বাজেট: প্রবাসীদের প্রত্যাশা

বাংলাদেশের অর্থনীতির সবচেয়ে শক্তিশালী সূচক প্রবাসী আয়। প্রবাসীদের পাঠানো অর্থে দেশের রিজার্ভ দিনকে দিন শক্তিশালী হলেও বাজেটে তাদের জন্য তেমন কোনো বরাদ্দ থাকে না। নগদ প্রণোদনা ছাড়া বর্তমানে প্রবাসীদের জন্য নামেমাত্র যেই বাজেট আছে, তা মূলত প্রবাসীদের জন্য নয়। সেটি ব্যয় হয় প্রবাসী কল্যাণ মন্ত্রণালয়ের নিজস্ব খরচের খাতে। প্রবাসীদের সরাসরি উন্নয়ন খাতে ব্যবহারের জন্য নির্দিষ্ট কোনো বরাদ্দ থাকে না। অথচ প্রবাসীদের পাঠানো বৈদেশিক মুদ্রা আমাদের অর্থনীতির বুনিয়াদ ধরে রেখেছে।
ফাইল ছবি

বাংলাদেশের অর্থনীতির সবচেয়ে শক্তিশালী সূচক প্রবাসী আয়। প্রবাসীদের পাঠানো অর্থে দেশের রিজার্ভ দিনকে দিন শক্তিশালী হলেও বাজেটে তাদের জন্য তেমন কোনো বরাদ্দ থাকে না। নগদ প্রণোদনা ছাড়া বর্তমানে প্রবাসীদের জন্য নামেমাত্র যেই বাজেট আছে, তা মূলত প্রবাসীদের জন্য নয়। সেটি ব্যয় হয় প্রবাসী কল্যাণ মন্ত্রণালয়ের নিজস্ব খরচের খাতে। প্রবাসীদের সরাসরি উন্নয়ন খাতে ব্যবহারের জন্য নির্দিষ্ট কোনো বরাদ্দ থাকে না। অথচ প্রবাসীদের পাঠানো বৈদেশিক মুদ্রা আমাদের অর্থনীতির বুনিয়াদ ধরে রেখেছে।

জনশক্তি কর্মসংস্থান ও প্রশিক্ষণ ব্যুরো (বিএমইটি) এবং বিভিন্ন সরকারি-বেসরকারি চ্যানেলের মাধ্যমে জানা যায়, বর্তমানে প্রায় এক কোটি ৩০ লাখের বেশি বাংলাদেশি অভিবাসী কর্মরত রয়েছে বিশ্বের ১৭৪টি দেশে। যার মধ্যে গত ১০ বছরেই কর্মসংস্থান হয়েছে ৬৬ লাখ ৩৩ হাজারের মতো। অভিবাসীদের বড় অংশটি থাকে মধ্যপ্রাচ্যের বিভিন্ন দেশে। যেসব ১০টি দেশ থেকে প্রবাসী আয় সবচেয়ে বেশি আসে, তার মধ্যে সৌদি আরব, সংযুক্ত আরব আমিরাত, কুয়েত, ওমান, কাতার, মালয়েশিয়া, যুক্তরাষ্ট্র, যুক্তরাজ্য, ইতালি ও সিঙ্গাপুর উল্লেখযোগ্য।

এই ১০টি দেশ থেকে মোট প্রবাসী আয়ের ৮৯ শতাংশ এসেছে। ২০১৬ থেকে ২০১৯ সালে (জানুয়ারি থেকে ডিসেম্বর) দেশের বাইরে থেকে আসা বাৎসরিক গড় রেমিট্যান্সের পরিমাণ ছিল ১৫ দশমিক ২৫ বিলিয়ন মার্কিন ডলার। ২০২০ সালে তা বেড়ে গিয়ে ২১ দশমিক সাত বিলিয়ন ডলারে পৌঁছায়। করোনার এই সংকটকালেও প্রবাসীরা রেমিট্যান্স পাঠানো বন্ধ করেনি। করোনাকালে ২২ বিলিয়ন ডলার রেমিট্যান্স পাঠিয়ে ৪৩ বিলিয়ন ডলারের বৈদেশিক মুদ্রার ভাণ্ডার গড়ে তুলতে সহায়তা করেছিল প্রবাসী কর্মীরা।

