মদ-ক্লাব-জুয়া নিয়ে উত্তপ্ত সংসদ
রাজধানীর বিভিন্ন ক্লাব, মদ ও জুয়া নিয়ে আওয়ামী লীগ, বিএনপি, তরিকত ফেডারেশন এবং জাতীয় পার্টির সংসদ সদস্যদের তুমুল তর্কে-বিতর্কে উত্তপ্ত হয়ে ওঠে জাতীয় সংসদ অধিবেশন।
আজ বৃহস্পতিবার অধিবেশনের শুরুতেই পয়েন্ট অব অর্ডারে ফ্লোর নিয়ে আলোচনার সূত্রপাত করেন জাতীয় পার্টির জ্যেষ্ঠ সংসদ সদস্য মুজিবুল হক চুন্নু।
পরে আওয়ামী লীগের শেখ ফজলুল করিম সেলিম, বিএনপির হারুনুর রশীদ, তরিকত ফেডারেশনের সৈয়দ নজিবুল বশর মাইজভাণ্ডারী এবং বিরোধী দলীয় প্রধান হুইপ মশিউর রহমান রাঙ্গাঁ আলোচনায় অংশ নেন। প্রধানমন্ত্রী ও সংসদ নেতা শেখ হাসিনা এ সময় সংসদে উপস্থিত ছিলেন।
পয়েন্ট অব অর্ডারে আলোচনার শুরুতে চুন্নু বলেন, ‘কয়েকদিন যাবৎ একজন চিত্র নায়িকার বিষয়ে আলোচনা হচ্ছে। যেখানে ঘটনাটি ঘটেছে উত্তরা বোট ক্লাব। কে করল এই ক্লাব? এই ক্লাবের সদস্য কারা হয়? শুনেছি ৫০-৬০ লাখ টাকা দিয়ে এর সদস্য হতে হয়। এত টাকা দিয়ে কারা এর সদস্য হয়? আমরাতো ভাবতেই পারি না। সারাজীবন এত ইনকামও করি না।’
রাজধানীর কয়েকটি ক্লাবের নাম উল্লেখ করে জাতীয় পার্টির কো-চেয়ারম্যান চুন্নু বলেন, ‘এসব ক্লাবে মদ খাওয়া হয়। জুয়া খেলা হয়। বাংলাদেশে মদ খেতে হলে লাইসেন্স লাগে। সেখানে গ্যালন গ্যালন মদ বিক্রি হয়। লাইসেন্স নিয়ে খায় তবে এত মদতো বিক্রি হওয়ার কথা নয়।’
কারো নাম উল্লেখ না করে চুন্নু বলেন, ‘সরকারি কর্মকর্তারা এখানে কীভাবে সদস্য হয়? এত টাকা কোথা থেকে আসে?’
রাজধানীর অভিজাত এলাকায় ডিজে পার্টি বন্ধে প্রধানমন্ত্রীর হস্তেক্ষেপ চেয়ে মুজিবুল হক বলেন, ‘গুলশান-বারিধারা এলাকায় ডিজে পার্টি হয়। সেখানে ড্যান্স হয়। নেশা করা হয়। মদ খাওয়া হয়। এসব আমাদের আইনে নেই, সংস্কৃতিতে নেই, ধর্মে নেই। প্রধানমন্ত্রীকে বলবো, আপনি স্বরাষ্ট্রমন্ত্রীকে নির্দেশ দেন কেন এসব হচ্ছে? কেন বন্ধ করা হবে না?’
চুন্নু প্রশ্ন করেন ওইসব ক্লাবের সদস্য কারা হয়? পরীমণির যে ঘটনা সেটা, বোট ক্লাবে। ওই জায়গার একজন মালিক আছে। তিনি যেতেও পারে না। এসব দেখতে হবে।’
রোববার এক ফেসবুক পোস্টে হত্যাচেষ্টা ও ধর্ষণচেষ্টার অভিযোগ সামনে আনেন চিত্রনায়িকা পরীমণি। পরে রাতে বনানীতে নিজের বাসায় তিনি সাংবাদিকদের সামনে সেই রাতের ঘটনার বিবরণ দেন।
সোমবার সাভার থানায় ধর্ষণচেষ্টা, হত্যাচেষ্টা ও মারধরের অভিযোগে মামলা করেন তিনি। মামলার প্রধান আসামি উত্তরা ক্লাবের সাবেক সভাপতি নাসির উদ্দিন মাহমুদ ঢাকা বোট ক্লাবের কার্যনির্বাহী কমিটির সদস্য (বিনোদন ও সংস্কৃতি)। এজাহারের আরেক আসামি তুহিন সিদ্দিকী অমিও বোট ক্লাবের সদস্য।
পুলিশ ইতোমধ্যে তাদের গ্রেপ্তার করেছে। তাদের সঙ্গে বোট ক্লাবের সদস্য শাহ এস আলমকেও ক্লাব থেকে বহিষ্কার করা হয়েছে।
