প্রবাসে

হোটেল কোয়ারেন্টিন নিয়ে বাহরাইনগামী কর্মীদের দুর্ভোগ, আর্থিক সহায়তার অনুরোধ

বাহরাইন আন্তর্জাতিক বিমানবন্দরে প্রবাসী বাংলাদেশিরা। ছবি: বাংলাদেশ দূতাবাস

কোভিড-১৯ প্রতিরোধে বাহরাইনও বাংলাদেশিদের জন্য নতুন করে কোয়ারেন্টিন বাধ্যতামূলক করেছে। হঠাৎ এমন সিদ্ধান্তে সীমাহীন কষ্টে পড়েছে কর্মস্থলে ফেরা এবং অপেক্ষায় থাকা কম আয়ের সাধারণ প্রবাসীরা। তাই সৌদি আরবের মতো হোটেল কোয়ারেন্টিনে সরকারি সহায়তার দাবি ভুক্তভোগীসহ কমিউনিটি সংগঠনগুলোর। মানবিক বিবেচনায় হোটেল কোয়ারেন্টিনে আর্থিক সহায়তার জন্য সরকারের কাছে অনুরোধপত্র পাঠিয়েছে বাংলাদেশ দূতাবাসও।

দেশটিতে সাম্প্রতিক সময়ে করোনার প্রকোপ বেড়ে যাওয়ায় ২৩মে থেকে বাংলাদেশসহ ৫টি দেশের নাগরিকদের জন্য ১০ দিনের কোয়ারেন্টিন বাধ্যতামূলক করা হয়। নিজের বা পরিবারের কারও নামে ভাড়া বাসা থাকলে হোম কোয়ারেন্টিনে থাকা যাবে। না হলে প্রাতিষ্ঠানিক কোয়ারেন্টিনের জন্য সরকার নির্ধারিত হোটেলে থাকতে হবে। এ ছাড়া আগের নিয়মে দেশ থেকে করোনা নেগেটিভ সনদ আর বাহরাইন বিমানবন্দরে ২টি করোনা পরীক্ষার জন্য ৩৬ দিনার দিতে হবে।

প্রতি বছর ঈদকে সামনে রেখেই বেশি প্রবাসী দেশে ফেরেন। এবার ঈদের সঙ্গে দীর্ঘ লকডাউন-নিষেধাজ্ঞা কাটিয়ে অনেক বাহরাইনপ্রবাসী দেড়-দুই মাস আগেই দেশে ফিরেছিলেন। এখনও অনেকে ফিরে যাচ্ছেন কর্মস্থলে। প্রতিদিন গড়ে ১৭০/১৮০ জন সরাসরি কিংবা ট্রানজিট হয়ে বাহরাইন ফিরছেন বলে বিমানসংস্থাগুলোর সূত্রে জানা গেছে। তবে কতজন হোটেল কোয়ারেন্টিনে আছেন তা নিশ্চিত করা যায়নি।

বাহরাইনের স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয় কোয়ারেন্টিনের জন্য নানা মানের ২৮টি হোটেল নির্ধারণ করে দিয়েছে। সবচেয়ে কম দামের হোটেলে এক রুমে ৩-৪ জন থাকা এবং খাওয়াসহ ১০ দিনের প্যাকেজে ২৫০ দিনার, যা বাংলাদেশি মুদ্রায় ৫৬ হাজার টাকা। শ্রমনির্ভর আরও ৪ দেশের চাহিদা থাকায় কম দামের হোটেলের বুকিংও সহজে পাওয়া যাচ্ছে না। তাই অনেককে ৭০ থেকে ৮০ হাজার টাকা প্যাকেজের দামি হোটেলেও উঠতে হচ্ছে। কিছু প্রবাসী খাবার ছাড়া ১৬০-১৭০ দিনারে প্যাকেজ নিয়েছেন বলে জানা গেছে ।

