স্থানীয় ব্যবসায়ীদের নিয়ন্ত্রণে আমের বাজার, ন্যায্যমূল্য বঞ্চিত চাষিরা

ছবিটি সম্প্রতি দেশের দ্বিতীয় বৃহত্তম আমের বাজার রাজশাহীর বানেশ্বর আম বাজার থেকে তোলা। ছবি: আনোয়ার আলী/স্টার

রাজশাহী অঞ্চলে এ বছর আমের ভালো ফলন হলেও তা চাষিদের মুখে হাসি ফোটাতে পারেনি। তারা অভিযোগ করেছেন, করোনাভাইরাস পরিস্থিতিতে ক্রেতার অভাবে আমের বাজারজাতকরণ ও বিপণন ব্যবস্থা ভেঙে পড়ায় অনেক কৃষক আমের ন্যায্যমূল্য থেকে বঞ্চিত হচ্ছেন।

তারা বলেছেন, করোনাভাইরাসের সংক্রমণ বাড়তে থাকায় জেলাগুলোর বাইরে থেকে ক্রেতা আসতে পারেনি। এই পরিস্থিতির সুযোগ নিয়ে স্থানীয় ফড়িয়ারা যারা অন্য সময়ে অন্য জেলার বাইরে ক্রেতাদের কমিশনের বিনিময়ে আম কিনে দিতে সাহায্য করেন তারাই এবার আম বাজারগুলো নিয়ন্ত্রণ করছেন। তারা চাষিদের কাছে কম দরে কিনে উচ্চমূল্যে বাজারে আম বিক্রি করছেন।

কোনো ক্রেতা তাদের কাছে না আসায় কৃষকরা বাগান থেকেই স্থানীয় ফড়িয়াদের কাছে তাদের আম বিক্রি করে দিতে বাধ্য হচ্ছেন।

মে মাসের শেষ সপ্তাহে যখন গুটি ও গোপালভোগ জাতের আমের ভরা মৌসুম ছিল, তখন দেশের সর্বোচ্চ আম উৎপাদনকারী জেলা চাঁপাইনবাবগঞ্জে সাত দিনের লকডাউনে দেশের অন্যান্য অঞ্চল থেকে বিচ্ছিন্ন হয়ে যায়।

লকডাউনটি ৩১ মে থেকে আরও সাত দিনের জন্য বাড়ানো হলেও জেলা কোভিড-১৯ নিয়ন্ত্রণ কমিটি আমের ব্যবসায়ের জন্য বিধিনিষেধ শিথিল করেছে। কিন্তু, তাতেও পরিস্থিতির কোনো উন্নতি হয়নি।

আম চাষিরা বলেছেন, ক্রেতারা রাস্তায় হয়রানির আশঙ্কায় সেখানে যেতে পারেনি। স্থানীয় ব্যবসায়ীরাই কম দামে তাদের আম কিনে নিচ্ছেন।

রাজশাহীর বানেশ্বর আম বাজারের সাম্প্রতিক দৃশ্য। ছবি: আনোয়র আলী/স্টার

জুন মাসের শুরুতে যখন মানসম্পন্ন আমের জাত খিরসাপাত ও হিমসাগর বাজারে আসতে শুর করে, তখন দেশের সর্ববৃহৎ আমের হাট চাঁপাইনবাবগঞ্জের কানসাটে আমের বাজারে ব্যস্ততা দেখা যায়। তবে, সেখানকার বাজার ক্রেতার অভাবে স্বাভাবিক হতে পারেনি।

সাধারণত, কানসাট বাজারের আটশরও বেশি আড়তদার রয়েছে। যাদের একেকজন দেশের বিভিন্ন প্রান্তে অন্তত ১২ জন ক্রেতার সঙ্গে লেনদেন করে থাকে এবং প্রতিদিন প্রায় দুইশ  ট্রাক আমন জেলা থেকে ছেড়ে যায়।

কানসাটের আম ব্যবসায়ী ওমর ফারুক টিপু দ্য ডেইলি স্টারকে বলেন, ‘এখন পর্যন্ত ৩০টির বেশি আমের আড়ত তাদের দোকান খুলতে পারেনি। তবে, আম নিয়ে প্রতিদিন একশ’র বেশি ট্রাক ছেড়ে যাচ্ছে। কিন্তু, তাতে কৃষকের কোন লাভ থাকছে না।’

