ফ্রানৎস কাফকা: সাহিত্যের মহাকাশে চির উজ্জ্বল ধূমকেতু
তাকে বলা হয় সাহিত্য ইতিহাসের সবচেয়ে প্রভাবশালী সাহিত্যিক। তার ছোটগল্প ও উপন্যাসের ওপর অনুপ্রাণিত হয়ে ছোটগল্প রচনা হয়েছে আড়াই লাখের বেশি, উপন্যাস লেখা হয়েছে ৫০ হাজারেরও বেশি। আর এটি তো কেবল যারা স্বীকার করেছেন, তাদের হিসাব। আর হিসাবের বাইরে সংখ্যা তো অগণিত। এ পর্যন্ত সাহিত্যে নোবেলজয়ী ৩২ জন সাহিত্যিক নিজেদের সাহিত্যে তার প্রভাবের কথা উল্লেখ করেছেন।
অথচ তার ৪১ বছরের ক্ষুদ্র জীবন ছিল অসহনীয় যন্ত্রণার। একসময় তো সেই অসহনীয় স্বাস্থ্যের ওপর রাগের মাথায় নিজের সব রচনা, সৃষ্টিকর্ম পুড়িয়েও ফেলতে চেয়েছিলেন। জীবিত থাকাকালে যিনি ছিলেন অনেকখানি পর্দার অন্তরালে, সেই তিনিই মৃত্যুর পর জয় করলেন সব পৃথিবী। তিনি পৃথিবীর ইতিহাসের সবচেয়ে প্রভাবশালী সাহিত্যিক ফ্রানৎস কাফকা।
ফ্রানৎস কাফকার জন্ম ১৮৮৩ সালের ৩ জুলাই অস্ট্রিয়া ও হাঙ্গেরি সাম্রাজ্যের প্রাহার এক মধ্যবিত্ত ইহুদি পরিবারে। বর্তমানে সেই প্রাহা এখন চেক প্রজাতন্ত্রের রাজধানী প্রাগ। তার বাবা হারমেইন কাফকা ছিলেন ফেরিওয়ালা। তিনি প্রথম দিকে প্রাগের রাস্তায় রাস্তায় ঘুরে ফেরি করে নানা জিনিস বিক্রি করতেন। ফ্রানৎস কাফকার পৈত্রিক নিবাস ছিল দক্ষিণ বোহিমিয়ার একটি ছোট ইহুদি অধ্যুষিত গ্রামে। সেখানে বাস করতেন ফ্রানৎস কাফকার দাদা জ্যাকব কাফকা। ফ্রানৎস কাফকার জন্মের দুই বছর আগে হারমেইন কাফকা পুরো কাফকা পরিবারকে প্রাগ শহরে নিয়ে আসেন। ফ্রানৎস কাফকার জন্মের কয়েক বছরের মাথায় যেন ভাগ্যের পরিবর্তনের দেখা পেল বাবা হারমেইন কাফকা। আগে ফেরি করলেও এবার হারমেইন কাফকা নিজের পুঁজিতে কাপড়ের দোকান দিলেন। সেই দোকানে কর্মচারীর সংখ্যাই ছিল ১৫ জন। মা জুলি কাফকার কাছেই পড়াশোনার হাতেখড়ি হয়েছিলো ফ্রানৎস কাফকার। কাফকার মা তার বাবার চেয়েও বেশি শিক্ষিত ছিলেন।
যখন কাফকার আশপাশের সবাই আঞ্চলিক জার্মান ভাষায় কথা বলছে, ঠিক তখন মা জুলির কড়া শাসন ও তীক্ষ্ণ নজর ছিল ছেলের ওপর, যেন ছেলে উচ্চশ্রেণির জার্মানি ভাষায় কথা বলে। ফ্রানৎস কাফকা ছিলেন ছয় ভাই-বোনের মধ্যে জ্যেষ্ঠ। কাফকার বয়স যখন সাত বছর, তখন তার ছোট দুই ভাই জর্জ ও হাইনরিখ মারা গেছেন। আর পরবর্তীতে তার তিন বোনের মৃত্যু হয়েছিল দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধে। ফ্রানৎস কাফকার বাবা হারমেইন ও মা জুলি নিজেদের