কমিউনিটি সংগঠকরা জানান, সাধারণ ও মধ্যবিত্ত প্রবাসী কর্মীদের বেশিরভাগেরই নিজের নামে  ভাড়া বাসা নেই। মূলত মেস মালিক বা কোম্পানির দেওয়া বাসা কিংবা ডরমেটরিতে থাকেন তারা। বাধ্য হয়ে এখন হোটেল কোয়ারেন্টিন থাকতে হচ্ছে। ভিসা-চাকরি বাঁচানোর স্বার্থে আত্মীয় স্বজন, ঘনিষ্টজনদের ধার-দেনা করেই হোটেল খরচের ব্যবস্থা করতে হচ্ছে।

বাহরাইনে কোয়ারেন্টিনে আর দেশে অপেক্ষায় থাকা বেশ কয়েকজন প্রবাসীর সঙ্গে কথা বলে এমনই ধারণা পাওয়া গেছে। তারা আরও জানান, করোনাকালে কারো আর্থিক অবস্থাও ভালো না বলে ধার পাওয়াও কঠিন হয়ে পড়েছে। স্বণার্লকার, ফসলি জমি বন্ধক কিংবা চড়া সুদে কোয়ারেন্টিনের খরচ যোগাড় করতে হয়েছে অনেককে।  

রাজধানী মানামায় হোটেল জেসমিন টাওয়ারে এক রুমে আরও ৩ জন বাংলাদেশির সঙ্গে কোয়ারেন্টিনে আছেন ২৬ মে বাহরাইন ফেরা নোয়াখালীর মো. মিন্টু। রিটার্ন টিকিট নিয়ে ফেব্রুয়ারিতে দেশে ফিরেছিলেন। যাত্রার ঠিক আগেই কোয়ারেন্টিন আরোপে ধার-দেনা করেই হোটেল বুকিং দিয়ে ফ্লাইটে উঠেছিলেন ।

ধার শোধের চিন্তায় থাকা এই প্রবাসী বলেন, ‘এই টাকা শোধ  করতে আমাদের মতো সাধারণ কর্মীর সারা বছরের বেতনের অর্ধেকই চলে যাবে। কীভাবে চলবো, দেশে টাকা পাঠাবো ভেবে পাচ্ছি না।’

বাহরাইনি কোম্পানির সাধারণ কর্মী চাঁদপুরের হাজিগঞ্জের মো. রাসেল গত ১৬ মে কর্মস্থলে ফেরার জন্য চড়া দামে গালফএয়ারে টিকিট কেটেছিলেন। কিন্তু লকডাউনে পড়ে আরও ৫০ দিনার মাশুল দিয়ে আগামী ৬ জুনের টিকিট রিকনফার্ম করেন। এরই মধ্যে ১০ দিনের কোয়ারেন্টিন যুক্ত হওয়ায় যাত্রা নিয়ে চিন্তায় পড়েছেন।

‘টিকিটে  ৮৭ হাজার টাকা আর  তিন বার  করোনা পরীক্ষায় ১০ হাজার নিয়ে প্রায় লাখ টাকা খরচ। এরপর কোয়ারেন্টিনে আরও ৫০/৬০ হাজার টাকা কীভাবে যোগাড় করবো ভেবে কূল পাচ্ছি না। কারও কাছে ধারও পাচ্ছি না। ৬ জুন যেতে না পারলে ভিসাও বাতিল হয়ে যাবে। শেষ পর্যন্ত গ্রামের জমিটুকুই বন্ধক রাখতে হবে,’  বলেন মো. রাসেল।