টিপু বলেছিলেন, ‘আমার মতো ব্যবসায়ীরা অনলাইনে বা ফোনে ক্রেতা যোগাড় করছেন। কিন্তু, কৃষকরা ন্যায্য দাম থেকে বঞ্চিত থাকছেন। কারণ আমাদেরকে চাষিরা কম দামে হলেও আম কিনে নিতে বলছেন, না হলে তাদের আম নষ্ট হয়ে যাবে।’

মে মাসের মাঝামাঝিতে যখন লকডাউন ছিল না তখন গুটি আম টনপ্রতি ৩৮,০০০ টাকায় বিক্রি হয়েছিল, পরে চাঁপাইনবাবগঞ্জে প্রতি টন ১৮,০০০ টাকায় বিক্রি হয়েছিল।

গোপালভোগ জাতের আমের দাম এক সপ্তাহে প্রতি টন ২২,৫০০ টাকা নেমে যায় এবং টনপ্রতি ৫৫,০০০ টাকার আম বিক্রি হয় ৩২,০০০ টাকায়।

গত মঙ্গলবার সকালে খিরসাপাত ও হিমসাগর জাতের আম টনপ্রতি ৬০,০০০ টাকায় বিক্রি হয়েছিল। কিন্তু ক্রেতা না থাকায় ও সরবরাহ বেড়ে যাওয়ায় বিকেলে প্রতি টন আমের দাম ১৫০০০ টাকা কমে যায়।

ইসমাইল হোসেন খান ফেসবুকে ছয়শ জন আম ব্যবসায়ীর একটি গ্রুপ পরিচালনা করছেন। তিনি বলেন, ‘বেশিরভাগ আম চাষি অনলাইনে আমের বিপণন শুরু করেছেন।’

খান বলেন, ‘তাতেও বড় ব্যবসায়ীরাই স্বাচ্ছন্দ্য বোধ করছেন, তবে ক্ষুদ্র কৃষকরা অনলাইনে পারদর্শী না হওয়ায় তাদের আম স্থানীয় ব্যবসায়ীদের কাছে কম দামে বিক্রি করতে বাধ্য হচ্ছেন।’

ক্রেতার অপেক্ষায়...। ছবি: আনোয়ার আলী/স্টার

গত বৃহস্পতিবার থেকে রাজশাহী ও নওগাঁয় করোনা পরিস্থিতির অবনতি হওয়ায় জেলাগুলোতে নানান বিধিনিষেধ আরোপ করা হয়েছে। তবে, আম বিপণনে বিধিনিষেধ শিথিল রাখা হয়েছে।

লকডাউন না থাকায় রাজশাহীর বানেশ্বরে দেশের দ্বিতীয় বৃহত্তম আমের বাজারে মৌসুমের শুরু থেকেই ব্যবসা জমে উঠেছে। সেখানকার আম চাষিরাও ক্রেতার অভাবের অভিযোগ করেছেন।

সম্প্রতি বানেশ্বরে গিয়ে দেখা যায়, আম চাষিরা  গ্রীষ্মের খরতাপে আম নিয়ে দীর্ঘক্ষণ ধরে ক্রেতার জন্য অপেক্ষা করছেন।

চারঘাটের আম চাষি আব্দুল কুদ্দুস তাদের অন্যতম। তিনি বলেন, ‘কিছু ক্রেতা আমার আমের একটা দাম বলেছে, তবে আমি আরও কিছুটা ভাল দামের জন্য অপেক্ষা করছি। কেবল স্থানীয় ক্রেতাকেই বাজারে দেখা যাচ্ছে। জেলার বাইরের কাউকে দেখিনি।’

তিনি বলেন, ‘সাধারণ সময়ে সরাসরি আমার বাগান থেকে আম বিক্রি হয় বা ব্যবসায়ীরা আমার কাছ থেকে বাজারে যাওয়ার পথেই আম কিনে থাকে। কিন্তু, এবার আমাকে আম নিয়ে বাজারে বসে থাকতে হচ্ছে।’

ব্যবসায়ীরা কীভাবে বাজার নিয়ন্ত্রণ করছেন তা বর্ণনা করে আরেক আম চাষি জয়নাল আবেদীন দ্য ডেইলি স্টারকে বলেন, ‘বাজারে যখন আমি আম বিক্রি করতে আসি তখন আমের দাম কম থাকে, কিন্তু, আমি আম  কিনতে গেলে আমের দাম বেড়ে যায়।’

লক্ষ্মণভোগ জাতের আম যা গত বছর প্রতি টন ৪০,০০০ টাকায় বিক্রি হয়েছিল, তা এই মৌসুমে প্রতি টন ২২,৫০০ টাকায় বিক্রি করা যায়নি।