পারিবারিক ব্যবসায় ভীষণ ব্যস্ত ছিলেন। তাই ফ্রানৎস কাফকার শৈশবের শেষভাগ অনেকটাই একাকিত্বের মধ্যে কেটেছিল। বাড়ির গৃহকর্মীদের সঙ্গেই বেড়ে ওঠা তার। বাবার সঙ্গে কাফকার সম্পর্কের টানাপোড়ন বোঝা যায় তার লেখা বিখ্যাত রচনা ‘ব্রিফ এন দেন ভেটার’ বা ‘বাবার কাছে চিঠি’তে। যেখানে কাফকা তার বাবাকে অভিযোগের সুরে স্বৈরাচারি ও মাত্রাতিরিক্ত চাহিদাসম্পন্ন মানুষ হিসেবে তুলে ধরেছিলেন।
কাফকার প্রাতিষ্ঠানিক পড়াশোনার সূচনা হয় ছয় বছর বয়সে ডয়েচ ক্যানাবেনশুল জার্মান বয়েজ এলিমেন্টারি স্কুলে ভর্তির মধ্য দিয়ে। সালটি ছিল ১৮৮৯। সেখানে পাঁচ বছর পড়েছিলেন কাফকা। ১৮৯৩ সালে তিনি উত্তীর্ণ হলে তার বাবা তাকে হাইস্কুলে ভর্তি করিয়ে দিয়েছিলেন। কিন্তু, সেই স্কুলে জার্মান ভাষার মাধ্যমে পাঠদান করা হতো। কিন্তু, কাফকা ছিলেন চেক ভাষায় পারদর্শী। যদিও তিনি চেক ভঙ্গিতে জার্মান বলতেন। অন্যদিকে জার্মানেও তার ভালো দখল ছিল। কারণ, তার শৈশবে আশপাশের মানুষ চেক ও জার্মান দুই ভাষাতেই পারদর্শী ছিল। সেই হাইস্কুলে কাফকা পুরো আট বছর পড়াশোনা করেছিলেন। কাফকার প্রাতিষ্ঠানিক পড়াশোনার ফলাফল ছিল অসম্ভব ভালো। ১৯০১ সালে উচ্চ মাধ্যমিক পাস করার পর কাফকা ভর্তি হলেন প্রাগের জার্মান চার্লস-ফার্দিন্যান্দ বিশ্ববিদ্যালয়ের রসায়ন বিভাগে। কিন্তু, এই বিভাগে ভর্তি হয়ে তিনি দেখলেন এ নীরস একটি বিষয়। কোনো মজা পাচ্ছেন না তিনি।
তাই মাত্র দুই সপ্তাহের ব্যবধানে তিনি রসায়ন বিভাগ ছেড়ে ভর্তি হন আইন বিভাগে। যদিও আইন বিভাগে পড়ার কোনো আগ্রহ তার ছিলো না, কিন্তু, তিনি ভাবলেন অন্তত রসায়ন থেকে তো মুক্তি পাওয়া গেল। আর আইন বিভাগে তার ভর্তি হওয়ার আরও দুটো কারণ হলো— আইন পেশায় যথেষ্ট সম্ভাবনা থাকায় তার বাবা খুশি হবেন এবং বিশ্ববিদ্যালয়ে আইন বিভাগের কোর্স ছিল অনেক দীর্ঘ। তাই তার চিন্তা ছিল দীর্ঘ কোর্স হওয়া কারণে তিনি দীর্ঘকাল ধরে বিশ্ববিদ্যালয়ে অবস্থান করতে পারবেন। আবার একইসঙ্গে কাফকা তার প্রিয় বিষয় যেমন: ইতিহাস, কলা ও জার্মান শিক্ষায় ছোট ছোট কোর্স করতে পারবেন। বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়ার সময়ে প্রথম বর্ষের শেষদিকে ম্যাক্স বোর্ড নামে বিশ্ববিদ্যালয়েরই এক ছাত্রের সঙ্গে পরিচয় হলো কাফকার। যার সঙ্গে পরবর্তী জীবনেও গভীর বন্ধুত্ব ছিল কাফকার।
