প্লেব্যাক সম্রাটবিহীন একবছর

মারা যাওয়ার আগে কিছু কী টের পেয়েছিলেন? সে কারণেই কী দীর্ঘ নয় মাস সিঙ্গাপুরে চিকিৎসা শেষে দেশে ফিরে ঢাকায় কয়েকদিন থেকেই চলে গিয়েছিলেন জন্ম শহর রাজশাহীতে। প্রাণের মধ্যে কী কোনো টান অনুভব করেছিলেন শৈশব-কৈশোর-যৌবনের শহরের। অবশেষে ক্যান্সারের কাছে পরাজিত হয়ে ২০২০ সালের ৬ জুলাই ৬৪ বছরে মারা যান প্লেব্যাক সম্রাট এন্ড্রু কিশোর।
এন্ড্রু কিশোর। ছবি: সংগৃহীত

মারা যাওয়ার আগে কিছু কী টের পেয়েছিলেন? সে কারণেই কী দীর্ঘ নয় মাস সিঙ্গাপুরে চিকিৎসা শেষে দেশে ফিরে ঢাকায় কয়েকদিন থেকেই চলে গিয়েছিলেন জন্ম শহর রাজশাহীতে। প্রাণের মধ্যে কী কোনো টান অনুভব করেছিলেন শৈশব-কৈশোর-যৌবনের শহরের। অবশেষে ক্যান্সারের কাছে পরাজিত হয়ে ২০২০ সালের ৬ জুলাই ৬৪ বছরে মারা যান প্লেব্যাক সম্রাট এন্ড্রু কিশোর।

আজ তার প্রয়াণের এক বছর।

জন্মশহর রাজশাহীতে ছিলেন সবার মধ্যমণি। যখন গাইতেন তখন তার কণ্ঠের মায়ায় রানীবাজার, ভুবনমোহন পার্ক আসতো সুনসান নীরবতা। রাজশাহী শহরে দুর্গাপূজার মিউজিক কনসার্টে তার গানের সময় দু’পাশের রাস্তা বন্ধ হয়ে যেত। যেখানেই গান করেছেন, অসংখ্য মানুষের ভালোবাসায় সিক্ত হয়েছেন তিনি।

এন্ড্রু কিশোর ১৯৫৫ সালের ৪ নভেম্বর রাজশাহীতে জন্মগ্রহণ করেন। তার পিতার নাম ক্ষিতীশ চন্দ্র বাড়ৈ এবং মাতা মিনু বাড়ৈ। শৈশব ও কৈশোর কেটেছে রাজশাহীতে। তার মা ছিলেন সংগীত অনুরাগী। মায়ের স্বপ্নপূরণে সংগীতাঙ্গনেই নিজেকে যুক্ত করেন। রাজশাহীর খ্যাতিমান গানের শিক্ষক আবদুল আজিজ বাচ্চুর কাছে প্রাথমিক সংগীতের তালিম নেন। স্বাধীনতাযুদ্ধের পর নজরুল, রবীন্দ্রনাথ, আধুনিক, লোক ও দেশাত্মবোধক গানে রাজশাহী বেতারের তালিকাভুক্ত শিল্পী হন। পড়াশোনা করেছেন রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ে।

দীর্ঘ সংগীত জীবনে ১৫ হাজারেরও বেশি চলচ্চিত্রের গানে প্লেব্যাক করেছেন। ছবি: সংগৃহীত

এন্ড্রু কিশোরের স্ত্রী লিপিকা এন্ড্রু ইতি। এই দম্পতির এক ছেলে ও এক মেয়ে অস্ট্রেলিয়ায় থাকেন। মেয়ে মিনিম এন্ড্রু সংজ্ঞা ও ছেলে জে এন্ড্রু সপ্তক।

বরেণ্য সংগীত পরিচালক আলম খানের হাত ধরে চলচ্চিত্রের প্রথম প্লেব্যাকে অভিষেক হলেও, আহমেদ ইমতিয়াজ বুলবুল, আলাউদ্দিন আলী, শেখ সাদী খানের সঙ্গেও গান করেছেন। এ ছাড়া, নতুন প্রজন্মের ইমন সাহা, আলী আকরাম শুভসহ অনেকের সঙ্গে গান করেছেন। ভারতের প্রখ্যাত সুরকার আর ডি বর্মণের সুরেও গান গেয়েছেন। বাংলাদেশের প্রথম পুরুষ কণ্ঠশিল্পী হিসেবে বলিউডে প্লেব্যাক করেছেন। আর ডি বর্মণের সংগীত পরিচালনায় ‘বিরোধ’ সিনেমার হিন্দি ও বাংলা দুই ভার্সনে গেয়েছিলেন তিনি।

