নতুন দরিদ্র সাময়িক, তাদের জন্য ব্যবস্থার দরকার নেই: অর্থমন্ত্রী

অর্থমন্ত্রী আ হ ম মুস্তফা কামাল। ফাইল ছবি

করোনা মহামারিতে সারা বিশ্বেই বৈষম্য বেড়েছে। বাংলাদেশেও এর ব্যতিক্রম ঘটেনি। কিন্তু, আগামী ১ জুলাই থেকে কার্যকর হতে যাওয়া ২০২১-২২ অর্থবছরের বাজেটের দিকে তাকালে কারো মনে হতে পারে, দেশে নতুন দরিদ্রদের কোনো অস্তিত্বই নেই।

করোনা সংক্রমণ ঠেকাতে আরোপিত বিধি-নিষেধের কারণে জীবিকা ক্ষতিগ্রস্ত হওয়ায় দেশের অনেক মানুষ যে দরিদ্র হয়ে পড়েছে, এই বাজেটের মূল রূপকার অর্থমন্ত্রী আ হ ম মুস্তফা কামাল তা আসলে বিশ্বাসই করেন না।

চলতি সপ্তাহে দ্য ডেইলি স্টারকে দেওয়া সাক্ষাৎকারে অর্থমন্ত্রী বলেন, ‘বাইরে তাকিয়ে দেখুন। সবকিছু স্বাভাবিকভাবে চলছে। কোনো দোকান বন্ধ নেই। সেলুন, মিষ্টির দোকান, গলির দোকান, কিছুই বন্ধ নেই। নতুন দরিদ্র কেন থাকবে?’

বিশ্ব ব্যাংকের তথ্য অনুযায়ী, দেশের জনসংখ্যার প্রায় ২০ দশমিক ৫ শতাংশ আগে থেকেই দরিদ্র ছিল। মহামারির কারণে দারিদ্র্য বেড়ে ৩০ শতাংশে পৌঁছেছে। 

সেন্টার ফর পলিসি ডায়লগের (সিপিডি) এপ্রিলের একটি সমীক্ষা অনুযায়ী, মহামারির কারণে প্রায় ১ কোটি ৬০ লাখ মানুষ নতুন করে দরিদ্র হয়েছে। একই সময়ে পরিচালিত পাওয়ার অ্যান্ড পার্টিসিপেশন রিসার্চ সেন্টার ও ব্র্যাক ইন্সটিটিউট অব গভার্নেন্স অ্যান্ড ডেভেলপমেন্টের আরেকটি সমীক্ষার ফলাফল বলছে, মহামারির দ্বিতীয় ঢেউয়ের আগেই ২ কোটি ৪৫ লাখ মানুষ দরিদ্র হয়েছে।

তবে কামাল এসব হিসাবে বিশ্বাসী নন।

তিনি বলেন, ‘এ সংখ্যাগুলো কাল্পনিক। নতুন দরিদ্রদের খুঁজছি আমরা। আমাদের তাদের খুঁজে পেতে হবে। দরিদ্ররা দরিদ্রই। তাদের জন্য সমাধান খুঁজে বের করতে হবে আমাদের। পুরনো দরিদ্রদের থেকে তাদের আলাদা করে দেখব কেন?’

এজন্যই তিনি সামাজিক সুরক্ষা খাতে বরাদ্দ বাড়িয়েছেন, উল্লেখ করে অর্থমন্ত্রী বলেন, ‘এটি সাময়িক। আমার মনে হয় না যে আমাদের কিছু করা দরকার। লকডাউনের কারণে যারা কাজ হারিয়েছেন, তাদের এখন কাজ ফিরে পাওয়ার কথা। এতদিনে ক্ষুদ্র ব্যবসাও খুলে যাওয়ার কথা।’

আসন্ন অর্থবছরে সামাজিক সুরক্ষা খাতে ১ লাখ ৭ হাজার ৬১০ কোটি টাকা বরাদ্দ দেওয়া হয়েছে। বার্ষিক হিসেবে ১২ শতাংশ বৃদ্ধি পেলেও, ২০০৯-১০ ও ২০২০-২১ অর্থবছরে বরাদ্দের গড় প্রবৃদ্ধি ১৭ দশমিক ৭ শতাংশের চেয়ে এটি কম।

এ ছাড়া, এর প্রায় ৩০ শতাংশই অবসরপ্রাপ্ত সরকারি চাকরিজীবী ও মুক্তিযোদ্ধাদের পেনশনের জন্য বরাদ্দ।

২০২১-২২ অর্থবছরে সামাজিক সুরক্ষার নিট বরাদ্দ জিডিপির ১ দশমিক ১ শতাংশ, যা চলতি বছরের চেয়ে ৩ শতাংশ বেশি।

অর্থমন্ত্রী এবার এমন একটি বাজেট পরিকল্পনা করেছেন, যার সামনে এবং কেন্দ্রে আছে ব্যবসা। ‘মাল্টিপ্লায়ার ইফেক্টের’ ওপরই সব ভরসা রেখেছেন তিনি। অর্থনীতিতে মাল্টিপ্লায়ার ইফেক্টে তখনই ঘটে, যখন নতুন ব্যয় (রপ্তানি, সরকারি ব্যয় বা বিনিয়োগ) জাতীয় আয় (জিডিপি) বাড়ানোর ক্ষেত্রে ভূমিকা রাখে।

