লকডাউন: যখন দরকার তখন নয়, অনেক দেরিতে
স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের রোগতত্ত্ব ও জনস্বাস্থ্য কমিটি ২৯ মে করোনাভাইরাসের ডেল্টা ভ্যারিয়েন্টের সংক্রমণ শুরু হয়েছে এ রকম সাতটি জেলায় তাৎক্ষণিকভাবে ‘লকডাউন’ দেওয়ার সুপারিশ করেছিল।
কিন্তু সরকার সময় মতো উদ্যোগ নিতে ব্যর্থ হয় এবং সুপারিশটি বাস্তবায়নের ক্ষেত্রে দীর্ঘসূত্রিতা দেখায়।
কমিটির সুপারিশের পর ৩১ মে মন্ত্রিসভা থেকে খুলনা ও রাজশাহী বিভাগের সাতটি জেলার কর্মকর্তাদেরকে উদ্যোগ নিতে বলা হয়। জীবিকা রক্ষার অজুহাতে লকডাউনের সিদ্ধান্তকে বিলম্বিত করা হয়।
সম্প্রতি লকডাউন আরোপ করা হয়েছে কিন্তু ইতোমধ্যে সেই সাতটি এবং আরও অনেক জেলা কোভিড-১৯ এর হটস্পটে পরিণত হয়েছে।
লকডাউনের জন্য প্রস্তাবিত জেলাগুলো ছিল নওগাঁ, রাজশাহী, নাটোর, কুষ্টিয়া, যশোর, খুলনা ও সাতক্ষীরা এবং তাদের বেশিরভাগই গত ১০ দিন ধরে এ ধরনের বিধি-নিষেধের আওতায় রয়েছে।
অন্য দিকে, প্রতিদিনই দেশে সার্বিক করোনা পরিস্থিতির অবনতি হচ্ছে।
স্বাস্থ্য সেবা বিভাগের গতকাল দেওয়া তথ্য অনুযায়ী, ২৪ ঘণ্টায় ৬৭ জন করোনায় আক্রান্ত হয়ে মারা গেছেন, যা ২ মে এর পরে সর্বোচ্চ সংখ্যক মৃত্যু। সংক্রমণের হার বেড়ে ১৮ দশমিক দুই শতাংশ হয়েছে। ২৯ মে সংক্রমণের হার মাত্র সাত দশমিক ৯১ শতাংশ ছিল।
বিশেষজ্ঞরা বলেছেন যে, পরিস্থিতির এতটাই অবনতি হয়েছে যে আর একটি মাত্র শিথিল উদ্যোগও ভয়াবহ পরিণতি ডেকে আনতে পারে।
কোভিড-১৯ বিষয়ক জাতীয় কারিগরি উপদেষ্টা কমিটির (এনটিএসি) সদস্য অধ্যাপক নজরুল ইসলাম গতকাল দ্য ডেইলি স্টারকে বলেন, ‘ইতোমধ্যে অনেক দেরি হয়ে গেছে। যখন আপনি লকডাউন আরোপের ক্ষেত্রে একদিনও দেরি করেন, তখন দেশজুড়ে রোগীর সংখ্যা বেড়ে যায়। সরকার ইতোমধ্যেই অনেক সময় নষ্ট করে ফেলেছে।’
সাতটি জেলার মধ্যে কয়েকটিতে প্রতি দুই জন রোগীর নমুনা পরীক্ষার ক্ষেত্রে একজনের করোনাভাইরাস ধরা পড়েছে। স্বাস্থ্য সেবা বিভাগের তথ্য অনুযায়ী প্রতিদিনই সেখানে অন্তত ডজন খানিক মানুষের মৃত্যু হচ্ছে।
হাসপাতালের ধারণক্ষমতা পূর্ণ থাকার কারণে অনেকেই বিনা চিকিৎসায় মারা যাচ্ছেন।
এ ছাড়া, স্বাস্থ্য সেবা বিভাগের হিসাবে উচ্চ ঝুঁকিপূর্ণ জেলার সংখ্যা গতকাল পর্যন্ত ৫৪, যা ৩ জুন পর্যন্ত ৩৬ ছিল।
সরকারের রোগতত্ত্ব, রোগ নিয়ন্ত্রণ ও গবেষণা ইনস্টিটিউটের (আইইডিসিআর) সংজ্ঞা অনুযায়ী, একটি জেলাকে উচ্চ ঝুঁকিপূর্ণ হিসেবে তখনই বিবেচনা করা হবে যখন সেখানে সংক্রমণের হার ১০ শতাংশ বা তার চেয়ে বেশি হবে।
খুলনায় সর্বোচ্চ ২৪ জন ব্যক্তি কোভিড-১৯ এ আক্রান্ত হয়ে মারা যাওয়ার পর জেলা প্রশাসন গতকাল সেখানে চলাফেরার ওপর বিধিনিষেধ আরোপ করার সিদ্ধান্ত নিয়েছে, যা আগামী মঙ্গলবার থেকে কার্যকর হবে।
