রুগ্ন স্বাস্থ্যখাতকে সুস্থধারায় ফেরানোর উদ্যোগ নেই

স্টার অনলাইন গ্রাফিক্স

অর্থমন্ত্রী আ হ ম মুস্তফা কামাল যখন গতকাল দেশের ৫০তম বাজেট পেশ করছিলেন— তখন সবার দৃষ্টি ছিল, দেশের চিকিৎসা খাতের অব্যবস্থাপনা এবং করোনা বিধ্বস্ত স্বাস্থ্য খাতের উন্নয়নে তিনি কী পরিকল্পনা নিচ্ছেন।

যদিও অর্থমন্ত্রী তার বাজেট বক্তৃতায় বলেছেন, স্বাস্থ্যখাতে সর্বোচ্চ গুরুত্ব দেওয়া হয়েছে। কিন্তু, বাজেটে এর প্রতিফলন নেই। এই বিষয়টিকে হতাশাজনক বলছেন বিশেষজ্ঞরা।

গত অর্থবছরের সঙ্গে তুলনা করলে ২০২১-২২ অর্থবছরের প্রস্তাবিত স্বাস্থ্য বাজেটে নতুন তেমন কিছু নেই। অর্থমন্ত্রী স্বাস্থ্যখাতের জন্য ৩২ হাজার ৭৩১ কোটি টাকা প্রস্তাব করেছেন, যা মোট বাজেটের পাঁচ দশমিক ৪২ শতাংশ অথবা জিডিপির মাত্র শূন্য দশমিক ৯৫ শতাংশ। 

বিদায়ী অর্থবছরের বাজেটে এই খাতে বরাদ্দ দেওয়া হয়েছিল ২৯ হাজার ২৪৭ কোটি টাকা। যা ছিল মোট বাজেটের পাঁচ দশমিক ১৫ শতাংশ এবং সংশোধিত বাজেটে যার আকার বেড়ে দাঁড়ায় পাঁচ দশমিক ৮৪ শতাংশ।

গত ১২ অর্থবছরে জনস্বাস্থ্যে সরকারের ব্যয় ছিল জিডিপির এক শতাংশেরও নিচে। যদিও বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার (ডব্লিউএইচও) সুপারিশ, স্বাস্থ্য খাতে মোট জিডিপির পাঁচ শতাংশ বরাদ্দ থাকতে হবে।

অষ্টম পঞ্চবার্ষিক পরিকল্পনা (২০২১-২০২৫) অনুসারে স্বাস্থ্যখাতে জিডিপির দুই শতাংশ বরাদ্দের পরিকল্পনা করে সরকার। 

পাশাপাশি, গত অর্থবছরের মতো এবারও প্রস্তাবিত বাজেটে স্বাস্থ্য খাতের অপ্রত্যাশিত জরুরি প্রয়োজন মেটাতে ১০ হাজার কোটি টাকা থোক বরাদ্দ রাখা হয়েছে।

স্বাস্থ্য বিশেষজ্ঞ ও মানবাধিকার কর্মীরা জানিয়েছেন, প্রাথমিক স্বাস্থ্যসেবার মানোন্নয়নে এ খাতে উল্লেখযোগ্য পরিমাণ বাজেট বরাদ্দ দিয়ে সরকার স্বাস্থ্যখাতের উন্নয়ন করতে পারত।         

এছাড়াও কোভিড-১৯-এর ভ্যাকসিন কেনা বাবদ আলাদা বরাদ্দের কথা উল্লেখ করা হয়নি। অর্থমন্ত্রী শুধু বলেছেন, প্রয়োজনীয় ভ্যাকসিন কিনতে ‘যত তহবিলের প্রয়োজন হয়’সরকার বরাদ্দ দেবে।

অর্থমন্ত্রী তার বাজেট বক্তৃতায় বলেছেন, ‘মহামারি পরিস্থিতিতে, দেশের নাগরিকদের কম খরচে স্বাস্থ্যসেবা নিশ্চিত করতে পুষ্টি ও জনস্বাস্থ্য খাতের সক্ষমতা বাড়ানো হয়েছে।’

অর্থমন্ত্রী আরও জানান, প্রতিমাসে ২৫ লাখ মানুষকে করোনাভাইরাসের টিকা দিয়ে কয়েক ধাপে দেশের ৮০ ভাগ মানুষকে টিকার আওতায় আনার পরিকল্পনা রয়েছে সরকারের।

এর আগে প্রতিমাসে ৫০ লাখ মানুষের টিকা দেওয়ার পরিকল্পনা ছিল। তবে ভ্যাকসিন স্বল্পতার কারণে টিকাদান কর্মসূচি অনিশ্চয়তায় মধ্যে পড়ে।

