আসছে কর কর্তনের বাজেট
আগামীকাল বৃহস্পতিবার অর্থমন্ত্রী এএইচএম মুস্তাফা কামাল সংসদে তৃতীয়বারের মতো যে বাজেট বক্তৃতা দিতে যাচ্ছেন তার কোরাস হতে পারে- ‘কর্তন, কর্তন, কর্তন!’
করোনাভাইরাস মহামারির দ্বিতীয় ঢেউয়ের কারণে থমকে যাওয়া অর্থনীতিকে পুনরুদ্ধারের প্রত্যয় নিয়ে আসছে বাজটের লক্ষ্য থাকবে প্রবৃদ্ধির অসাধারণ সেই গতিকে পুনরুজ্জীবিত করা, যা ভারতীয় উপমহাদেশে মাথাপিছু আয়ে বাংলাদেশকে শীর্ষ স্থানে নিয়ে গেছে।
এই বাজেটে অগ্রাধিকার পাবে দেশের মানুষের ক্রয়ক্ষমতা অর্থবহভাবে বাড়ানো ও কর্মসংস্থান তৈরির বিষয়গুলো। কর কর্তন, কর অবকাশ ও কর অব্যাহতির মতো সুবিধা দিয়ে এই উদ্দেশ্য হাসিলের আশা করছেন অর্থমন্ত্রী।
এসব উদ্যোগের মধ্যে সবচেয়ে আনন্দের হতে পারে করপোরেট কর আড়াই শতাংশ কমিয়ে আনার বিষয়টি। যা বেসকারি খাতের দীর্ঘদিনের দাবি।
এই মুহূর্তে করপোরেট করের হার ২৫ থেকে ৪৫ শতাংশের মধ্যে।
আগামী অর্থবছর থেকে এক ব্যক্তির কোম্পানি আইন কার্যকর হতে পারে। সেক্ষেত্রে এ ধরনের কোম্পানিগুলোর জন্য ২৫ শতাংশ করপোরেট কর ধার্য করা হয়েছে।
আর ২০২১-২২ অর্থবছরের বাজেটে সবচেয়ে দুঃসাহসিক ব্যবস্থাটি হচ্ছে আমদানি-বিকল্প পণ্য যেমন গাড়ি উৎপাদনের ক্ষেত্রে ১০ বছরের কর অবকাশ সুবিধা দেওয়া হতে পারে। যা মোদি সরকারের ‘মেক ইন ইন্ডিয়া’র মতো একটা উদ্যোগ।
অর্থ মন্ত্রণালয়ের কর্মকর্তরা বলছেন, বিশেষ পরিস্থিতিতে এই কর অবকাশ সুবিধা আরও ১০ বছরের জন্য বাড়তে পারে।
এদিকে দেশে তৈরি স্যানিটারি পণ্যের ক্ষেত্রে যে ১০ শতাংশ মূল্য সংযোজন করের বিধান আছে তা তুলে দেওয়া হতে পারে। এটি আমদানিনির্ভর পণ্য থেকে ক্রেতাদের মনোযোগ ফেরানোর জন্য আরেকটি পদক্ষেপ।
এ ছাড়া মহামারিতে রুগ্ন হয়ে পড়া দেশি শিল্পকে উঠে দাঁড়ানোর সুযোগ দিতে উৎপাদনের কাঁচামাল আমদানির ক্ষেত্রে অগ্রিম আয়কর ১ শতাংশ কমানো হতে পারে।
চলমান মহামারিতে দেশের স্বাস্থ্য অবকাঠামোর শোচনীয় অবস্থা উন্মুক্ত হয়ে পড়েছে। এই সমস্যার সমাধানে সরকার ঢাকার বাইরে অন্তত আড়াই শ শয্যার হাসপাতাল নির্মাণের ক্ষেত্রে ১০ বছরের কর অবকাশ সুবিধা বাড়ানোর সিদ্ধান্ত নিয়েছে।
