বাজেট ২০২১-২২: একটি হারানো সুযোগ
মহামারির মাঝে নাগরিকদের জীবন জীবিকাকে সুরক্ষিত করতে গত বাজেটে সরকার বেশ কিছু গুরুত্বপূর্ণ খাতকে প্রাধান্য দিয়েছিল। কিন্তু করোনার দ্বিতীয় ঢেউয়ে বেশ কিছু উদ্যোগ বাস্তবায়ন বাধাগ্রস্ত হয়, যার কারণে প্রত্যাশিত সাফল্য আসেনি।
মহামারি থেকে উত্তরণ ও অর্থনৈতিক পুনরুদ্ধারকে লক্ষ্য রেখে অর্থমন্ত্রী আ হ ম মুস্তফা কামাল ২০২০-২১ অর্থবছরের বাজেট প্রণয়ন করেছিলেন। নজিরবিহীন এই পরিস্থিতিতে প্রত্যাশিতভাবেই তিনি স্বাস্থ্য, কৃষি, সামাজিক নিরাপত্তা, কর্মসংস্থান ও চাকরি রক্ষার মতো বিষয়গুলোকে বেশি প্রাধান্য দিয়েছিলেন।
অর্থমন্ত্রী একটি সুবিস্তৃত বাজেট তৈরি করেছিলেন, যেখানে ঘাটতির পরিমাণ স্বস্তিদায়ক পর্যায় পাঁচ শতাংশকে ছাড়িয়ে গিয়েছিল। মন্ত্রণালয় ও বিভাগগুলোর জন্য উপযুক্ত পরিমাণে তহবিল বরাদ্দ করা হয়েছিল যাতে তারা যেকোনো জরুরি প্রয়োজন মেটাতে পারে এবং দেশ যাতে সংকট থেকে বেরিয়ে আসতে পারে।
তিনি উন্নয়ন প্রকল্পগুলোকে প্রাধান্য দিয়েছিলেন। তিনি অলাভজনক পাট ও চিনিকলগুলোকে বন্ধ করে দিয়েছিলেন এবং অপ্রয়োজনীয় সরকারি খরচের খাতগুলোতে বাজেট কমিয়ে দিয়েছিলেন যাতে দুর্দিনের জন্য কিছু বাড়তি অর্থ সরকারের হাতে থাকে।
দুই মাসের লকডাউনের পরে বাজেট ঘোষণার মাসটিতেই আবার অর্থনীতির চাকা সচল হয়। শ্রমিকরা কারখানায় ফিরে যায়। জনসাধারণের চলাফেরাও বাড়তে থাকে। জানুয়ারিতে আমাদের হাতে ভ্যাকসিন চলে আসার পর সরকারের ভূমিকা আরও প্রশংসিত হয় এবং সর্বক্ষেত্রে মানুষের মাঝে ইতিবাচক মনোভাব দেখা দেয়।
মানুষজন তাদের পুরনো অভ্যাসে ফিরতে শুরু করে এবং এক পর্যায়ে মহামারির ঝুঁকিকে অবজ্ঞা করতে শুরু করে। স্বাস্থ্য সুরক্ষায় শিথিলভাবে বাস্তবায়িত বিধিনিষেধগুলোকে মানুষ অবহেলা করতে থাকে, যার কারণে দ্বিতীয় ঢেউ এর আঘাতে সমগ্র দেশের বাসিন্দারা অপ্রস্তুত হয়ে পড়েন।
অল্প দিনের মাঝেই ব্যাপারটি পরিষ্কার হয়ে যায় আপাত বিপদ কাটতেই আসন্ন দুঃসময়ের কোনো প্রস্তুতির উদ্যোগ নেওয়া হয়নি এবং প্রচুর মূল্যবান সময় অপচয় করা হয়েছে।