প্রবাসীদের রেমিট্যান্স পাঠাতে বর্ধিত ব্যয় লাঘব করা ও বৈধ পথে অর্থ পাঠানো উৎসাহিত করতে সরকার দুই শতাংশ প্রণোদনা দেওয়ায় প্রবাসীদের রেমিট্যান্স পাঠানোর ক্ষেত্রে ইতোমধ্যে একটি দৃশ্যমান ঊর্ধ্বগতি প্রতীয়মান হয়েছে। বৈদেশিক মুদ্রা উপার্জনের ক্ষেত্রে আমাদের রপ্তানি আয় দ্বিমুখী ট্র্যাফিক হওয়া সত্ত্বেও সরকার যে পরিমাণ সুযোগ-সুবিধা দিচ্ছে, যেমন: ব্যাংক ঋণ, ক্যাশব্যাক প্রণোদনা, কর মওকুফ, শুল্কমুক্ত বাণিজ্য সুবিধা ইত্যাদি; সেই তুলনায় একমুখী ট্র্যাফিকের প্রবাসী রেমিট্যান্সের ক্ষেত্রে দুই শতাংশ প্রণোদনা একেবারে অপ্রতুল।

তাই প্রবাসীদের অর্থ পাঠানোর ক্ষেত্রে এই দুই শতাংশ প্রণোদনা বাড়িয়ে চার শতাংশ করা দাবি জানাচ্ছি। এরকম উদ্যোগ নিলে অপ্রাতিষ্ঠানিক মাধ্যম, যেমন: অবৈধ হুন্ডি, বিকাশ, রকেটের পরিবর্তে প্রাতিষ্ঠানিক ব্যাংকিং চ্যানেলের মাধ্যমে অর্থ স্থানান্তরের পরিমাণ বাড়বে। অন্যদিকে রেমিট্যান্সের প্রাপকদের তারল্যের পরিমাণ বেড়ে যাবে এবং গ্রামীণ অর্থনীতি প্রবৃদ্ধির হারও বেড়ে যাবে।

পক্ষান্তরে, করোনা মহামারির কারণে ইতোমধ্যেই সাত লাখের মতো প্রবাসী কর্মীকে দেশে ফিরতে হয়েছে। কিন্তু, যে কর্মী দেশে ফিরে এসেছে তাদের পুনর্বাসন ও কর্মসংস্থানের বিষয়ে অতীতের কোনো বাজেটে প্রয়োজনীয় বরাদ্দ ছিল না। প্রবাসী কল্যাণ ও বৈদেশিক কর্মসংস্থান মন্ত্রণালয়ের জন্য প্রস্তাবিত বাজেটে কখনো ক্ষতিগ্রস্ত বিদেশফেরত অভিবাসী কর্মী ও তাদের পরিবারের সদস্যদের যথাযথ পুনর্বাসন ও টেকসই কর্মসংস্থান সৃষ্টির ব্যবস্থা থাকে না। শিক্ষা, স্বাস্থ্যসহ নানা ক্ষেত্রে প্রবাসীদের জন্য বরাদ্দ রাখা উচিত। একইসঙ্গে বাজেটে বিদেশফেরত প্রবাসীদের বিকল্প কর্মসংস্থান ব্যবস্থাপনার দাবি জানাচ্ছি। অনেক আগেই প্রবাসীদের বীমা সুবিধার আওতায় আনা দরকার ছিল।  যাহোক, একেবারে না হওয়ার চেয়ে দেরিতে হওয়া ভালো। এখন সময় সব বিদেশগামী প্রবাসী কর্মীদের বীমা সুবিধার আওতায় আনার।

২০২০ সালের ৩ ডিসেম্বর থেকে ওয়েজ আর্নার ডেভেলপমেন্ট বন্ড, ইউএস ডলার প্রিমিয়াম বন্ড ও ইউএস ডলার ইনভেস্টমেন্ট বন্ডের বিপরীতে সমন্বিত বিনিয়োগের ঊর্ধ্বসীমা এক কোটি টাকার সমপরিমাণ বৈদেশিক মুদ্রায় বেঁধে দেওয়া হয়েছে। এই সিদ্ধান্ত আমার কাছে আত্মঘাতী মনে হয়েছে। এর আগে বিনিয়োগের কোনো ঊর্ধ্বসীমা বা সীমাবদ্ধতা ছিল না, থাকা উচিতও নয়। প্রবাসীদেরকে বিনিয়োগমুখী করতে এবারের বাজেটে বন্ডের এই সীমাবদ্ধতা উঠিয়ে নেওয়া হবে— এমন প্রত্যাশা করছি।