বাংলাদেশ দূতাবাস সূত্রে জানা যায়, সাশ্রয়ী ভাড়ার  ফ্ল্যাটে  কোয়ারেন্টিনের ব্যবস্থার পরিকল্পনা নিয়েছিল দূতাবাস। কিন্তু সুরক্ষার মান নিশ্চিতের স্বার্থে স্বাস্থ্য বিভাগ অনুমতি দেয়নি। এ ছাড়াও  নির্ধারিত হোটেলগুলোর সঙ্গে দেন দরবার করে ভাড়া কমানোরও চেষ্টা করা হচ্ছে। বেশি চাহিদা থাকায় তেমন ছাড় পাওয়া যায়নি। কমিউনিটি সংগঠনগুলোও প্রবাসীদের সহায়তায় নানাভাবে চেষ্টা করছে ।

এমন বাস্তবতায় বাংলাদেশে সরকারের সহায়তা ছাড়া আর কোনো বিকল্প দেখছেন না প্রবাসী সংগঠকরা। অসহায় প্রবাসীদেরও অনেকে দূতাবাসের সঙ্গে যোগাযোগ করে সহায়তা চেয়েছেন।

সহায়তার আবেদন জানিয়ে কমিউনিটি সংগঠন বাংলাদেশ সোসাইটির সভাপতি আসিফ আহমেদ বলেন, 'করোনার শুরু থেকে বাহরাইনে কখনও হোটেলে কোয়ারেন্টিন ছিল না। হঠাৎ করে এমন ব্যবস্থায় সৌদি আরবের মতোই পরিস্থিতিতে পড়েছেন বাহরাইনগামী কর্মীরাও। এমনিতেই করোনা কঠিন সময় পার করছে। তার উপর বাড়তি এই বোঝা, একমাত্র সরকারের আর্থিক সহায়তায় রক্ষা পাওয়া সম্ভব।’

একই মত দিয়ে আওয়ামী লীগের প্রবাসী সংগঠক আলাউদ্দিন নুর বলেন, ‘সৌদিপ্রবাসীদের  জন্য যখন বর্তমান সরকার দ্রুত ব্যবস্থা নিয়েছেন, আমাদের বিশ্বাস সঠিক বার্তা পৌঁছালে বাহরাইনপ্রবাসীরা বঞ্চিত হবে না।’

সোমবার এ বিষয়ে বৈদেশিক কর্মসংস্থান ও প্রবাসী কল্যাণ মন্ত্রণালয়ের কাছে অনুরোধপত্র দিয়েছে বাংলাদেশ দূতাবাস কর্তৃপক্ষ। যারা ফ্যাক্সি ভিসার কর্মী (স্পন্সরবিহীন)  কিংবা  যাদের বেতন ১০০ দিনারের কম  এবং  সিপিআর (central population register) অনুযায়ী সাধারণ কর্মী,  তাদের জন্য ১০ দিনের হোটেল কোয়ারেন্টিনে আর্থিক সহায়তার অনুরোধ জানানো হয়েছে  ।

এমন তথ্য জানিয়ে রাষ্ট্রদূত ড. নজরুল ইসলাম বলেন, ‘বেশিরভাগই কম আয়ের সাধারণ কর্মী। যাদের করোনাকালে চড়া দামে টিকিট কেনা, তিন দফা পিসিআর পরীক্ষার ফি দেওয়ার পর হোটেল কোয়ারেন্টিনের জন্য বাড়তি ৫০/৬০ হাজার টাকা খরচের সামর্থ্য নেই। অর্থের অভাবে সময় মতো ফিরতে না পারলে অনেকের ভিসা বাতিলেরও আশঙ্কা রয়েছে বলে জেনেছি। তাই আমরা সৌদিপ্রবাসীদের মতো বাহরাইনের অসহায় বাংলাদেশি কর্মীদের জন্য মন্ত্রণালয়ের কল্যাণ তহবিল থেকে আর্থিক সহায়তার অনুরোধ জানিয়েছি।’

এজাজ মাহমুদ: ফ্রিল্যান্স সাংবাদিক

Comments

The Daily Star  | English

Produce 10 ex-ministers, 2 advisers to Hasina before tribunal on Nov 18: ICT

They will be shown arrested in case filed over crimes against humanity, genocide, says prosecutor

32m ago