এ পর্যন্ত করোনাভাইরাসের ডেল্টা ভ্যারিয়েন্টের দ্রুত বাড়তে থাকা সংক্রমণকে নিয়ন্ত্রণে আনার জন্য সর্বমোট ১২টি জেলায় বিধি-নিষেধ আরোপ করা হয়েছে।
সাতক্ষীরা, খুলনা, বাগেরহাট, রাজশাহী, চাঁপাইনবাবগঞ্জ, বগুড়া, নাটোর, কুষ্টিয়া, চুয়াডাঙ্গা, নোয়াখালী, জামালপুর ও দিনাজপুরে পরিস্থিতি তুলনামূলকভাবে খারাপ।
প্রকাশিত তথ্য থেকে জানা গেছে যে, গত সপ্তাহের তুলনায় নতুন সংক্রমণ ৫৫ দশমিক ১৬ শতাংশ বেড়েছে এবং মৃত্যুর সংখ্যা গত সাত দিনে (গতকাল পর্যন্ত) ৪৬ দশমিক ৩০ শতাংশ বেড়েছে।
সংক্রামক রোগ বিশেষজ্ঞ অধ্যাপক রিদওয়ানুর রহমান দ্য ডেইলি স্টারকে গতকাল জানান, ‘যেহেতু দেশব্যাপী সংক্রমণের হার ১৫ শতাংশের চেয়ে বেশি, সে ক্ষেত্রে সারা দেশে লকডাউন দেওয়ার কোনো বিকল্প নেই। একইসঙ্গে লকডাউনটিকে ফলপ্রসূ করার জন্য প্রচুর পরিমাণে পরীক্ষার ব্যবস্থা করা উচিত। কিন্তু সরকার কখনোই সে রকম কিছু করেনি।’
‘সরকার লকডাউনের ব্যাপারে যা বলেছে, তা কার্যকর করে দেখায়নি। সরকারি উদ্যোগগুলো মূলত লোক দেখানো। ফলস্মরূপ, মানুষ এখন স্বাস্থ্যবিধি মেনে চলার ব্যাপারে চরম অনীহা প্রকাশ করছেন’, বলেন তিনি।
তিনি বলেন, কোভিড-১৯ মহামারি ছড়িয়ে পড়ার শুরু থেকেই বিভিন্ন সরকারি সংস্থার মধ্যে সমন্বয়ের অভাবে দেশের মানুষ জীবন-জীবিকা হারাচ্ছেন।
স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের মহাপরিচালক অধ্যাপক এবিএম খুরশিদ আলমও স্বীকার করেছেন এ যাবত বিভিন্ন জেলায় সময় মতো লকডাউন আরোপ করা হয়নি।
তিনি বলেন, ‘এটি প্রমাণিত হয়েছে যে ভাইরাসের সংক্রমণের হারকে কমিয়ে রাখার জন্য লকডাউন একটি কার্যকর উপায়, কিন্তু স্বাস্থ্য অধিদপ্তর এককভাবে এই সিদ্ধান্তটি নিতে পারে না। এই প্রক্রিয়ার সঙ্গে অন্যান্য কর্তৃপক্ষও জড়িত। প্রকৃতপক্ষে কঠোর লকডাউন বাস্তবায়িত হয়নি। তবে কিছু জায়গায় লকডাউন কার্যকর আছে।’
তিনি আরও বলেন, ‘স্বাস্থ্য কর্মকর্তারা এই মুহূর্তে করণীয় বিষয়ে আলোচনায় বসবে। সুপারিশ দেবে। কমিউনিটি সংক্রমণ চলতে থাকলে দেশব্যাপী লকডাউন আরোপ করার কোনো বিকল্প থাকে না। আমরা আবারও এটি চালু করার জন্য অনুরোধ জানাবো। আমরা দ্রুত এ ব্যাপারে আলোচনা করার জন্য বসবো।’
এর আগেও বেশ কয়েকবার স্বাস্থ্য বিশেষজ্ঞরা সময় মতো সংক্রমণের হারকে নিয়ন্ত্রণে আনার জন্য বিমানবন্দর বন্ধ করে দেওয়া এবং স্বাস্থ্যনীতি মেনে চলা নিশ্চিত করার মতো কঠোর উদ্যোগ না নেওয়ার জন্য সরকারকে দায়ী করেছেন।
প্রতিবেদনটি ইংরেজি থেকে অনুবাদ করেছেন মোহাম্মদ ইশতিয়াক খান।
Comments