সাহিত্য

আমার এক হাতে লেখালেখি, অন্য হাতে বাকি জীবন: সেলিনা হোসেন

সেলিনা হোসেন। ছবি: স্টার

কথাসাহিত্যিক সেলিনা হোসেনের জন্ম ১৯৪৭ সালের ১৪ জুন রাজশাহী শহরে। সাত ভাইবোনের মধ্যে তিনি চতুর্থ। প্রাতিষ্ঠানিক পড়াশোনা বাংলা ভাষা ও সাহিত্যে। তিনি দীর্ঘকাল বাংলা একাডেমিতে চাকরি করেছেন। একাডেমির পরিচালক পদে থাকা অবস্থায় তিনি অবসর গ্রহণ করেন। পরে সভাপতির দায়িত্ব পালন করেছেন বাংলাদেশ শিশু একাডেমির।

কথাসাহিত্যিক ও প্রাবন্ধিক হিসেবে সেলিনা হোসেন বাংলার লোক-পুরাণের উজ্জ্বল চরিত্রসমূহকে নতুনভাবে এনেছেন। তার উপন্যাসে প্রতিফলিত হয়েছে সমকালের সামাজিক ও রাজনৈতিক দ্বন্দ্বসংকটের সামগ্রিকতা। লিখেছেন ছোটদের জন্যেও। তার লেখার জগত বাংলাদেশের মানুষ, জীবন সংস্কৃতি ও ঐতিহ্য। জীবনের গভীর উপলব্ধির প্রকাশকে তিনি শুধু কথাসাহিত্যের মধ্যেই সীমাবদ্ধ রাখেননি, শাণিত ও শক্তিশালী গদ্যের নির্মাণে প্রবন্ধের আকারেও উপস্থাপন করেছেন। ভাষা আন্দোলন ও মুক্তিযুদ্ধের প্রসঙ্গ তার লেখায় নতুনমাত্রা যোগ করেছে।

তার গল্প উপন্যাস ইংরেজি, রুশ, মেলে এবং কানাডী ভাষায় অনূদিত হয়েছে। সাহিত্যকর্মে অবদানের জন্য বাংলা একাডেমি পুরস্কার, আলাওল সাহিত্য পুরস্কার, ফিলিপস সাহিত্য পুরস্কারসহ বহু পুরস্কারে ভূষিত হয়েছেন। ২০১০ সালে একুশে পদক পান সেলিনা হোসেন। ওই বছরেই রবীন্দ্র ভারতী বিশ্ববিদ্যালয় তাকে ডি.লিট উপাধি দেয় তাকে। জন্মদিন উপলক্ষে সাহিত্য সংস্কৃতি সমাজ নিয়ে কথা বলেন দ্য ডেইলি স্টারের সঙ্গে।

মধ্যবিত্ত পরিবার ছিল আপনাদের। বাবার সরকারি চাকরির সুবাদে শৈশব কেটেছে নানা জায়গায়। জন্মদিন এলে সেসব গল্প মনে পড়ে?

সত্যি, আমাদের দারুন একটা শৈশব ছিল। ভাবলে স্মৃতিকাতর হয়ে যাই এখনো। পঞ্চাশের দশকে বাবার চাকরিসূত্রে আমরা বাংলাদেশের যেখানে থাকতাম, সেখানে নদীর ধারের অপরূপ প্রাকৃতিক সৌন্দর্য আমি দেখেছি, মন ভরে উপভোগ করেছি। আর ছোটবেলা থেকেই ছিলাম দুরন্ত স্বভাবের। মাঠে-ঘাটে, জেলেদের সঙ্গে মাছের ভেড়িতে ঘুরে বেড়াতাম। তবে মেয়ে বলে যে বাড়িতে বসে থাকতে হবে এই ধরনের বাঁধাধরা নিয়ম আমাদের পরিবারে ছিল না, প্রতিবেশীদের তরফ থেকেও কোনও আপত্তি আসেনি। বন্ধুবান্ধব মিলে নৌকা করে ঘুরে বেড়ানোর মধ্যে দিয়ে অদ্ভুত আনন্দ খুঁজে পেতাম। সেই সঙ্গে দেখেছি মানুষে মানুষে কত ভালো সম্পর্ক হতে পারে শৈশবে।

প্রায় শোনা যায় সৃজনশীল চর্চা নারীদের জন্য সহজ না, সে ক্ষেত্রে আপনার সফলতায় পরিবারের ভূমিকা কেমন ছিল?

পারিবার থেকে আমি বাধা পাইনি। লেখালেখির শুরু থেকে পরিবারের সব ধরনের সহযোগিতা পেয়েছি বলেই এই ৫১ বছর ধরে লেখালেখির সঙ্গে আছি। সেজন্য বলতে পারি আমার এক হাতে লেখালেখি, অন্য হাতে বাকি জীবন। সকলের সহযোগিতা পেয়েছি বলে এভাবে নিতে পারা আমার জন্য সহজ হয়েছিল। আর আমার এক হাতে লেখালেখি, অন্য হাতে বাকি জীবন।

এক জীবনে সাহিত্যে এসে কি পেলেন, আর কি হারালেন?

এই জীবনে পেয়েছি পাঠকের ভালোবাসা। অনেক, অনেক ভালোবাসা। হারাইনি কিছুই।

একজন লেখক কতটা সামাজিক দায়ব্ধতার মধ্যে থাকে? আর কতটা সে পালন করতে পারে?

