নারীর প্রতি সাইবার অপরাধ বাড়ছে, ৭ মাসে ১৫ হাজার অভিযোগ

সামাজিক যোগোযাগমাধ্যম ব্যবহার করে বিপুল সংখ্যক সাইবার অপরাধী নারী ও শিশুদের শোষণ, নিপীড়ন ও ব্ল্যাকমেইলের মতো কাজ করছে। কার্যক্রম শুরুর পর থেকে সাত মাসে এমন অন্তত ১৫ হাজার সাইবার অপরাধের অভিযোগ পেয়েছে পুলিশ সদর দপ্তরের পুলিশ সাইবার সাপোর্ট ফর ওম্যান (পিসিএসডব্লিউ) শাখা।
Cyber Crime.jpg
প্রতীকী ছবি: সংগৃহীত

সামাজিক যোগোযাগমাধ্যম ব্যবহার করে বিপুল সংখ্যক সাইবার অপরাধী নারী ও শিশুদের শোষণ, নিপীড়ন ও ব্ল্যাকমেইলের মতো কাজ করছে। কার্যক্রম শুরুর পর থেকে সাত মাসে এমন অন্তত ১৫ হাজার সাইবার অপরাধের অভিযোগ পেয়েছে পুলিশ সদর দপ্তরের পুলিশ সাইবার সাপোর্ট ফর ওম্যান (পিসিএসডব্লিউ) শাখা।

১৬ বছরের কিশোরী অন্তিকার (ছদ্মনাম) মা এ অভিযোগকারীদের একজন।

অন্তিকা একটি নামকরা স্কুলের ছাত্রী। এক বছরের বেশি সময় ধরে স্কুল বন্ধ থাকায় বন্ধুদের সঙ্গে যোগাযোগ রাখার জন্য সামাজিক যোগযোগমাধ্যম ব্যবহার করতে শুরু করে সে।

ভিডিও শেয়ারিং অ্যাপ লাইকিতে এক যুবকের সঙ্গে পরিচয় হয় তার। অন্তিকাকে বয়স, পড়াশোনা ও পারিবারিক ইতিহাস নিয়ে মিথ্যা তথ্য দিয়ে তার সঙ্গে একটি সম্পর্ক গড়ে তোলেন ওই যুবক।

কয়েক মাস পর অন্তিকা সব বুঝতে পারে। কিন্তু, ততক্ষণে অনেক দেরি হয়ে গেছে। তার ব্যক্তিগত ছবি ও ভিডিও ক্লিপ লোকটির হাতে চলে গেছে। অন্তিকা তার সঙ্গে যোগাযোগ বন্ধ করে দিলে, বিভিন্ন সামাজিক যোগযোগমাধ্যম প্ল্যাটফর্মে এসব ছবি ও ভিডিও আপলোড করতে শুরু করেন লোকটি।

অন্তিকার মায়ের অভিযোগ পেয়ে পিসিএসডব্লিউ অভিযুক্তকে খুঁজে বের করতে পারে। তার বিরুদ্ধে আইনি ব্যবস্থা নেওয়া হয়েছে। 

শুধু লাইকিই নয়, টিকটক, বিগো লাইভ, ইমো ও ফেসবুক ব্যবহার করেও এ ধরনের অপরাধমূলক কার্যক্রম চালানো হচ্ছে। পিসিএসডব্লিউ’র তথ্য অনুযায়ী, মোবাইল ফোনেও বিপুল সংখ্যক নারীদের হয়রানি করছে অপরাধীরা। 

আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী সংস্থাগুলো সম্প্রতি এমন একটি মানবপাচার চক্রের সন্ধান পেয়েছে, যারা টিকটক প্ল্যাটফর্মকে ব্যবহার করে নারীদের ‘ভারতে ভালো চাকরি’ দেওয়ার আশ্বাস দেয় এবং সেখানে নিয়ে যৌনকর্মী হিসেবে ব্যবহার করে।

এ ছাড়া, সম্প্রতি বিগো লাইভে টাকার বিনিময়ে লাইভ স্ট্রিমিং শো দেখানোর বিষয়টি সামনে এসেছে। গ্রাহকদের জন্য নারীদের লাইভ স্ট্রিমিং শো হোস্ট করার কারণে অ্যাপটির এজেন্ট ও কান্ট্রি ম্যানেজারকে গ্রেপ্তার করা হয়েছে।

