মুক্তিযুদ্ধ

৩১ মে ১৯৭১: সমঝোতার কোনো সুযোগ নেই: মাওলানা ভাসানী

পশ্চিমবঙ্গে সীমান্ত ঘেঁষা একটি শরণার্থী শিবিরের দৃশ্য। ফাইল ছবি এপি

১৯৭১ সালের ৩১ মে ন্যাশনাল আওয়ামী পার্টির সভাপতি মাওলানা আবদুল হামিদ খান ভাসানী বলেন, এখন আর পশ্চিম পাকিস্তানের সঙ্গে কোন ধরনের সমঝোতা, আলোচনা, কিংবা কোনো ধরনের প্রস্তাব নিয়ে বৈঠক হওয়ার সুযোগ নেই। কারণ এখন বাংলাদেশ স্বাধীন একটি দেশ। পাকিস্তান সরকার এখন আন্তর্জাতিক মহলে সমঝোতার জন্য যেসব প্রস্তাব দিয়েছে তাতে কান দিলে বাংলাদেশের সময় নষ্ট হবে।

রাজনৈতিক সমঝোতা নামের প্রহসন পাকিস্তানকে অবিলম্বে বন্ধ করতে হবে। সোভিয়েত ইউনিয়ন, চীন, ভিয়েতনাম এবং আলবেনিয়ার মতো সমাজতান্ত্রিক রাষ্ট্রগুলোর বাংলাদেশ বিষয়ে নীরবতা প্রসঙ্গে মাওলানা ভাসানী বলেন, 'এই মুহূর্তে দুনিয়ার মুক্তিকামী মানুষের পক্ষে এবং অত্যাচারীদের বিরুদ্ধে এই রাষ্ট্রগুলো বাংলাদেশ নিয়ে কিছু বলছে না। ভিয়েতনামের জন্য বাংলাদেশের মানুষ আন্দোলন করেছে, কিন্তু তারাও এখন নিশ্চুপ। আমাদের বর্তমান যুদ্ধ পশ্চিম পাকিস্তানের শোষণ ও অত্যাচারের বিরুদ্ধে বাংলাদেশের সাধারণ মানুষের স্বাধীনতার সংগ্রাম। শোষকের বিরুদ্ধে শোষিতের লড়াই।'

ইন্দিরা গান্ধীর সভাপতিত্বে বৈঠক

৩১ মে ভারতের প্রধানমন্ত্রী ইন্দিরা গান্ধীর সভাপতিত্বে অনুষ্ঠিত ভারতীয় সরকারের নীতি নির্ধারণী রাজনৈতিক কমিটির বৈঠকে বাংলাদেশের পরিস্থিতি নিয়ে আলোচনায় বসে। মূলত এই আলোচনায় বাংলাদেশের পরিস্থিতি, শরণার্থীদের ভারতে আশ্রয় গ্রহণ এবং পরবর্তীতে ভারতীয় সীমান্ত এলাকায় সৃষ্ট উত্তেজনাকর পরিস্থিতির বিষয় পর্যালোচনা করা হয়। সভায় ভারতের পররাষ্ট্রমন্ত্রী সরদার শরণ সিং বলেন, পূর্ব বাংলায় পাকিস্তানি সেনাবাহিনীর কারণে পুরো দক্ষিণ পূর্ব এশিয়া জুড়েই আঞ্চলিক শান্তি ও নিরাপত্তা এখন হুমকির মুখে। জাতিসংঘের নিরাপত্তা পরিষদ চাইলেই এখন নিরাপত্তা পরিষদের বৈঠক ডাকতে পারে। সুতরাং আমাদের এই বিষয়ে এগিয়ে আসা উচিত, যেন এই বিষয়টি পূর্ণাঙ্গভাবে উঠে আসতে পারে। এর আগে এই বৈঠকে জাতিসংঘে নেতৃস্থানীয় জাতিসংঘ নিরাপত্তা পরিষদের স্থায়ী সদস্য মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র, সোভিয়েত ইউনিয়ন, ব্রিটেন ও ফ্রান্সের সঙ্গে সরাসরি যোগাযোগ করার জন্য পররাষ্ট্রমন্ত্রী সরদার সিংকে দায়িত্ব দেওয়া হয়।