দেশের বিপুল জনসংখ্যাকে দক্ষ করে গড়ে তুলে জনশক্তিতে রূপান্তরের লক্ষ্যে ভোকেশনাল ট্রেনিং সেন্টার স্থাপনের বিষয়টিও কম করপোরেট করের সুবিধা পেতে পারে।
ডিজিটালাইজেশনের ক্ষেত্রে বিপুল গতি আনা এই মহামারি প্রযুক্তির সুবিধাকে সবার সামনে হাজির করেছে।
এই পরিস্থিতিতে চতুর্থ শিল্প বিপ্লবের প্রস্তুতির কথা মাথায় রেখে ক্লাউড সার্ভিস, ই-লার্নিং প্ল্যাটফর্মস, মোবাইল অ্যাপস, সিস্টেম লিংক, ই-বুক প্ল্যাটফরমস, অ্যাপ ডেভেলপারস ও আইটি ফ্রিল্যান্সারের মতো নয়টি আইসিটি সেবার কর অব্যাহতি সুবিধা আগামী অর্থবছর থেকে বাড়ানো হতে পারে। বর্তমানে ২২টি আইসিটি সেবা এই সুবিধা ভোগ করছে।
আমদানি করা কম্পিউটার ও খুচরা যন্ত্রাংশের ক্ষেত্রে কর অথবা শুল্কের যে বিধান চালু আছে তা বলবৎ থাকবে। যদিও দেশে উৎপাদিত কম্পিউটারের জন্য কর রেয়াত করা হতে পারে।
কালো টাকা সাদা করার প্রশ্নবিদ্ধ যে ধারা চালু আছে তা এই বাজেটেও অব্যাহত থাকবে।
জরিমানা দিয়ে বছরের পর বছর ধরে কালো টাকা সাদা করার এই সুযোগ উন্মুক্ত রাখা হয়েছে। যা আগে অল্প কিছু খাতের মধ্যে সীমাবন্ধ ছিল। গত অর্থবছর পর্যন্ত সরকারি সংস্থাগুলো এই টাকার উৎস নিয়ে প্রশ্ন তুলতে পারত।
কিন্তু ২০২১-২২ অর্থবছরে সরকার সবগুলো খাতের জন্য এই সুযোগ করে দিয়েছে। সেই সঙ্গে টাকার উৎস নিয়ে প্রশ্ন তোলার বিধানও তুলে দিয়েছে। যাতে আরও বেশি রাজস্ব আয়ের সঙ্গে বেশি করে কর্মসংস্থান তৈরি করা যায়।
চলতি অর্থবছরের প্রথম নয় মাসে করদাতারা তাদের সম্পদ নগদ অর্থ, এফডিআর, সঞ্চয়পত্র ও শেয়ার আকারে দেখিয়ে রেকর্ড ১৪ হাজার ২৯৫ কোটি টাকা বৈধ করেছেন। এভাবে কর হিসেবে জাতীয় রাজস্ব বোর্ড ১ হাজার ৪৩৯ কোটি টাকা পেয়েছে।
স্বাধীনতার পর থেকে সাদা হওয়া অপ্রদর্শিত অর্থের পরিমাণ ৩০ হাজার ৮২৩ কোটি। যার মাধ্যমে রাষ্ট্রীয় কোষাগারে যুক্ত হয়েছে ৩ হাজার ৯০০ কোটি টাকা।
আগামী অর্থবছর থেকে সর্বোচ্চ দুই লাখ টাকার সঞ্চয়পত্র কেনার ক্ষেত্রে টিন সনদ দেখানোর দরকার হবে না। এখন এক লাখ বা তার বেশি পরিমাণ টাকার সঞ্চয়পত্র কিনতে টিন সনদ দেখাতে হয়।