কারণ, এ নতুন ব্যয় অন্য ব্যবসা প্রতিষ্ঠান ও ব্যক্তিদের আয়ের সুযোগ তৈরি করে। আবার, ওই ব্যবসা প্রতিষ্ঠান ও ব্যক্তিরাও তাদের আয়ের একটি অংশ ব্যয় করে, যা অন্যদের আয়ের রাস্তা খুলে দেয়। ব্যয়ের জন্য আয় অবশিষ্ট না থাকা পর্যন্ত এ প্রক্রিয়া অব্যাহত থাকে। ব্যবসার মাধ্যমেই এ বিষয়টি ঘটবে বলে আশা করছেন কামাল।

তিনি বলেন, ‘ব্যবসাই সবকিছুর সূচনা ঘটাবে। তাদের হাত ধরেই মাল্টিপ্লায়ার ইফেক্ট তৈরি হবে। বাজেট ব্যবসাবান্ধব হলে ব্যবসা প্রতিষ্ঠানগুলো ব্যবসা করতে পারবে।’

‘অর্থনীতিতে এগুলো টাকা প্রবাহ নিয়ে আসবে, যা দেশের জন্য ভালো হবে। তারা কর্মসংস্থান তৈরি করবে, মুনাফা করবে আর সরকার কর পাবে। এ কর সামাজিক সুরক্ষা খাতে ব্যবহার করা হবে। ব্যবসাবান্ধব হওয়া সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ বিষয়’, তিনি যোগ করেন।

কিন্তু, ব্যবসাকে সহজ করার ক্ষেত্রে দৃশ্যমান কোনো উন্নতির অভাব এবং অর্থনীতির ওপর মহামারির কালো ছায়ার মধ্যে ব্যবসায়ীরা কামালের প্রত্যাশা অনুযায়ী বিনিয়োগের আত্মবিশ্বাস কীভাবে পাবে, তা ভাবার বিষয়।

আর এই মাল্টিপ্লায়ার ইফেক্টকে তিনি কালো টাকা সাদা করার সুযোগ অব্যাহত রাখার যুক্তি হিসেবে ব্যবহার করবেন। বাজেট বক্তব্য ও সংশ্লিষ্ট নথিপত্রে এ বিষয়টির কোনো উল্লেখ না থাকলেও, কামালের বক্তব্য শুনে মনে হচ্ছে, সংসদে চূড়ান্ত বাজেট পাস হওয়ার সময় এ সুযোগ তিনি অবশ্যই রাখবেন। 

জাতীয় রাজস্ব বোর্ডের তথ্য অনুযায়ী, বর্তমান অর্থবছরের প্রথম ১০ মাসে অপ্রদর্শিত ১৪ হাজার ৪৫৯ কোটি টাকা ১০ শতাংশ কর দিয়ে সাদা করা হয়েছে।

অর্থমন্ত্রী বলেন, ‘পাঁচটি মাল্টিপ্লায়ার ইফেক্ট হবে। এটি কত টাকা আপনারা জানেন? ৭০ হাজার কোটি টাকা। বাংলাদেশের চেহারাই বদলে যাবে। আগামী ছয় মাসের মধ্যে পরিবর্তন দেখতে পাবেন আপনারা।’

সরকারি পরিসংখ্যান সংস্থ্গুলোর বিশ্বাসযোগ্য কোনো ডাটা না থাকা সত্ত্বেও অর্থমন্ত্রী কীভাবে মাল্টিপ্লায়ারের পরিমাণ বলে দিতে পারলেন, তা অবশ্য অবাক হওয়ার মতো বিষয়।

কালো টাকা বৈধ করার বিষয়ে কামাল বলেন, ‘কালো টাকা সাদা করার বিধান সবসময়ই ছিলো। এমনকি সাইফুর রহমান ও হুসেইন মুহাম্মদ এরশাদের সময়ও। ১৫ বছর ধরে ১৪ হাজার কোটি টাকা সাদা করা হয়েছে। আর ১০ মাসে সাদা হয়েছে ১৪ হাজার টাকা। বোঝা যাচ্ছে যে, এর চাহিদা রয়েছে এবং মানুষের এ অর্থনীতির ওপর বিশ্বাস রয়েছে।’

তবে, অর্থনীতিবিদরা এ বিধানের তীব্র বিরোধিতা করছেন। কারণ, খাঁটি করদাতাদের জন্য এটি সাজা হয়ে দাঁড়াবে।

তবে, কামালের জন্য এটি নতুন কিছু নয়। প্রকৃতপক্ষে, খুব কম ক্ষেত্রেই কামালের সঙ্গে অর্থনীতিবিদদের মতের মিল রয়েছে।

কামাল বলেন, ‘আমি সবার সঙ্গে কাজ করার চেষ্টা করি। অর্থনীতিবিদদের উচিত আমার প্রশংসা করা। আমরা দুপক্ষ একই জিনিস চাই। গত বছর খুবই কমসংখ্যক দেশ ইতিবাচক প্রবৃদ্ধির মুখ দেখেছে। আমরা কখনোই নেতিবাচক প্রবৃদ্ধি দেখিনি। এর প্রশংসা হওয়া উচিত।’

 

প্রতিবেদনটি ইংরেজি থেকে অনুবাদ করেছেন জারীন তাসনিম

Comments

The Daily Star  | English
Mirza Fakhrul on polls

Efforts on to make polls questionable and delayed: Fakhrul

Says Chief Adviser Yunus has assured BNP that the election will be held in February 2026

8h ago