গত বছরে সংকট যখন তুঙ্গে তখনকার হিসাব বলছে দারিদ্র্য দ্বিগুণ হয়েছে এবং অন্তত এক কোটি মানুষ নতুন ভাবে দরিদ্র হয়েছেন। সর্বোচ্চ ৮০ শতাংশ পর্যন্ত মানুষের আয় কমে গেছে।
সেন্টার ফর পলিসি ডায়লগের একটি সমীক্ষায় দেখা যায়, যারা গত বছরের এপ্রিল থেকে মে মাসের মাঝে অর্থনৈতিক মন্দার কারণে চাকরি হারিয়েছিলেন তাদের প্রায় সবাই এ বছরের ফেব্রুয়ারি মাসের মধ্যেই আবার কাজ খুঁজে পেয়েছেন। তবে এ সমীক্ষায় অংশ নেওয়া ৮৬ শতাংশ মানুষ উল্লেখ করেছেন যে তারা তাদের প্রয়োজন অনুযায়ী যথেষ্ট আয় করতে পারছেন না।
সরকার গরিবদের দুঃখ দুর্দশা কমানোর জন্য সামাজিক নিরাপত্তা বলয়ের আওতা বাড়ানোর প্রকল্পগুলোর ওপর বিশেষ প্রাধান্য দিয়েছিল। কিন্তু শেষ পর্যন্ত গরিব ও অসহায়, সম্মুখসারির কর্মী এবং নিম্ন আয়ের কৃষকদের জন্য বরাদ্দ করা ২৫ হাজার কোটি টাকার প্যাকেজের দুই তৃতীয়াংশ খরচ করা যায়নি।
ডিসেম্বরে সরকারের একটি সমীক্ষায় জানা যায় শহরে বসবাসকারী দরিদ্রদের বড় অংশকেই সামাজিক নিরাপত্তা বলয়ের আওতায় আনা যায়নি এবং তারা খাবার পেতে অনিশ্চয়তায় ভুগছেন।
সম্প্রতি এই প্রকল্পগুলোর বাস্তবায়নে গতি এসেছে।
স্বাস্থ্য খাতে প্রাধান্য দেওয়ার পরও সরকার ভঙ্গুর স্বাস্থ্য ব্যবস্থাকে শক্ত ভিতে দাঁড় করাতে পারেনি। তারা বর্তমান অর্থবছরের প্রথম ১০ মাসে এই খাতের উন্নয়ন বাজেটের মাত্র ২৬ শতাংশের বাস্তবায়ন করতে পেরেছে।
প্রতি বছরের মতো এবারও কৃষি খাত খুব ভাল করেছে, যা দেশকে এই সংকট কাটিয়ে উঠতে সাহায্য করেছে। তবে এরপরেও সরকার প্রয়োজন অনুযায়ী খাদ্য সামগ্রী মজুত করতে ব্যর্থ হয়। এর পেছনে সরকারের নির্ধারণ করা মূল্যে (যা বাজার মূল্যের চেয়ে কম) কৃষকদের পণ্য বিক্রি করার ক্ষেত্রে অনীহাই মূলত দায়ী।
আগাম আমদানির মাধ্যমে খাদ্য মজুত বাড়িয়ে রাখা খুবই গুরুত্বপূর্ণ ছিল কারণ এক মৌসুমের শস্য উৎপাদনের পরিমাণ প্রত্যাশা অনুযায়ী না হলে পুরো পরিস্থিতির অবনতি হতে পারে এবং সরকারকে বেশি দাম দিয়ে আন্তর্জাতিক বাজার থেকে চাল সংগ্রহ করতে হতে পারে।
রাজস্ব ব্যয় সংকোচনের ব্যাপারটি প্রশংসনীয়, কিন্তু এতে অর্থনীতির তেমন কোনো উপকার হয়নি কারণ উন্নয়ন প্রকল্পগুলোতে ব্যয়ের ক্ষেত্রে গতি বাড়েনি।