বিশ্ববিদ্যালয়ের আইন বিভাগ থেকে পাস করার পর চাকরিতে ঢুকেছিলেন কাফকা। পাশাপাশি লেখালেখিও শুরু করলেন। কাফকার প্রথম কর্মস্থল ছিল ইতালিয়ান বীমা কোম্পানি ‘অ্যাস্সিকুরাজিওনি জেনারালি’। সেখানে ছিল ভীষণ কাজের চাপ। সকাল আটটা থেকে শুরু করে সন্ধ্যা ছয়টা পর্যন্ত কাজ করে লেখালেখিতে সময় দিতে পারছিলেন না বলে চাকরিটাই ছেড়ে দিলেন। চাকরি নিলেন অন্য এক বীমা কোম্পানিতে। দৈনিক ছয় ঘণ্টার চাকরি, সঙ্গে চলছে লেখালেখি। ১৯০৮ সালে কাফকার প্রথম লেখা ছাপা হয়েছিল।
১৯১৭ সালে কাফকার যক্ষ্মা ধরা পড়ে। এই রোগের কারণে নিজেকে গুটিয়ে নেন কাফকা। তখন তিনি লিখেছেন ‘দ্য ট্রায়াল’। যক্ষ্মার কারণে কাফকাকে চাকরি থেকে পেনশন দিয়ে বাধ্যতামূলক ছাড়িয়ে দেওয়া হয়।
জীবনে বিয়ে করেননি কাফকা। প্রকৃত অর্থে কখনো সেই সুযোগই পাননি তিনি। প্রেম করেছেন তিন বার। দুই বার বাগদান হয়েও ভেঙে গেছে সম্পর্ক। প্রেমিকার চোখে কাফকা ছিলেন কাগুজে প্রেমিক। এর কারণও আছে। প্রথম প্রেমিকা ফেরিস বাউয়ারকে তিনি পাঁচ শর বেশি চিঠি লিখেছেন।
দ্বিতীয় প্রেমিকা মিলেনাকেও লিখেছেন প্রায় চার শর মতো চিঠি। প্রথম প্রেমিকা ফেরিস বাউয়ারের সঙ্গেই দুই বার বাগদান হয়েছিল কাফকার। কিন্তু, সম্পর্ক টেকেনি। কাফকার শেষ প্রেমিকা ছিলেন ডোরা ডিয়ামান্ট। ১৯২৩ সালে কাফকার জীবনপ্রদীপ যখন একটু একটু করে নিভে আসছে, তখন তার সঙ্গে পরিচয় হয় ডোরার। মৃত্যু যখন ঠিক দরজায় কড়া নাড়ছে, ঠিক তখন দুই জন মিলে পরিকল্পনা করলেন তারা ফিলিস্তিন যাবেন, সুখের সংসার শুরু করবেন। রেস্তোরাঁ খুলে ডোরা রান্না করবেন, আর কাফকা হবেন ওয়েটার। সুন্দর ছিমছাম আর নির্ভেজাল বাকি জীবনটা দুই জন একসঙ্গে কাটিয়ে দেবেন। কিন্তু, সেই সুযোগ আর কাফকা পেলেন না।
যক্ষ্মায় আক্রান্ত হলেন আবারও। অসুস্থ হওয়ার আগে অবশ্য নিয়মিত শরীরচর্চা করতেন কাফকা। নিয়মিত সাঁতার কাটতেন, দুই বেলা সাইকেল চালাতেন, বন্ধুদের সঙ্গে দূরে কোথাও বেড়িয়ে আসতেন। তবে, তার কোলাহল ভীষণ অপছন্দ ছিল। প্রকৃতির মাঝেই তিনি থাকতে পছন্দ করতেন। চা, সিগারেট, মদ কিছুরই নেশা ছিল না। নিজে ভীষণ স্বাস্থ্য-সচেতন ছিলেন বলে জীবনের অধিকাংশ সময়েই ছিলেন অনেকটাই নিরামিষভোজী। সকালে ঘুম থেকে উঠে লিখতে বসা, রাতে তাড়াতাড়ি ঘুমানো, সবই ছিলো ভীষণ নিয়মতান্ত্রিক।