দীর্ঘ সংগীত জীবনে ১৫ হাজারেরও বেশি চলচ্চিত্রের গানে প্লেব্যাক করেছেন। তাকে বলা হতো প্লেব্যাক সম্রাট। চলচ্চিত্রে প্লেব্যাকের জন্য মোট আটবার সেরা গায়ক হিসেবে জাতীয় চলচ্চিত্র পুরস্কার পেয়েছেন। ছবিগুলো হলো- বড় ভালো লোক ছিল (১৯৮২), সারেন্ডার (১৯৮৭), ক্ষতিপূরণ (১৯৮৯), পদ্মা মেঘনা যমুনা (১৯৯১), কবুল (১৯৯৬), আজ গায়ে হলুদ (২০০০), সাজঘর (২০০৭) ও কি যাদু করিলা (২০০৮)। 

শৈশব ও কৈশোর কেটেছে রাজশাহীতে। ছবি: সংগৃহীত

এন্ড্রু কিশোরের গাওয়া উল্লেখযোগ্য গানের মধ্যে আছে- আমার সারা দেহ খেয়ো গো মাটি, আমার বুকের মধ্যেখানে, আমার বাবার মুখে প্রথম যেদিন, আমার গরুর গাড়িতে, তোমায় দেখলে মনে হয়, পড়ে না চোখের পলক, প্রেমের সমাধি ভেঙে, সবাই তো ভালোবাসা চায়, হায়রে মানুষ রঙিন ফানুস, বেদের মেয়ে জোছনা আমায় কথা দিয়েছে, ভালোবেসে গেলাম শুধু ভালোবাসা পেলাম না, শোন গো চাঁদ শোন তারা, আমি একদিন তোমায় না দেখিলে, তুমি আজ কথা দিয়েছ, আমি চিরকাল প্রেমের কাঙাল, এক বিন্দু ভালোবাসা দাও, এক চোর যায় চলে, আমি চাঁদের সাথে দেব না তোমার তুলনা, জীবনের গল্প আছে বাকি অল্প এবং ডাক দিয়াছেন দয়াল আমারে ইত্যাদি।

প্রখ্যাত সুরকার ও সংগীত পরিচালক আলম খান দ্য ডেইলি স্টারকে বলেন, ‘একেবারে অন্যরকম ছিল তার কণ্ঠস্বর। সব ধরনের গান এন্ড্রুর কণ্ঠে মানিয়ে যেত। গানের কথা ও সুর বুঝে গাইতো বলে এটা হয়েছিল। সেই কারণেই শ্রোতারা তার গান পছন্দ করতো। সিনেমার প্লেব্যাকে এমন শক্তিশালী কণ্ঠ খুব বেশি আসেনি। তাকে আমার পরিবারের একজন ভেবেছি সবসময়। আমার আগে পৃথিবী ছেড়ে চলে যাবে, এটা সত্যি ভাবিনি। এটা যে কতো কষ্টের সেটা বোঝাতে পারব না। সবসময় তার কথা আমার মনে পড়ে।’

বরেণ্য সংগীত পরিচালক আলম খানের হাত ধরে চলচ্চিত্রের প্রথম প্লেব্যাকে অভিষেক হয় এন্ড্রু কিশোরের। ছবি: সংগৃহীত

তিনি আরও বলেন, ‘আমার সুরেই এন্ড্রু প্রথম “মেইল ট্রেন” সিনেমার প্লেব্যাক করে “অচিনপুরের রাজকুমারী নাই তার কেউ” গানটি। এটা ১৯৭৭ সালের দিকে হবে। যদিও সেই সিনেমাটা মুক্তি পায়নি। পরে “প্রতিজ্ঞা” সিনেমায় “এক চোর যায় চলে” নামের গানটি রেকর্ড হয়। এই গান তাকে শ্রোতাদের পছন্দের তালিকায় নিয়ে আসে। তখন রাজশাহী থেকে ঢাকায় এসে গান গেয়ে যেত। এমন করতে করতে ১৯৮২ সালের দিকে ঢাকায় নিয়মিত থাকা শুরু করে। তারপরের গল্প সবারই জানা।’

কণ্ঠশিল্পী কুমার বিশ্বজিৎ দ্য ডেইলি স্টারকে বলেন, ‘সত্যিকারের একজন বড়মাপের শিল্পী তিনি। ভাই, বন্ধু হিসেবে তার সঙ্গে মিশেছি। আমার খুব প্রিয় শিল্পীদের একজন। কোনোদিন অহংকার করতে দেখেনি। একসঙ্গে আমরা বেশকিছু গান করেছি। হানিফ সংকেতের “ইত্যাদি” ম্যাগাজিন অনুষ্ঠানে এন্ড্রুদার সঙ্গে কয়েকবার গান করা হয়েছে। আমার সুরে “স্বামী-স্ত্রীর ওয়াদা”য় প্লেব্যাক করেছেন তিনি। আমার কাছে প্লেব্যাকের সম্রাট মনে হতো তাকে। কতোটা যত্ন নিয়ে চলচ্চিত্রের গান করতেন, এটা বোঝাতে পারব না। এমন শিল্পী চলচ্চিত্রে আর আসবে না। চলচ্চিত্রের গানের ইতিহাসে স্বর্ণাক্ষরে লেখা থাকবে তার নাম।’

Comments

The Daily Star  | English

The story of Gaza genocide survivor in Bangladesh

In this exclusive interview with The Daily Star, Kamel provides a painful firsthand account of 170 days of carnage.

1d ago