে চায় সে।
পারভেজকে যখন তুলে নিয়ে যাওয়া হয়, হৃদির বয়স তখন দুই বছরেরও কম। সে বলে, ‘বাবাকে মনেও করতে পারি না আমি।’
এ কাহিনী শুধু হৃদির একার নয়।
১১ বছর বয়সী লামিয়া আক্তার মিমও গত আট বছর ধরে এখানে আসছে। তার বাবা গাড়িচালক কাউসার হোসেনকেও আইন-শৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী তুলে নিয়ে গেছে বলে অভিযোগ পরিবারের। ২০১৩ সালের ৪ ডিসেম্বর পশ্চিম নাখালপাড়ায় নিজ বাড়ি থেকে তুলে নেওয়ার সময় কাউসারের বয়স ছিল ২২ বছর।
‘মায়ের ডাক’ জানায়, ছেলেকে ফিরে আসতে দেখার অপূর্ণ ইচ্ছে নিয়েই এ বছরের শুরুর দিকে কাউসারের মা মারা গেছেন।
একইভাবে সাত বছর বয়সী সাফা তার জীবনের প্রতি বছরই এসব বিক্ষোভ কর্মসূচিতে আসছে। সাফা বলে, ‘আমি মায়ের গর্ভে থাকা অবস্থাতেই আমার বাবাকে তুলে নেওয়া হয়।’
খোলা ড্রেন থেকে পায়ে মশা এসে বসলেও সে তার বাবা বংশালের ছাত্রদল নেতা মাহফুজুর রহমান সোহেলের ছবি হাতে বসেই ছিল। ২০১৩ সালের ২ ডিসেম্বর তিনি নিখোঁজ হন।
সাফা বলে, ‘ফুল কিনতে যাওয়ার সময় তারা বাবাকে তুলে নিয়ে যায়। আমি এখানকার অন্য শিশুদেরও চিনি। প্রতি বছরই তাদের সঙ্গে দেখা হয়।’
আশা ক্ষীণ হয়ে আসতে আর কতদিন?
হৃদির মা ফারজানা আক্তার বলেন, ‘গত বছর বংশাল থানা থেকে ফোন করে সাধারণ ডায়েরি (জিডি) তুলে নিতে বলে আমাদের। কিন্তু, আমি আশা ছাড়িনি। স্বামীকে খুঁজে পেলে জিডি তুলে নেব।’
২০১২ সালের ১৮ এপ্রিল নিখোঁজ হওয়া বিএনপি নেতা ইলিয়াস আলীর ছেলে আবরার ইলিয়াস বলেন, ‘আমরা প্রায়ই প্রিয়জনদের ফিরে আসতে দেখি। আমরা আশা হারাতে পারি না। আমাদের আশা করেই যেতে হবে যে, একদিন না একদিন আমাদের পরিবারের সদস্যরা ফিরে আসবেন।’
গুমের শিকার সাজেদুল ইসলাম সুমনের বোন আফরোজা ইসলাম আঁখি বলেন, ‘গত ১৩ বছর ধরে আমি এখানে আসছি। সরকার যদি মনে করে তারা একজন মানুষকে গুম করে তার মুখ বন্ধ করে দিতে পারবে, তাহলে তারা বোঝেনি যে এ কাজটি তার পরিবারের সদস্যদের আরও জোরে চিৎকার করার শক্তি দেবে।’
সাজেদুল ইসলাম সুমন ঢাকা মহানগর বিএনপির ৩৮ নম্বর ওয়ার্ডেরও সাধারণ সম্পাদক ছিলেন। ২০১৩ সালের ৪ ডিসেম্বর তাকে আরও পাঁচ জনের সঙ্গে ঢাকার বসুন্ধরা আবাসিক এলাকা থেকে তুলে নেওয়া হয়।
নাগরিক ঐক্যের আহ্বায়ক মাহমুদুর রহমান মান্না বলেন, ‘কারো রাজনৈতিক মতাদর্শ ভিন্ন হওয়ার মানে এই না যে, তাকে গুম করে ফেলতে হবে।’
ইংরেজি থেকে অনুবাদ করেছেন জারীন তাসনিম
আরও পড়ুন:
Comments