এটি হত্যাকাণ্ড, দুর্ঘটনা নয়

নারায়ণগঞ্জের খাদ্য প্রস্ততকারক কারখানার ৫১ শ্রমিক নিহত হওয়ার বিষয়টি আকস্মিক কোনো দুর্ঘটনা নয়। পুলিশ বলছে, এ ধরনের বিপর্যয় যে আসন্ন, মালিকরা তা আগে থেকেই জানতেন। কিন্তু, বিপর্যয় ঠেকানোর কোনো ব্যবস্থাই নেননি তারা। 
ছবি: আনিসুর রহমান/ স্টার

নারায়ণগঞ্জের খাদ্য প্রস্ততকারক কারখানার ৫১ শ্রমিক নিহত হওয়ার বিষয়টি আকস্মিক কোনো দুর্ঘটনা নয়। পুলিশ বলছে, এ ধরনের বিপর্যয় যে আসন্ন, মালিকরা তা আগে থেকেই জানতেন। কিন্তু, বিপর্যয় ঠেকানোর কোনো ব্যবস্থাই নেননি তারা। 
৫১ শ্রমিককে পুড়িয়ে মারার অভিযোগে গতকাল শনিবার হাসেম ফুডস লিমিটেডের মালিক মো. আবুল হাসেম, তার চার ছেলে ও আরও তিন অভিযুক্তকে গ্রেপ্তার করেছে পুলিশ।
পুলিশের উপ-মহাপরিদর্শক (ঢাকা রেঞ্জ) হাবিবুর রহমান গতকাল দ্য ডেইলি স্টারকে বলেন, ‘তারা জানতেন যে দাহ্য পদার্থ ও রাসায়নিক দিয়ে ভরা ভবনটিতে যে কোনো সময় আগুন লাগতে পারে। কিন্তু, এ ব্যাপারে তারা কিছুই করেননি। আমরা তাদের বিরুদ্ধে শ্রমিকদের হত্যার অভিযোগ এনেছি।’  
তিনি আরও বলেন, ‘সেখানে পর্যাপ্ত ফায়ার এক্সিট ছিল না। কোনো সুরক্ষা সামগ্রীও ছিল না। এ অগ্নিকাণ্ড নিছক একটি দুর্ঘটনা নয়।’
ভুলতা পুলিশ ফাঁড়ির পরিদর্শক নাজিম উদ্দিন মজুমদার বাদী হয়ে গতকাল রূপগঞ্জ থানায় মামলাটি করেছেন।
হাসেমের চার ছেলে হাসিব বিন হাশেম, তারেক ইব্রাহিম, তাওসিব ইব্রাহিম ও তানজিম ইব্রাহিমকে এ মামলার আসামি করা হয়েছে। অভিযুক্ত ও গ্রেপ্তার অন্যরা হলেন- সজীব গ্রুপের চিফ অপারেটিং অফিসার শাহান শাহ আজাদ, হাসেম ফুডসের ডেপুটি জেনারেল ম্যানেজার মামুনুর রশীদ এবং এর সিভিল ইঞ্জিনিয়ার ও প্রশাসনিক কর্মকর্তা সালাহউদ্দিন।
রূপগঞ্জের কারখানাটির মালিক সজীব গ্রুপের চেয়ারম্যান ও ব্যবস্থাপনা পরিচালক হাসেম এবং তার চার ছেলেকে রাজধানীর গুলশানের বাড়ি থেকে গ্রেপ্তার করা হয়। বাকি তিন জনকে ঢাকার বিভিন্ন স্থান থেকে গ্রেপ্তার করা হয়।  
অভিযুক্ত আট জনের প্রত্যেককে চার দিন করে রিমান্ডে দিয়েছেন নারায়ণগঞ্জের একটি আদালত। 
ইলেকট্রিক সেফটি অ্যান্ড সিকিউরিটি অ্যাসোসিয়েশন অব বাংলাদেশের (ইএসএসএবি) একটি দল ছয় তলা ভবনটি পরিদর্শন করেছে। দলের সদস্যরা সাংবাদিকদের জানিয়েছেন, আগুন থেকে সুরক্ষা ব্যবস্থার অপর্যাপ্ততা দেখে তারা হতবাক হয়ে গেছেন। 
ইএসএসএবির ভাইস প্রেসিডেন্ট মোহাম্মদ মঞ্জুর আলম বলেন, ‘প্রতিটি মৌলিক নিয়মই লঙ্ঘন করা হয়েছে ভবনটিতে। কোনো ফায়ার ডোর, হাইড্র্যান্ট ছিল না। কোনো ইভাকুয়েশন পরিকল্পনা ছিল না। প্রতিটি তলায়ই বাধা। এক একটি সেকশন নেট নিয়ে আটকে রাখা হয়েছে। মনে হচ্ছে, আগুন লাগলে কী করতে হবে-সেই ব্যাপারে কোনো পরিকল্পনাই রাখেননি তারা।’ 
ফায়ার সার্ভিস এবং সিভিল ডিফেন্সের উপ-পরিচালক (অপারেশন অ্যান্ড মেইনটেনেন্স) দেবাশীষ বর্ধন জানিয়েছেন, আগুন লাগলে কী করতে হবে, তার একটি পরিকল্পনা ফায়ার সার্ভিসের কাছ থেকে নেওয়ার কথা ছিল মালিকদের। কিন্তু, তারা তা নেননি। এ ছাড়া, ফায়ার সার্ভিসের অনুমোদনও ছিল না ভবনটির।   