ওয়েজ আর্নার্স কল্যাণ বোর্ড প্রবাসীদের কল্যাণের বিপরীতে বিষফোঁড়ায় পরিণত হয়েছে। ইতোমধ্যে এই বোর্ড নিয়ে অনেক অভিযোগ ও সংশয়ের সূত্রপাত হয়েছে। অনেকে এই বোর্ডের পুরোদস্তুর অডিট করার দাবিতে সোচ্চার। প্রবাসীদের জন্য প্রভিডেন্ট ফান্ড বা ভবিষ্যৎ তহবিলের মতো একটি সঞ্চয় স্কিম চালু যেতে পারে। যাতে কক্সবাজার সদরের মঞ্জুর আলমের মতো সর্বস্বান্ত হয়ে বউ-সন্তানের হাতে কাউকে প্রাণ হারাতে না হয়।

সারাজীবন পরিশ্রম করে শেষ বয়সে অনেক প্রবাসীকে খালি হাতে দেশে ফিরতে হয় এবং মানবেতর জীবনযাপন করতে হয়। প্রবাসীদের ত্যাগ-বিসর্জনের কথা মাথায় রেখে সরকারি চাকরিজীবীদের মতো পেনশন স্কিম চালু করার দাবি জানাচ্ছি। পেনশন প্রকল্পের সুফল সব শ্রেণি-পেশার প্রবাসী ভোগ করবে। সরকারি চাকরিজীবীরা যেমন একটি নির্দিষ্ট পরিমাণ অর্থ সরকারি প্রভিডেন্ট ফান্ডে জমা দিয়ে শেষ বয়সে পেনশনের আওতাধীন হতে পারেন, তেমনি নির্দিষ্ট পরিমাণ অর্থ সরকারের প্রভিডেন্ট ফান্ডে দিয়ে শেষ বয়সে পেনশনের সুবিধা ভোগ করার ব্যবস্থা করে দেওয়া হোক দেশ, পরিবারের জন্য জীবনের সিংহভাগ উজাড় করে দেওয়া এসব প্রবাসীদের।

নির্দিষ্ট সময় শেষে অভিবাসীরা বিদেশে ব্যবহৃত নিজের গাড়ি দেশে নেওয়ার যে দাবিটা জানায়, সত্যি বলতে সেটা প্রবাসীদের প্রাণের দাবি। সেক্ষেত্রে সরকার নির্দিষ্ট একটা সময় ও অঙ্ক স্থির করে দিতে পারে, যেমন: অভিবাসী যারা ন্যূনতম ১২ বছর অভিবাসী হিসেবে দেশের বাইরে আছে এবং একই সময়ে দুই লাখের বেশি ডলার সমপরিমাণ টাকা ব্যাংকিং চ্যানেলের মাধ্যমে দেশে পাঠিয়েছেন, তারা ‘স্বল্প’ আমদানি শুল্ক, আবগারি শুল্ক, পরিপূরক শুল্ক, ভ্যাট দিয়ে দেশে গাড়ি নিতে পারবে।

বাংলাদেশে সংসদ সদস্য, কূটনীতিক ও সুবিধাপ্রাপ্ত ব্যক্তিদের ক্ষেত্রে আমদানি শুল্ক ছাড়া গাড়ি আমদানি করার অনুমতি রয়েছে। সেক্ষেত্রে বাংলাদেশের পাসপোর্টধারী, দেশের পতাকা বহনকারী, বাংলাদেশের শিক্ষা, সংস্কৃতি, সভ্যতাকে বহির্বিশ্বে ফেরি করা প্রবাসী রাজদূতদের গাড়ি নিয়ে যাওয়ার এমন সুযোগ করে দেওয়া এখন সময়ের দাবি।

নুর মোহাম্মদ: প্রবাসী সাংবাদিক, প্রাবন্ধিক ও বাংলাদেশ কমিউনিটি কাতারের যুগ্ম সাধারণ সম্পাদক

Comments