অভিযোগের প্রকারভেদ

পিসিএসডব্লিউ’র ফেসবুক পেজে ১০ হাজার ৪০টি অভিযোগের তথ্য পেয়েছে দ্য ডেইলি স্টার। এ ছাড়া, ফোন ও মেইলের মাধ্যমেও অভিযোগ পেয়েছে পিসিএসডব্লিউ। এর মধ্যে চার হাজার ৭০৩টি অভিযোগের ব্যাপারে আইনি ব্যবস্থা বা ইন্টারনেট থেকে কনটেন্ট সরিয়ে নেওয়ার মতো ব্যবস্থা নেওয়া হয়েছে।

প্রাপ্ত তথ্য অনুসারে, এখন পর্যন্ত যে অভিযোগটি সবচেয়ে বেশি পাওয়া গেছে তা হলো- নারীদের নাম ব্যবহার করে ভুয়া অ্যাকাউন্ট খুলে তাদের অপদস্থ করা। মোট অভিযোগের ২৮ দশমিক ৭ শতাংশ অভিযোগই এ সংক্রান্ত।

এ ছাড়া, অভিযোগের ২০ দশমিক ৯৫ শতাংশ অভিযোগ নারীর ব্যক্তিগত কনটেন্ট প্রকাশ করে দেওয়া সংক্রান্ত। এসব ব্যক্তিগত কন্টেন্টের মধ্যে সুনির্দিষ্টভাবে নগ্ন ছবি ছড়িয়ে দেওয়ার অভিযোগ আছে চার দশমিক ৩৬ শতাংশ। অন্যান্য অভিযোগের মধ্যে ব্ল্যাকমেইলের অভিযোগ আছে প্রায় ১০ শতাংশ। আর অ্যাকাউন্ট হ্যাকের অভিযোগ ৭ দশমিক ৮ শতাংশ।

এসব অভিযোগের তদন্ত করতে গিয়ে পিসিএসডব্লিউ’র জন্য সবচেয়ে বড় বাধা হয়ে দাঁড়ান অভিযোগকারীরাই। তারণ তাদের অনেকেই তদন্তের জন্য প্রয়োজনীয় তথ্য দিতে চান না। পিসিএসডব্লিউ দুই হাজার ৫৫৮টি অভিযোগের ব্যাপারে বিস্তারিত তথ্য চাইলে অন্তত এক হাজার ৬৫৯ জন অভিযোগকারী তথ্য দিতে রাজি হননি।  

সাইবার অপরাধের কবলে পড়া নারীদের বয়স বেশিরভাগ ক্ষেত্রেই ১৭ থেকে ৩০ বছরের মধ্যে।

পুলিশ সদর দপ্তরের সহকারী মহাপরিদর্শক মীর আবু তৌহিদ জানান, আরও বেশি ঝামেলায় পড়ার আশঙ্কায় অনেক নারীই অপরাধীদের বিরুদ্ধে মামলা করতে চান না। 

নীলার (ছদ্মনাম) ঘটনাটি এমনই।

সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে মধ্যপ্রাচ্যে বসবাসরত এক ব্যক্তির সঙ্গে পরিচয় হয় নীলার। একপর্যায়ে তারা বিয়েও করেন। কিন্তু, এর পরপরই তিনি আবিষ্কার করেন, তার স্বামী আরেকটি সম্পর্ক চালিয়ে যাচ্ছেন। একসময় নীলা তাকে ডিভোর্স দিয়ে দিলে লোকটি সামাজিক যোগযোগমাধ্যমে নীলার নামে ভুয়া অ্যাকাউন্ট খুলে তার ব্যক্তিগত ছবি শেয়ার করতে শুরু করেন।

এ ব্যাপারে জিডি করলেও নিজের ও পরিবারের সম্মানের কথা চিন্তা করে মামলা করতে রাজি হননি নীলা। ভবিষ্যতে আর এমন কিছু না করার চুক্তিতে সই করার পর তার সাবেক স্বামীকে তাই ছেড়ে দেওয়া হয়।