পিপিপি চেয়ারম্যান জুলফিকার আলী ভুট্টোর বিবৃতি

পাকিস্তান পিপলস পার্টির (পিপিপি) চেয়ারম্যান জুলফিকার আলী ভুট্টো করাচি থেকে পাঠানো এক বিবৃতিতে এদিন বলেন, পাকিস্তানের রাজনৈতিক সমস্যা সমাধানের জন্য এখন প্রয়োজন অভিজ্ঞ রাজনীতিবিদ ও জনগণ কর্তৃক আস্থাভাজন জনপ্রতিনিধি। শেখ মুজিবুর রহমান যে ভুল করেছেন, আমরা তা করতে পারি না। পাকিস্তান সরকারের উচিত এই মুহূর্তে জনগণ কর্তৃক মনোনীত জনপ্রতিনিধিদের কাছে ক্ষমতা হস্তান্তর করা।

ভারতে মুক্তিযুদ্ধের স্বপক্ষে এদিন

৩১ মে ভারতের কেন্দ্রীয় স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয় শরণার্থী শিবিরগুলোতে কলেরার প্রাদুর্ভাব দেখা দেয়ায় শরণার্থীদের জন্য দশ লাখ কলেরার টিকা ও চল্লিশ লাখ খাবার স্যালাইন প্রেরণ করে।

৩১ মে পশ্চিমবঙ্গের পৌর কাউন্সিলের কাউন্সিলররা পশ্চিমবঙ্গের রাজ্যপালের কাছে বাংলাদেশকে ভারত কর্তৃক স্বীকৃতি দেয়ার দাবি জানিয়ে স্মারকলিপি ও ২৬ মে পৌর করপোরেশনে নেয়া বিভিন্ন প্রস্তাবের অনুলিপি প্রদান করেন। এর আগে কলকাতার মেয়র শ্যামসুন্দর গুপ্তের নেতৃত্বে কেন্দ্রীয় পৌর ভবন থেকে রাজভবন পর্যন্ত কাউন্সিলর ও কর্মকর্তা কর্মচারীদের নিয়ে একটি মিছিল বের করা হয়।

 ৩১ মে দিল্লিতে প্রবাসী বাংলাদেশ সরকারের মুখপাত্র আমজাদুল হক এক বক্তব্যে বলেন, 'পাকিস্তানি হানাদার বাহিনী বাংলাদেশে যে ব্যাপক গণহত্যা চালিয়েছে, এরপর যুক্ত পাকিস্তানের ভিত্তিতে আর কোনো আপস রফার সুযোগ নেই। বাংলাদেশ এখন একটি স্বাধীন ও সার্বভৌম রাষ্ট্র। এর বাইরে রাজনৈতিক সমাধানের কোনো অবকাশ নেই। কেউ সে রকমের চেষ্টা করলে তা অগ্রাহ্য করা হবে। পাকিস্তানি সেনারা বাংলাদেশে যে হত্যালীলা চালিয়েছে, তারপর যুক্ত পাকিস্তানের ভিত্তিতে কোনো আপস অসম্ভব।'

বিশ্বজুড়ে মুক্তিযুদ্ধ সংশ্লিষ্ট এদিনের নানান বিবৃতি ও ঘটনা

৩১ মে শ্রীলঙ্কার পার্লামেন্টে তামিল ফেডারেল পার্টির সদস্য ভি ধর্মালিঙ্গন একটি বেসরকারি প্রস্তাব উত্থাপনে বলেন, শেখ মুজিবুর রহমানের নেতৃত্বে গঠিত বাংলাদেশ সরকারকে শ্রীলঙ্কার স্বীকৃতি দেয়া উচিত।

৩১ মে এম এইচ উইহেনের নেতৃত্বে বিশ্বব্যাংক ও আন্তর্জাতিক অর্থ তহবিলের পক্ষ থেকে পাকিস্তানের বৈদেশিক সাহায্যের প্রয়োজনীয়তা যাচাই নিরূপণের জন্য আট সদস্যের প্রতিনিধি দলের ছয় সদস্য পূর্ব পাকিস্তানের উদ্দেশে ওয়াশিংটন ত্যাগ করেন।