বিশেষজ্ঞরা বলছেন, অর্থমন্ত্রীর বক্তব্যে এটি বাস্তবায়নের বিষয় প্রতিফলিত হয়নি। বিশেষ করে, স্বাস্থ্য খাতে বরাদ্দ দেওয়া অর্থ কতটা কার্যকরী উপায়ে ব্যবহার করা হবে সে বিষয়ে উল্লেখ নেই।

উদাহরণ হিসেবে বলা যায়, বিদায়ী ২০২০-২১ অর্থবছরের প্রথম ১০ মাসে স্বাস্থ্যখাতে বরাদ্দকৃত উন্নয়ন বাজেটের ২৪ শতাংশ অব্যবহৃত ছিল। এছাড়া স্বাস্থ্যসেবা বিভাগ অর্থবছরের প্রথম ১০ মাসে বরাদ্দ দেওয়া অর্থের মাত্র ২৫ দশমিক ৪৬ শতাংশ অর্থ ব্যবহার করতে পেরেছে।

এছাড়া ২০২০-২১ অর্থবছরে থোক বরাদ্দের ১০ হাজার কোটি টাকার বেশিরভাগই অব্যবহৃত থেকে গেছে।

পরিকল্পনা কমিশনের বাস্তবায়ন পরীবিক্ষণ ও মূল্যায়ন বিভাগের (আইএমইডি) তথ্য অনুসারে, করোনাভাইরাস মহামারি পরিস্থিতির মধ্যে বার্ষিক উন্নয়ন কর্মসূচিতে (এডিপি) বরাদ্দ বাড়ানো সত্ত্বেও ২০২০-২১ অর্থবছরের প্রথম ১০ মাসে স্বাস্থ্যখাত ৭১ শতাংশ অর্থ ব্যয়ে ব্যর্থ হয়।

এছাড়া প্রস্তাবিত বাজেটে কতগুলো গুরুত্বপূর্ণ বিষয়ের উল্লেখ করা হয়নি বলে জানিয়েছেন বিশেষজ্ঞরা। সেগুলোর মধ্যে আছে, দ্রুত বাজেট বাস্তবায়ন ও ফ্রন্টলাইন সেবাদানকারীদের অর্থ ছাড় দেওয়া, যাদের কোভিড-১৯ সেবা দরকার তাদের জরুরি সেবা দেওয়া, জরুরি সাড়াদান ব্যবস্থা এবং স্বাস্থ্য ব্যবস্থার মূল কাঠামো হিসেবে স্বাস্থ্য সুরক্ষা ও সর্বজনীন স্বাস্থ্য কর্মসূচি (ইউএইচসি) শক্তিশালী করা।

তবে, একটি ব্যতিক্রম দিক হলো এবারই প্রথম অর্থমন্ত্রী প্রস্তাব দিয়েছেন— ঢাকা, নারায়ণগঞ্জ, গাজীপুর ও চট্টগ্রামের বাইরে ন্যূনতম ২৫০ শয্যা বিশিষ্ট জেনারেল হাসপাতাল ও স্পেশালাইজড হাসপাতাল নির্মিত হলে ১০ বছর কর মওকুফ দেওয়া হবে।

গত অর্থবছরের মতো ২০২১-২২ অর্থবছরের বাজেট প্রস্তাবেও স্বাস্থ্যশিক্ষা, বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি খাতে গবেষণা বাড়াতে সমন্বিত স্বাস্থ্য ও চিকিৎসা গবেষণায় ১০০ কোটি টাকা বরাদ্দ রাখা হয়েছে।

সার্বিক স্বাস্থ্য বাজেটে পরিচালন ব্যয় হিসেবে ধরা হয়েছে ৫২ দশমিক পাঁচ শতাংশ এবং বাকি অর্থ ব্যয় করা হবে উন্নয়নে।

মহামারি মোকাবিলায় উপযোগী নয়

বাজেটে বিভিন্ন খাতে বরাদ্দ দেওয়া অর্থের পরিমাণ দেখে বলা যায়, প্রস্তাবিত স্বাস্থ্য বাজেট মহামারি মোকাবিলায় উপযোগী নয় এবং গত অর্থবছরের বাজেট থেকে এখানে আলাদা কিছু নেই।

বাংলাদেশ হেলথ রাইটস মুভমেন্টের সভাপতি ড. রশিদ-ই মাহবুব দ্য ডেইলি স্টারকে বলেন, ‘স্বাস্থ্যখাতের জন্য প্রস্তাবিত বাজেট অগ্রহণযোগ্য। এখানে অক্সিজেন ও আইসিইউয়ের জন্য কিছু বরাদ্দ রাখা হয়েছে। প্রাথমিক স্বাস্থ্যসেবাকে কেন্দ্রে রেখে সামগ্রিক স্বাস্থ্য খাতের সংস্কার দরকার। তবে প্রস্তাবিত বাজেটে এ বিষয়ে কিছু উল্লেখ করা হয়নি।’