সবচেয়ে উদ্বেগজনক হলো মহামারি মোকাবিলা ও দরিদ্রদের সাহায্য করার মূল দায়িত্ব যাদের হাতে ছিল, সে মন্ত্রণালয়গুলোই এ ক্ষেত্রে সবচেয়ে খারাপ ফলাফল দেখিয়েছে।
দেশে ফিরতে বাধ্য হওয়া প্রবাসী কর্মীদের জন্য কিছুই করা হয়নি, যদিও তারা এবং বিদেশের মাটিতে শ্রম দেওয়া আরও প্রায় এক কোটি মানুষ অর্থনীতিকে ভালো ও খারাপ সময়ে সাহায্য করে গিয়েছেন নিরন্তর।
কুটির, অতিক্ষুদ্র, ক্ষুদ্র ও মাঝারি শিল্প প্রতিষ্ঠানগুলো দেশের অর্থনীতির ভিত্তি হওয়ার পরেও খুব একটা মনোযোগ পায়নি।
কোভিড ভ্যাকসিনের সরবরাহ অব্যাহত রাখতে না পারাও হতাশাজনক ছিল।
অর্থনৈতিক কর্মকাণ্ডের স্থবিরতার কারণে রাজস্ব আদায়ের হার প্রত্যাশা অনুযায়ী বাড়েনি। ২০২০-২১ অর্থ বছরের জন্য নির্ধারিত রাজস্ব আদায়ের লক্ষ্যমাত্রা এবারও পূরণ হবে না, যেমনটি হয়নি গত অর্থবছরেও, যখন প্রথম বারের মতো বাংলাদেশ রাজস্ব আদায়ের ক্ষেত্রে নেতিবাচক প্রবৃদ্ধির হার অর্জন করে।
মহামারির আঘাতে অর্থনীতি জর্জরিত হওয়ার কারণে সরকার জিডিপি প্রবৃদ্ধির পূর্বাভাষকে ৭ দশমিক ৪ শতাংশ থেকে কমিয়ে ৬ দশমিক ১ শতাংশে নামিয়ে এনেছে।
তবে সরকার কালো টাকাকে সাদা করার লক্ষ্যমাত্রা অর্জন করেছে। একটি নজিরবিহীন কর প্রণোদনাকে কাজে লাগিয়ে রেকর্ড পরিমাণ ১৪ হাজার ২৯৫ কোটি টাকা ২০২০-২১ অর্থবছরের প্রথম নয় মাসে বৈধ করা হয়েছে। সরকার অনুপার্জিত সম্পদে মাত্র ১০ শতাংশ করের বিনিময়ে বৈধ করে নেওয়ার সুযোগ দিয়েছে এবং এক্ষেত্রে সম্পদের উৎস সম্পর্কে কোনো প্রশ্ন তোলার সুযোগ রাখা হয়নি।
১০ শতাংশ কর দিয়ে অনুপার্জিত সম্পদ বৈধ করার সুযোগ কি সাজা নাকি পুরস্কার সেটি নিয়ে তর্কের সুযোগ আছে, কারণ সুস্পষ্টই এখানে কালো টাকার মালিকদেরকে সাধারণ করদাতাদের চেয়ে অধিক সুবিধা দেওয়া হয়েছে, যারা অনেকেই ক্ষেত্রবিশেষে ২৫ শতাংশ পর্যন্ত কর দিতে বাধ্য হন।
সরকার সংস্কার কার্যক্রমের ক্ষেত্রেও খুব একটা ভালো কিছু করে দেখাতে পারেনি।
একটি উদাহরণ হচ্ছে মূল্য সংযোজন কর ও সম্পূরক শুল্ক আইন, যেটি ২০১২ সালে তৈরি হয়েছিল, কিন্তু এটির বাস্তবায়ন হয়েছে মাত্র দুই বছর আগে এবং বাস্তবায়নের ক্ষেত্রেও কিছুটা আপোষ করা হয়েছে।