অপেক্ষাকৃত বেশি সুদের কারণে অন্যকিছুর তুলনায় জাতীয় সঞ্চয়পত্র বিক্রির পরিমাণ ইতিমধ্যে আকাশ ছুঁয়েছে। এর সুদের হার এক শতাংশ কমিয়ে আনা হতে পারে। এখন চালু থাকা বিভিন্ন সঞ্চয় স্কিমের গড় সুদের হার ১১ দশমিক ৪ শতাংশ।
যাদের তিন কোটি টাকার নিট সম্পদ আছে, তাদের জন্য বাজেটে সারচার্জ দেওয়ার বিষয়টি নতুন করে নির্ধারণ করা হতে পারে।
আবার কোনো করদাতার নিট সম্পদের পরিমাণ ৫০ কোটি টাকা বা তার বেশি হলে আগামী অর্থবছর থেকে তাকে নিট সম্পদের ওপর অতিরিক্ত শূন্য দশমিক ২৫ শতাংশ অথবা আয়করের ওপর ৩৫ শতাংশ কর সারচার্জ হিসেবে দিতে হবে।
বর্তমানে নিট সম্পদের ওপর শূন্য দশমিক ১ শতাংশ অথবা আয়করের ওপর অতিরিক্ত ৩০ শতাংশ কর সারচার্জ হিসেবে দেওয়ার বিধান আছে।
মহামারির কারণে ব্যবসা পরিচালনার ক্ষেত্রে ভ্যাট বা মূল্য সংযোজন কর ফাঁকির জন্য জরিমানার পরিমাণও কমিয়ে আনা হতে পারে।
এখন যে পরিমাণ ভ্যাট ফাঁকি দেওয়া হয় তার দ্বিগুণ জরিমানার বিধান আছে। আগামী অর্থবছর থেকে তা সমান সমান রাখা হবে।
যেসব কোম্পানি কর্মী হিসেবে ট্রান্সজেন্ডার জনগোষ্ঠীকে নিয়োগ দেবে তাদের জন্য করপোরেট কর কমানোর পাশাপাশি অন্য সুবিধাও দেওয়া হবে।
এসব উদ্যোগের মাধ্যমে সরকার ৩ লাখ ৩০ হাজার কোটি টাকা রাজস্ব আদায়ের লক্ষ্যমাত্রা নির্ধারণ করেছে। ২০২০-২১ অর্থবছরে সংশোধিত রাজস্ব আদায়ের লক্ষ্যমাত্রার তুলনায় যা ৯ দশমিক ৬ শতাংশ বেশি।
চলতি অর্থবছরের প্রথম ১০ মাসে রাজস্ব কর্তৃপক্ষ ১ লাখ ৯৭ হাজার ৫৮৩ কোটি টাকার রাজস্ব আদায় করতে পেরেছে। যা প্রত্যাশার তুলনায় ১২ দশমিক ৭ শতাংশ বেশি। রাজস্ব কর্মকর্তারা আশা করছেন, সারা বছরে আদায়কৃত রাজস্বের পরিমাণ ২ লাখ ৮০ হাজার কোটি টাকার বেশি হতে পারে।
এখন প্রশ্ন উঠেছে, এই পরিমাণ কর ছাড়ের পরেও সরকার পরবর্তী অর্থবছরে কীভাবে অতিরিক্ত রাজস্ব আদায় করবে।
এ ক্ষেত্রে অর্থমন্ত্রী তার আশা ধরে রেখেছেন ৭ দশমিক ২ শতাংশ অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধি, মূল্যস্ফীতি, রপ্তানি বাড়ানো ও ইলেক্ট্রনিক পদ্ধতি ব্যবহারের মাধ্যমে আয়কর সম্প্রসারণের ওপর। যার সবকিছু মিলিয়ে রাষ্ট্রীয় কোষাগার ভরে উঠবে।
প্রতিবেদনটি ইংরেজি থেকে অনুবাদ করেছেন মামুনুর রশীদ
Comments