গতকাল ভবন পরিদর্শন করার পর তিনি বলেন, ‘ভবনের চতুর্থ তলার ছাদ ধসে পড়েছে। ফলে পুরো ভবনটিই এখন ঝুঁকিপূর্ণ হয়ে উঠেছে।’
ভবন মালিক হাসেম ২০০৮ সালের সাধারণ নির্বাচনে লক্ষ্মীপুর-৩ সংসদীয় আসনে আওয়ামী লীগ মনোনীত প্রার্থী ছিলেন। তবে বিএনপি প্রার্থী শহীদ উদ্দিন চৌধুরী অ্যানির কাছে পরাজিত হন তিনি। 
গতকাল কারখানাটি পরিদর্শনে গিয়ে স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী আসাদুজ্জামান খান বলেন, ট্র্যাজেডির কারণ হিসেবে কারো অবহেলা খুঁজে পাওয়া গেলে, তাদের ছাড় দেওয়া হবে না।  
‘প্রত্যেক দায়ী ব্যক্তিকে বিচারের আওতায় আনা হবে’, তিনি উল্লেখ করেন।
অগ্নিকাণ্ডের কারণ এখনো জানা না গেলেও, পুলিশের সন্দেহ নিচ তলার বৈদ্যুতিক শর্ট সার্কিট থেকে আগুনের সূত্রপাত হয়েছে। সেখানে কার্টন ও কাগজের রোলের মতো জিনিস সংরক্ষণ করা হতো।  
শুক্রবার ফায়ার সার্ভিসের কর্মীরা জানান, অগ্নিকাণ্ডে মোট ৫২ মারা গেছেন। তবে, পুলিশ ও জেলা প্রশাসন গতকাল জানিয়েছে, মৃতের সংখ্যা ৫১।
এর মধ্যে ৪৮ জনের মরদেহই উদ্ধার করা হয়েছে চার তলা থেকে। সেখানকার একমাত্র এক্সিট দরজাটি তালাবদ্ধ ছিল। নিহতদের বেশিরভাগই নারী ও শিশু। তাদের মরদেহগুলো পুড়ে এমন অবস্থা হয় যে কাউকে চেনাই যাচ্ছিল না। এ ছাড়া, ওই ঘটনায় আরও অন্তত ১০ জন আহত হন। কারখানার ছাদ থেকে ফায়ার সার্ভিস ২৫ জনকে উদ্ধার করে। 
ধারণক্ষমতা না থাকায়, ঢাকা মেডিকেল কলেজের মর্গে ৪৯ জনের ময়নাতদন্তের পর ১৫ জনের মরদেহ শহীদ সোহরাওয়ার্দী মেডিকেল কলেজে পাঠায় ঢামেক কর্তৃপক্ষ।  
বাঁচার জন্য তিন তলা থেকে লাফ দিয়ে প্রাণ হারানো ২২ বছর বয়সী মোরসালিনের লাশ পরিবারের কাছে হস্তান্তর করা হয়েছে। 
এ ছাড়া, ডিএনএ পরীক্ষা করে শনাক্তের জন্য ৩৬ জন নিহতের পরিবারের ৫১ সদস্যের নমুনা সংগ্রহ করা হয়েছে। কয়েকটি পরিবার ক্ষতিপূরণ দাবি করেছে। 
ঘটনাস্থলে থাকা ফায়ার ব্রিগেড অ্যান্ড সিভিল ডিফেন্সের পরিচালক (অপারেশনস) লেফট্যানেন্ট কর্নেল জিল্লুর রহমান বলেন, ‘আমরা পর্যাপ্ত ফায়ার ফাইটিং সরঞ্জাম পাইনি। ভবনটির কিছু অংশ তালাবদ্ধ ছিল। পার্টিশনগুলোর জন্য অনেকেই বের হতে পারেননি। এগুলো আগুন ও প্রাণহানির একটি কারণ হতে পারে।’ 
তিনি আরও বলেন, ‘বৈদ্যুতিক স্পার্ক থেকে আগুনের সূত্রপাত হতে পারে। কারণ মেশিন ও কাঁচামাল একই জায়গায় রাখা ছিল।’ 
পুরো ভবনটিই দাহ্য পদার্থ দিয়ে ভরা ছিল বলে জানান তিনি। 
হাসেম ফুডসের বিবৃতি 
শুক্রবার এক বিবৃতিতে হাসেম ফুডস বলে, আগুন লাগার সঙ্গে সঙ্গেই কর্তৃপক্ষ ফায়ার সার্ভিসকে খবর দিয়েছিল। নিজেদের ফায়ার হাইড্রেন্টও ব্যবহার করেছে তারা। 
এ ছাড়া, কোম্পানির পক্ষ থেকে আহতদের চিকিৎসা দেওয়া হবে এবং নিহতদের পরিবারের পাশে দাঁড়ানো হবে বলে বিবৃতিতে উল্লেখ করা হয়। 
ইংরেজি থেকে অনুবাদ করেছেন জারীন তাসনিম

Comments

The Daily Star  | English

One month of interim govt: Yunus navigating thru high hopes

A month ago, as Bangladesh teetered on the brink of chaos after the downfall of Sheikh Hasina, Nobel Laureate Muhammad Yunus returned home to steer the nation through political turbulences.

10h ago