ভারতে পাচার

সম্প্রতি কিছু বাংলাদেশি তরুণীকে ভারতে পাচার করে যৌনকর্মী হিসেবে কাজ করতে বাধ্য করা হয়। ওই তরুণীদের ফাঁদে ফেলতে টিকটিক অ্যাপ ব্যবহার করা হয়েছিল।

ভারতে ২২ বছর বয়সী এক বাংলাদেশি তরুণীকে নির্যাতন ও যৌন নিপীড়নের ভিডিও সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে ছড়িয়ে পড়ার পর বাংলাদেশের আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী পাচার চক্রটির সন্ধান পায়। চক্রটি বাংলাদেশ ও ভারতীয় নাগরিকদের নিয়ে গড়ে উঠেছে।

তদন্তকারীরা বলছেন, গত দুই বছরে চক্রটি ৫০ জনেরও বেশি নারীকে পাচার করেছে। সংযুক্ত আরব আমিরাতসহ মধ্যপ্রাচ্যের আরও কিছু দেশে তাদের নেটওয়ার্ক বিস্তৃত আছে।

বাংলাদেশ জাতীয় মহিলা আইনজীবী সমিতির সভাপতি সালমা আলী দ্য ডেইলি স্টারকে বলেন, ‘যারা অপরাধের শিকার হয়েছেন, তাদের সহযোগিতার অভাব, থানায় সাইবার পুলিশিংয়ে দক্ষ জনবলের অভাব এবং আরও বেশি ঝামেলায় পড়ার আশঙ্কার কারণে মানুষ মামলা করতে আগ্রহী হয় না।’

তার পর্যবেক্ষণ বলছে, স্কুল-কলেজ এক বছরের বেশি সময় ধরে বন্ধ থাকায় সাইবার অপরাধ বেড়েছে।

সালমা আলী বলেন, ‘কিশোর ও তরুণরা সাইবার স্পেসে অনেক বেশি সময় কাটাচ্ছে। সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে প্রবেশ সহজ হওয়ায় তারা সহজেই অল্প বয়সী মেয়েদের টার্গেট করতে পারছে। যে নারীদের ডিজিটাল জ্ঞান অল্প, তারা সহজেই তাদের শিকারে পরিণত হচ্ছেন।’

‘টিকটক বা লাইকির মতো প্ল্যাটফর্ম নিষিদ্ধ করার বদলে, সরকারের উচিত এগুলোতে নজরদারির আরও ভালো উপায় খুঁজে বের করা। যেন এসব প্ল্যাটফর্ম ব্যবহার করে এ ধরনের অপরাধ সংঘটিত না হতে পারে’, যোগ করেন তিনি।  

পুলিশ সদর দপ্তরের এআইজি মীর আবু তৌহিদ জানান, সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে নজরদারির জন্য পুলিশ সদর দপ্তরে তাদের একটি বিশেষ টিম রয়েছে। সম্প্রতি নজরদারি আরও বাড়ানোর এবং সার্ভিস প্রোভাইডারদের জবাবদিহিতার আওতায় আনার সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়েছে। 

শিগগিরই সব থানায় এ নির্দেশনা জানিয়ে দেওয়া হবে বলেও উল্লেখ করেন তিনি।

পুলিশের অপরাধ তদন্ত বিভাগের (সিআইডি) স্পেশাল সুপারিন্টেনডেন্ট (সাইবার ইন্টেলিজেন্স অ্যান্ড রিস্ক ম্যানেজমেন্ট) রেজাউল মাসুদ দ্য ডেইলি স্টারকে জানান, কোন অ্যাপ্লিকেশনগুলো ক্ষতিকর এবং আইন লঙ্ঘন করছে, তা খুঁজে বের করতে তাদের একটি নজরদারি প্রক্রিয়া আছে।

প্রতিবেদনটি ইংরেজি থেকে অনুবাদ করেছেন জারীন তাসনিম

Comments

The Daily Star  | English

DMCH doctors threaten strike after assault on colleague

A doctor at Dhaka Medical College Hospital (DMCH) was allegedly assaulted yesterday after the death of a private university student there, with some of his peers accusing the physicians of neglecting their duty in his treatment

5h ago