‘শিল্পের জন্য শিল্প’ এই সংজ্ঞাতো কতকাল আগেই বর্জিত হয়েছে। শিল্পে সামগ্রিক দায়ব্ধতা সৃজনশীল মানুষের গভীরতম বোধ। তাকে রূপায়িত করা দরকার। কেউ যদি এড়াতে চান তো এড়াবেন। সেটা তার স্বাধীনতা।

সাহিত্যে সমাজের বহুমাত্রিক সংকট কতটা ফুঠে উঠছে বলে মনে করেন। সমাজ গতিশীল রাখতে শিল্পের ভূমিকা কেমন হওয়া উচিত।

সমাজের বহুমাত্রিক সংকট সাহিত্যের প্রধান দিক। বাংলাদেশের সাহিত্য এমন নানামূখী ধারায় রচিত হচ্ছে। নবীন প্রবীণ লেখকরা শিল্পের ভূমিকায় সমাজের সৃষ্টিশীলতায় প্রধান করে দেখেন। লেখকরা এই মৌলিক বিবেচনা থেকে দূরে থাকেন না।

সামজিক মুক্তি না হলে মানবিক মূল্যবোধের দশা কেমন হতে পারে?

সামাজিক মুক্তি না হলে মানবিক মূল্যবোধের দশা কেমন হতে পারে তার বড় প্রকাশ ব্যাপকভাবে নারী ও শিশু ধর্ষণ দীর্ঘ সময় ধরে। ধর্ষনকারী ব্যক্তিরাও মানবিক মূল্যবোধের বিষয়টি নিজেদের বিবেচনা নৈতিকতায় ধরে রাখছে না। অপরাধের শাস্তিও তাদের কাছে গ্রহণযোগ্যতা পাচ্ছে না। সরকার ধর্ষণের সর্বোচ্চ শাস্তি হিসেবে মৃত্যুদণ্ডের আইন পাশ করেছে। কিন্তু বিচারের দীর্ঘসূত্রিতায় ভুক্তভোগীর ন্যায় বিচার পাওয়ার ক্ষেত্রে অনিশ্চিতায় থেকে যাচ্ছে। আইন পাশ হওয়ার পরও আমরা দেখছি পত্রিকার প্রথম পৃষ্ঠায় যে দেশজুড়ে ধর্ষণের ঘটনা ঘটে যাচ্ছে। মানবিক মূল্যবোধের এ এক চরম অবক্ষয়।

রাষ্ট্রের ৫০ বছর হয়ে গেল। বছর ঘুরে বছর আসে কিন্তু মৌলিক অধিকার মিটে নাই এখনো। কারণ কী মনে হয়?

বিপুল জনসংখ্যা অধ্যুষিত এই ছোট দেশে অর্থনৈতিক কারণে মৌলিক অধিকার মেটানো খুব দ্রুত সম্ভব নয়। তারপরও বলতে হবে যে, যে দলই ক্ষমতায় আসুক, তাদের আন্তরিক শাসন ব্যবস্থা বলবৎ থাকলে পরিস্থিতি বদলাবে। প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার শাসন আমলে এগিয়েছে দেশ।

আপনার তৈরি চরিত্ররা নিম্নবিত্ত হলেও প্রতিবাদী। এ প্রতিবাদ সরকারের বিরুদ্ধে না নিয়ম-কানুনের বিরুদ্ধে?

প্রতিবাদী হওয়া ব্যক্তির কণ্ঠস্বর। জীবনযাপনের প্রতিটি ক্ষেত্রে প্রতিবাদী হতে হয় ব্যক্তিকে। যে ব্যক্তি নতজানু মনোভাব নিয়ে দিনযাপন করে সে তার ব্যক্তিত্বের বোধকে হারায়। আমরা নিম্নবিত্তের মানুষেরা মানুষ হিসেবে গল্পে মর্যাদা প্রায়। তাদের প্রতিবাদের জায়গা অন্যায়ের বিরুদ্ধে, সেটা সরকারই করুক বা সিস্টেমের মাধ্যমে হোক, দুটো ক্ষেত্র তাদের কাছে সমান।

বিশ্বায়নের চাপে জাতীয় সাহিত্যচর্চা চাপের মুখে আছে বলে মনে করেন অনেকে। বাস্তবে কতটা আছে বলে মনে করেন?

জাতীয় সাহিত্য দেশের সম্পদ। বিশ্বয়ানের চাপের মুখে আছে বলে আমি মনে করি না। এটি একটি বাজে চিন্তা। পাঠাভ্যাস কমে গেছে, বর্তমানে এমন একটি কথা চালু হয়েছে। তার মানে এই নয় যে তারা বিদেশি সাহিত্য পড়ে। তারা কিছুই পড়ে না। জাতীয় সাহিত্য জাতির অস্তিত্বের অংশ। একে চাপের মুখে ফেলা সচেতন মানুষের কাজ নয়। যারা এসব কথা প্রচার করে তারা হীনমন্যতায় ভোগে।

একজন পাঠক হিসেবে নিজেকে পড়েন?

লেখালেখির শুরু থেকেই আমি পড়ুয়া স্বভাবের। বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়ার সময়ে যখন অন্যরা আড্ডা দিয়েছে তখন আমি লাইব্রেরিতে গিয়ে ঢুকেছি। পাঠ্য বইয়ের পাশাপাশি অন্য বইও পড়িছি একই মনোযোগে। তাহলে কি বলব? পাঠক হিসেবে আমি খারাপ না। সেলিনা হোসেনকে পড়ি।

Comments

The Daily Star  | English
Former president Hamid airport CCTV footage

The story of Hamid’s exit

Further details regarding the exit of former president Mohammed Abdul Hamid suggest he breezed through the airport before quietly departing for Thailand.

10h ago