মাত্র ৪০ বছরের জীবন কাফকার। যক্ষ্মায় আক্রান্ত হয়ে ক্ষণে ক্ষণে মৃত্যুর দিকে এগিয়ে যাচ্ছেন ফ্রানৎস কাফকা। অসুস্থতার জন্যে কাফকা খেতে পছন্দ করতেন না। হেনরি ফ্লেচার নামের এক পুষ্টি গবেষকের কাছ থেকে অনুপ্রাণিত হয়ে তিনি বরং অল্প খাবার অনেকক্ষণ মুখে দিয়ে রাখতেন। কিছুক্ষণ পর পর চিবিয়ে নিতেন। কাফকার ধারণা ছিল, একমাত্র এভাবে খেলেই খাবারের প্রতিটি উপাদানকে সঠিকভাবে কাজে লাগানো সম্ভব। এই ভয়ানক বাজে অভ্যাস তাকে তো সুস্থ করলোই না, বরং তাকে মারাত্মক স্বাস্থ্যহানির দিকে ঠেলে দিলো।
তখন সমস্ত শরীরে তার প্রচণ্ড ব্যথা। জীবনের অন্তিম সময়ের কয়েকদিন আগে নিজের একটি লেখার বড় অংশ নিজেই পুড়িয়ে দিলেন। বাকি যা ছড়িয়ে-ছিটিয়ে ছিল, তা বন্ধু ম্যাক্স ব্রডকে পুড়িয়ে দেওয়ার অনুরোধ করে এক চিঠি লিখে গেলেন। বললেন তার সব পাণ্ডুলিপি পুড়িয়ে দিতে।
বন্ধু ম্যাক্সকে লেখা কাফকার চিঠিটা ছিল এমন:
‘প্রিয় বন্ধু ম্যাক্স,
“এবার আর বোধহয় যক্ষ্মা আমার পিছু ছাড়বে না। অসুস্থতার কারণে তেমন লেখালেখিও আর হচ্ছে না। আমি শুধু তোমাকে লেখা আমার চিঠিতে আমার লেখার বিষয়ে কিছু অনুরোধ করতে চাই। তুমি জানো আমার প্রকাশিত পাঁচটি বই আর ছোট গল্পগুলো কালের স্রোতে হারিয়ে যাবে। এগুলোর নতুন করে সংস্করণ বের করবে না। আমি চাই না এগুলো আর নতুন করে বের হয়ে কারো সমস্যার কারণ হোক। আর তুমি দয়া করে আমার অপ্রকাশিত লেখাগুলোর সব পাণ্ডুলিপি, চিঠিপত্র সব পুড়িয়ে দিও। আর চিঠি পাওয়ার সঙ্গে সঙ্গেই তোমার হাতের কাছে থাকা আমার যতগুলো লেখা আছে, সব পুড়িয়ে দিও। এটিই হয়তো তোমার কাছে আমার অন্তিম অনুরোধ।”
ইতি
ফ্রানৎস কাফকা’
এরপর কাফকা চলে গেলেন চিরঘুমে। এদিকে বন্ধু ম্যাক্স যত্ন করে সেই পাণ্ডুলিপির একটি উপন্যাস ছাপিয়ে দিলেন। বেরিয়ে আসলো সাহিত্যের সর্বকালের ইতিহাসের অন্যতম শ্রেষ্ঠ উপন্যাস ‘দ্য ট্রায়াল’।
যে ফ্রানৎস কাফকা মরে যেতে চাইতেন প্রতিক্ষণে, যে কাফকা নিজের সব সৃষ্টি পুড়িয়ে দিতে চেয়েছিলেন, যে কাফফা রাগে, কষ্টে, যন্ত্রণায় নিজের সব অস্তিত্বকে ভুলে যেতে চেয়েছিলেন, সেই কাফকাকে ঘিরেই সবচেয়ে বেশি বই লেখা ও গবেষণা হয়েছিল। একমাত্র শেক্সপিয়র ছাড়া তার সাহিত্যই বিশ্বের সবচেয়ে বেশি ভাষায় অনূদিত হয়েছে।
মৃত্যুর পরে কাফকা যেন জয় করলেন পুরো পৃথিবী। পৃথিবীর তাবৎ সাহিত্যকর্মে আজও প্রথম প্রভাবের কথা বলতে গেলে সর্বপ্রথম উঠে আসে ফ্রানৎস কাফকারই নাম।
তথ্যসূত্র:
ফ্রানৎস কাফকা: অ্যা বায়োগ্রাফি/ ম্যাক্স ব্রড
কাফকা অ্যান্ড প্রাগ/ কুয়ার্ট ক্রোলপ
Comments