পরীমণির অভিযোগ, গত ৮ জুন রাতে অমি তাকে ‘পরিকল্পিতভাবে’ বোট ক্লাবে নিয়ে গিয়েছিলেন। আর নাসির তাকে ‘ধর্ষণ ও হত্যার চেষ্টা’ চালিয়েছিলেন।
এরপর থেকে আলোচনায় আসে তুরাগ নদীর তীর ঘেঁষে গড়ে ওঠা ঢাকা বোট ক্লাব, যার সভাপতি পদে রয়েছেন পুলিশ প্রধান বেনজীর আহমেদ।
চুন্নুর বক্তব্যের পরপরই আওয়ামী লীগ প্রেসিডিয়াম সদস্য শেখ ফজলুল করিম সেলিম বাংলাদেশে মদ ও জুয়ার লাইসেন্স দেওয়ার জন্য বিএনপির প্রতিষ্ঠাতা জিয়াউর রহমানকে দায়ী করেন।
তিনি বলেন, ‘এতো বোট ক্লাব। জিয়াউর রহমান স্টিমার ক্লাব করেছিল। বঙ্গবন্ধু মদ-জুয়ার লাইসেন্স বন্ধ করে দিয়েছিল। জিয়াউর রহমান আবার দিয়েছিল। যারা অপরাধের শুরু করেছে তাদের আগে বিচার করা উচিত। ওখান থেকে ধরতে হবে।’
বিএনপির সংসদ সদস্য হারুনুর রশীদ এ সময় বলেন, ‘আমাদের বিরোধী দলের একজন সংসদ সদস্য একটা বিষয়ে প্রধানমন্ত্রীকে অনুরোধ করেছেন। কিন্তু সিনিয়র এক সদস্য (শেখ সেলিম) কোথায় চলে গেলেন? বাংলাদেশে অনেক বিদেশি থাকেন। এ ছাড়া, অন্য ধর্মের মানুষদের জন্য মদের বৈধতা আছে। কোনো মুসলমানের জন্য আইনে অনুমতি নেই। জিয়াউর রহমান যদি মুসলমানদের মদের লাইসেন্স দিয়ে থাকেন, যদি প্রমাণ করতে পারেন আমি সংসদ সদস্য পদ ছেড়ে দেবো।’
তিনি বলেন, ‘এসব ক্লাবে, মদের ব্যবসার সঙ্গে সরকারি লোক জড়িত। আমি চ্যালেঞ্জ করছি। পুলিশ এসব জায়গা থেকে টাকা নেয়। প্রধানমন্ত্রী কোনো দলের নয়, তিনি রাষ্ট্রের প্রধানমন্ত্রী। এসব খুঁজে দেখা হোক।’
হারুনের বক্তব্যের পর শেখ সেলিম আবারও বক্তব্য রাখেন। তিনি বলেন, ‘লাকী খানের নাচের কথা কি ভুলে গেলেন? হিযবুল বাহার? জিয়াউর রহমান ওগুলো করেছিল। সরকার কোনো মুসলমানকে মদের পারমিশন দেয়নি। বন্ধ করতে গেলে আপনারাই (বিএনপি) চিল্লাচিল্লি করবেন। বলবেন, ফরেনারদের পারমিশন লাগবে।’
তরিকত ফেডারেশনের নজিবুল বশর মাইজভাণ্ডারী বলেন, ‘হারুন সাহেবের সদস্য পদ আজই ছেড়ে দেওয়া উচিত। তিনি বললেন, জিয়াউর রহমান মুসলমানদের মদ খাওয়ার অনুমোদন দেননি। তিনি দেখাক, আইনে কোথায় বলা আছে মুসলমানরা মদ খেতে পারবেন না। আইন এখানে এনে দেখাক। পদ ছেড়ে দিক।’
জাতীয় পার্টির সদস্য এবং বিরোধী দলীয় প্রধান হুইপ মশিউর রহামান বলেন, ‘এখানে রাষ্ট্রীয় কিছু বিষয় আছে। বঙ্গবন্ধু লাইসেন্স দেননি। তারপরও আইনটা অপব্যবহার হচ্ছে। ক্লাবগুলোতে একজন ডাক্তার দিয়ে সার্টিফিকেট নিয়ে নেয়, দৈনিক মদ খেতে হবে। তারপর লাইসেন্স নেওয়া হয়। বিএনপি এই লাইসেন্স দিয়েছিল। এখন কোনো মুসলমান যদি মদ খায় সেখানে সরকারের কিছু করার নেই।’
বিরোধী দলীয় প্রধান হুইপ আবু ত্ব-হা মোহাম্মদ আদনানকে খুঁজে বের করার দাবি জানান।
পরীমণির মামলায় আটক জাতীয় পার্টির সভাপতিমণ্ডলীর সদস্য নাসির উদ্দিন মাহমুদের বিষয়ে রাঙ্গাঁ বলেন, ‘পরীমণি অভিযোগ করেছেন, প্রধানমন্ত্রীর কাছে আবেদন করেছেন, একজনকে গ্রেপ্তার করা হয়েছে। বিচার হবে। দোষী হলে শাস্তি হবে।’
Comments