৩১ মে কৃষক শ্রমিক পার্টির প্রধান এ এস এম সোলায়মান পাকিস্তান সরকারের প্রতিনিধি হিসেবে সুইজারল্যান্ডের জেনেভার উদ্দেশ্যে দেশত্যাগ করেন। যাওয়ার আগে তিনি বলেন, অখণ্ড পাকিস্তান রক্ষায় আমাদের যতোখানি কঠোর হতে হয় আমরা হবো। দেশদ্রোহী আওয়ামী লীগ ও মুক্তিবাহিনীর কবল থেকে আমরা আমাদের দেশকে রক্ষা করবো।

৩১ মে কনভেনশন মুসলিম লীগের প্রাদেশিক সাধারণ সম্পাদক এ এন এম ইউসুফ এক বক্তব্যে বলেন, 'ভারতীয় আক্রমণ থেকে পাকিস্তানকে রক্ষা করার জন্য পূর্ব পাকিস্তানিরা প্রস্তুত। তারা আওয়ামী লীগের দেশভাগের উদ্দেশ্য উপলব্ধি করতে পেরে এখন দলটির ফ্যাসিবাদী কাজের বিরুদ্ধে রুখে দাঁড়িয়েছে। এদেশের মানুষই পাকিস্তানকে ভারতীয় চরদের হাত থেকে রক্ষা করবে। ভারতের ষড়যন্ত্র কোনোভাবেই বাস্তবায়ন করতে দেয়া হবে না।'

৩১ মে পাকিস্তান জমিয়তুল ইসলামের সাধারণ সম্পাদক মাওলানা হাজারভী ভারতীয় প্রচারণা মোকাবিলার উদ্দেশ্যে বিদেশে প্রতিনিধি পাঠানোর জন্য আহ্বান জানান। তিনি বলেন, 'ভারতীয় ষড়যন্ত্রকে নস্যাৎ করতে হবে। ভারত এখন আন্তর্জাতিকভাবে পাকিস্তানের গায়ে কালিমা লেপন করছে। দেশত্যাগ কারী মানুষকে শরণার্থী হিসেবে ঘোষণা করে আন্তর্জাতিকভাবে অপপ্রচার চালাচ্ছে। আওয়ামীলীগকে সাহায্যের নাম দিয়ে পাকিস্তান ভাঙার ষড়যন্ত্র করছে।'

দেশজুড়ে গণহত্যা, প্রতিরোধযুদ্ধ

৩১ মে রাতে লেফটেন্যান্ট মাহবুবের নেতৃত্বে এক প্লাটুন যোদ্ধা কুমিল্লার দক্ষিণে জগমোহনপুরে হানাদারদের ঘাঁটিতে অতর্কিত হামলা চালায়। এই হামলায় পাকিস্তানি হানাদার বাহিনীর ১২ সৈন্য নিহত হয়।

৩১ মে মুক্তিযোদ্ধারা কুমিল্লার সিঙ্গারবিলে হানাদারদের ওপর অ্যামবুশ করে। এ আক্রমণে হানাদার বাহিনীর ১৩ সৈন্য নিহত হয়।

৩১ মে পাকিস্তানি হানাদারদের কাছ থেকে দখলকৃত শালদা রেলওয়ে স্টেশনে সুবেদার আবদুল হক ভূঁইয়ার নেতৃত্বে ৬ জন মুক্তিযোদ্ধার একটি দল হানা দেয়। এ অভিযানে ২ হানাদার সেনা নিহত হয়।

তথ্যসূত্র-

বাংলাদেশের স্বাধীনতা যুদ্ধের দলিলপত্র নবম, দ্বাদশ ও ত্রয়োদশ খণ্ড। 

দৈনিক পাকিস্তান, ১ জুন ১৯৭১ 

দৈনিক অমৃতবাজার পত্রিকা, ১ জুন ১৯৭১

আহমাদ ইশতিয়াক

[email protected]

Comments

The Daily Star  | English

Polls could be held in mid-February

Chief Adviser Prof Muhammad Yunus has said the next general election could be held in the week before the start of Ramadan in 2026.

2h ago