যেখানে গতকাল পর্যন্ত সারাদেশে করোনাভাইরাসে আক্রান্ত হয়ে ১২ হাজার ৭২৪ জনের মৃত্যু হয়েছে এবং আট লাখ পাঁচ হাজার মানুষ আক্রান্ত হয়েছে। তাতে খুব শিগগিরই মহামারি শেষ হওয়ার কোনো লক্ষণও দেখা যাচ্ছে না। 

দেশের ৮০ ভাগ মানুষকে টিকা দেওয়া সুদূরপ্রসারী লক্ষ্য। তবে কোভিড-১৯ সংক্রমণ নিয়ন্ত্রণ এখন সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ বিষয়।

তবে, অর্থমন্ত্রী তার ভাষণে শুধু করোনাভাইরাস পরীক্ষার সামর্থ্য, অক্সিজেন ও আইসিইউ সরবরাহ, শনাক্ত ও আইসোলেশনের প্রতি গুরুত্ব দিয়েছেন। তিনি করোনা মোকাবিলায় সমষ্টিগত প্রচেষ্টার কথা উল্লেখ করেননি।

তাছাড়া, আয় ও অঞ্চল নির্বিশেষে স্বাস্থ্যসেবা নিশ্চিত করতে স্বাস্থ্যখাতে যে পরিমাণ বরাদ্দ প্রয়োজন, তার তুলনায় খুব কম বরাদ্দ দেওয়া হয়েছে। কোভিড-১৯ মহামারির কারণে যেটি খুব জরুরি হয়ে পড়েছে।

২০১৯ সালে প্রকাশিত বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা ও বিশ্ব ব্যাংকের এক যৌথ প্রতিবেদনে বলা হয়, প্রতিবছর বাংলাদেশে সাত শতাংশ পরিবারকে স্বাস্থ্যসেবার জন্য ব্যয় করতে গিয়ে দারিদ্র্যের মুখে পড়তে হয়।

স্বাস্থ্যসেবা নিতে গিয়ে দারিদ্র্যের শিকার হওয়ার হার বাংলাদেশে খুব বেশি, প্রায় ৭৩ দশমিক ৮৭ শতাংশ। যেটি দক্ষিণ এশিয়ার দেশগুলোর মধ্যে দ্বিতীয় সর্বোচ্চ। সবচেয়ে বেশি আফগানিস্তানে ৭৮ দশমিক ৩৮ শতাংশ।

দক্ষিণ এশিয়ার দেশগুলোতে যেখানে গড়ে স্বাস্থ্যসেবার জন্য মাথাপিছু ৪০১ ডলার করে ব্যয় করা হয়, বাংলাদেশে সেখানে সর্বনিম্ন ১১০ ডলার ব্যয় করা হয়।  

ইনস্টিটিউট অব হেলথ ইকোনোমিক্স (আইএইচই)-এর খণ্ডকালীন অধ্যাপক ড. মুহাম্মদ আব্দুস সবুর ডেইলি স্টারকে বলেন, ‘বাজেটে অন্যান্য খাতের বরাদ্দের পরিমাণের দিকে তাকান। এটা আবারও প্রমাণ হয় যে, স্বাস্থ্য খাত সরকারের অগ্রাধিকারে নেই। সরকার যা বলছে, তা করছে না।’

তিনি বলেন, সরকারের স্বাস্থ্য খাতের উন্নয়নের কথা কেবল ‘অস্পষ্টতার বিষয়’।

ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ইনস্টিটিউট অব হেলথ ইকোনোমিকসের শিক্ষক ড. শাফিউন শিমুল বলেন, ‘যেহেতু এটা একটা বিশাল ঘাটতি বাজেট, ফলে স্বাস্থ্যখাতে বরাদ্দকৃত অর্থ ছাড় করাও সরকারের জন্য চ্যালেঞ্জ হয়ে দাঁড়াবে। একইসঙ্গে অর্থ ব্যয়ের পদ্ধতিগত কারণে থোক বরাদ্দের অর্থও খুব একটা কাজে আসবে না।’

তিনি আরও বলেন, ‘কোভিড-১৯ পরীক্ষার সংখ্যা বাড়ানো, শনাক্ত, আইসোলেশন সেন্টার ও কোভিড-১৯ হাসপাতাল তৈরি শুধু মহামারি মোকাবিলার উপায় নয়। মহামারি মোকাবিলায় প্রধান চ্যালেঞ্জ হচ্ছে সফল রিস্ক কমিউনিকেশন ও সমন্বিত প্রচেষ্টা। তবে এ বিষয়ে পরিষ্কার করে কিছু বলা নেই।’

প্রতিবেদনটি ইংরেজি থেকে অনুবাদ করেছেন মুনীর মমতাজ

Comments

The Daily Star  | English

Now coal power plants scaling back production

Coal-fired power plants are dialling down production or even shutting down due to financial, legal or technical issues, leading to power cuts across the country, especially the rural areas.

6h ago