বানেশ্বর বাজারে খিরসাপাত ও হিমসাগর আম কিনতে গেলে ৭০,০০০ টাকা প্রতি টন দাম ছিল। তবে, চাষিরা জানিয়েছেন তারা ৫০,০০০ টাকার ওপরে দাম পাননি।

বানেশ্বরের আম ব্যবসায়ী নজরুল ইসলাম বলেন, ‘ক্রেতারা দেশের বিভিন্ন অঞ্চল থেকে আসছেন, তবে তাদের সংখ্যা স্বাভাবিকের চেয়ে কম।’

তিনি দাবি করেছেন, এ বছর দাম ভালো। তবে স্বীকার করেছেন যে, কৃষকরা ন্যায্য দাম পাচ্ছেন না, যা ব্যবসায়ীরা পাচ্ছেন।

সেরা মানের আমের জাত ল্যাংড়া জুনের দ্বিতীয় সপ্তাহে এবং আমের রাজা ফজলি জুনের শেষের দিকে বাজারে আসবে।

ক্রেতার অভাবে আমের বাজারজাতকরণ ও বিপণন ব্যবস্থা ভেঙে পড়ায় অনেক কৃষক আমের ন্যায্যমূল্য থেকে বঞ্চিত হচ্ছেন। ছবি: আনোয়ার আলী/স্টার

এদিকে, কোনো বড় ধরনের ঝড়-বৃষ্টি না হওয়ায় রাজশাহী অঞ্চলে এ বছরের খরা আমের জন্য আশীর্বাদ হয়ে উঠেছে। রাজশাহীর ফল গবেষণা কেন্দ্রের প্রধান বৈজ্ঞানিক কর্মকর্তা ড. আলীম উদ্দিন বলেছেন, ‘আম গ্রীষ্মেরই ফল। এবারের খরা মৌসুম আমকে সাহায্যই  করেছে।’

তিনি ব্যাখ্যা করেছেন, বৃষ্টিপাতের অভাবে কীটপতঙ্গের আক্রমণ যেমন কম হয়েছে, এখন পর্যন্ত কোনো বড় ঝড় না হওয়ায় সব গাছের ফলই রক্ষা পেয়েছে, ঝরে পড়েনি। খরায় যেসব চাষিরা জমিতে সেচ দিতে পারেননি তাদের গাছের ‘আম আকারে কিছুটা ছোট হতে পারে’, তবে ফলনে কোন প্রভাব ফেলবে না, বরং আম আরও মিষ্টি হবে।

জুলাইয়ের মাঝামাঝি পর্যন্ত যদি কোনো বড় ঝড়-বৃষ্টির ঘটনা না ঘটে তাহলে এ বছর আমের উৎপাদন প্রায় এক লাখ টন বাড়বে বলে আশা প্রকাশ করেছেন রাজশাহীর আঞ্চলিক ডিএইর অতিরিক্ত পরিচালক সিরাজুল ইসলাম।

চলতি বছরে নাটোর, নওগাঁ, রাজশাহী ও চাঁপাইনবাবগঞ্জের চারটি জেলাতে ৮৩,৬৭৩ হেক্টর জমিতে ৮.৫২ লাখ টনেরও বেশি আম উৎপাদন হবে বলে আশা করা হচ্ছে।

ডিএই কর্মকর্তারা জানিয়েছেন, গত বছর এই অঞ্চলে আমের উৎপাদন ছিল ৭.৭৬ লাখ টন, সে বছর ঝড়ে আম উৎপাদন হ্রাস পেয়েছিল।

দেশের মোট উৎপাদিত আমের শতকরা ৪০ ভাগই আসে রাজশাহী অঞ্চল থেকে। এখানকার উৎপাদিত আম নিয়ে যেসব ছোট-বড় ব্যবসা পরিচালিত হয় তাতে অন্তত ২৫০০ কোটি টাকা আবর্তিত হতে থাকে।

ডিএই তথ্য অনুসারে, আম মৌসুমে এ অঞ্চলের প্রায় তিন লাখ আম চাষি ছাড়াও হাজার হাজার মানুষের কর্মসংস্থান হয় এবং তাদের অনেকে আম মৌসুমের তিন বা চার মাসে যা আয় করেন তাতে তাদের সারা বছরের বেশিরভাগ অংশ চলে যায়।

আরও পড়ুন:

Comments