বাস্তবায়ন হওয়ার পরেও ভ্যাট আদায় বাড়ানোর জন্য প্রয়োজনীয় অবকাঠামোর অভাবে দেশ এই আইনের সুফল সম্পূর্ণরূপে ভোগ করতে পারছে না।
তবে সরকার ব্যবসা কার্যক্রম বাড়ানোর জন্য ও সরকারি অর্থ বাঁচানোর কিছু উদ্যোগ হাতে নিয়েছিল।
নভেম্বরে সংসদে একটি আইন পাশ হয় যার মাধ্যমে একজন ব্যক্তি এককভাবে একটি কোম্পানি চালু করতে পারেন। এই আইনের উদ্দেশ্য ছিল উদ্যোক্তা ও বিনিয়োগকারীদের উৎসাহ দেওয়া এবং ক্ষুদ্র ও মাঝারী শিল্প প্রতিষ্ঠানগুলোকে সহায়তা দেওয়া।
সরকার অলাভজনক ২৫টি পাটকল ও সাতটি চিনিকল বন্ধ করে দেয়। তাদের এই উদ্যোগের মাধ্যমে সরকার এটাই বোঝানোর চেষ্টা করেছে যে তারা আর অলাভজনক রাষ্ট্রীয় প্রতিষ্ঠানগুলোর পেছনে আর অর্থ ব্যয় করতে উৎসাহী নয়।
তারা একই সঙ্গে টেলিটকের মতো রাষ্ট্রীয় প্রতিষ্ঠানগুলোকে স্বনির্ভর হওয়ার অনুরোধ জানায়।
ডিজিটালাইজেশনের ক্ষেত্রে বেশ কিছু কার্যকর উদ্যোগ নেওয়া হয়েছে।
সমাজকল্যাণ মন্ত্রণালয়, যারা বড় অংকের তহবিল ব্যয় করে সামাজিক নিরাপত্তা কর্মসূচির পেছনে এবং অন্যান্য কিছু মন্ত্রণালয় তহবিল বিতরণের জন্য মোবাইল ফাইনান্সিয়াল সার্ভিস (এমএফএস) ব্যবহার করছেন, যা জবাবদিহি নিশ্চিত করে এবং তছরুপ ঠেকায়।
আগে সরকার শুধুমাত্র শিক্ষা খাতে ভাতা দেওয়ার জন্য এমএফএস ব্যবহার করত।
এছাড়াও বাংলাদেশ ব্যাংক অতি ক্ষুদ্র বিক্রেতা ও সুবিধাবঞ্চিত ব্যবসা প্রতিষ্ঠানগুলোকে এমএফএস মার্চেন্ট একাউন্ট খোলার সুবিধাটি দিয়েছে, যাতে তারা ডিজিটাল মাধ্যমে তাদের পণ্যের বিক্রয় মূল্য সংগ্রহ করতে পারে।
বছর জুড়ে সহনীয় মাত্রার মুদ্রাস্ফীতি, সন্তোষজনক কৃষি উৎপাদন, স্থিতিশীল মুদ্রা বিনিময় হার, মাঝারি রপ্তানি, রেকর্ড পরিমাণ বৈদেশিক মুদ্রার রিজার্ভ, রেমিট্যান্স এবং বিদেশি অনুদানের অবিরাম সরবরাহের বিষয়গুলো অর্থমন্ত্রীকে সহায়তা করেছে।
কোভিড মহামারি আঘাত হানার পর থেকে অর্থমন্ত্রী প্রয়োজনীয় তহবিল জোগাড় করার ক্ষেত্রে কোন দ্বিধা করেননি। এখন তাকে বিভিন্ন উদ্যোগ বাস্তবায়নের ক্ষেত্রে সমস্যাগুলোর মূলে যেতে হবে এবং এগুলোর সমাধান করতে হবে, যাতে সরকার আবারও তীর ছেড়ে যাওয়া নৌকায় উঠতে ব্যর্থ না হয়।
ইংরেজি থেকে অনুবাদ করেছেন মোহাম্মদ ইশতিয়াক খান
Comments