জনপ্রশাসনের উচ্চপর্যায়ে অস্বাভাবিক পদোন্নতি

সরকারের জনপ্রশাসন বিভাগে অস্বাভাবিক পদোন্নতির কারণে উচ্চপর্যায়ে লোকবল অনেক বেড়ে গেলেও, নিচের দিকের পদ ফাঁকা থাকছে। এতে এক ধরনের ভারসাম্যহীনতা দেখা দিচ্ছে এবং অ্যাডমিন ক্যাডারের বাইরের কর্মকর্তাদের মধ্যে হতাশা তৈরি হচ্ছে।

কিছু ক্ষেত্রে ভারসাম্যহীনতা এতটাই বেশি যে শীর্ষ পদের কর্মকর্তাদের সংখ্যা অনুমোদিত পদের তিন গুণেরও বেশি, যেখানে কয়েক হাজার পদ শুধু কাগজে কলমেই বিদ্যমান।

যেমন, বর্তমানে ৯৯টি পদের বিপরীতে ৩০৯ জন অতিরিক্ত সচিব (গ্রেড-২) আছেন। অর্থাৎ এই পদে ২১০ জনের ইন-সিটু পদোন্নতি হয়েছে।

অন্যদিকে জনপ্রশাসন মন্ত্রণালয়ের তথ্য অনুযায়ী, প্রথম শ্রেণির কর্মকর্তাদের ক্ষেত্রে প্রতি পাঁচটি পদের বিপরীতে অন্তত একটি পদ খালি আছে।

ইন-সিটু কর্মকর্তারা আগের অফিস ও একই দায়িত্ব পালন করলেও পদের দিক থেকে তারা উচ্চপদে আছেন এবং সেই অনুযায়ী বেতনও পাচ্ছেন। এই ধরনের পদোন্নতি নিয়ে অনেক প্রশ্ন উঠছে।

মোট ২৬টি ক্যাডারের মধ্যে কেবল প্রশাসন ক্যাডারের কর্মকর্তারা দীর্ঘদিন ধরে এ ধরনের পদোন্নতির সুবিধা পেয়ে আসছে। অন্যান্য ক্যাডারের কর্মকর্তারা এটিকে বৈষম্যমূলক বলে অভিহিত করেছেন।

২০১৮ সালের নভেম্বর মাসে পুলিশ ক্যাডারের ২৪ ও ২৫তম ব্যাচের কর্মকর্তারা এই ধরনের পদোন্নতি পেয়েছিলেন, যা পুলিশ প্রশাসনে বিরল ঘটনা।

একটি আদর্শ কার্যকরী আমলাতন্ত্রের কাঠামো পিরামিডের মতো হওয়া উচিত, যেখানে নীচের দিকে বেশি সংখ্যক জনবল ও উপরের দিকে কম জনবল থাকবে।

বিশেষজ্ঞ ও সাবেক আমলারা বলেছেন, দেশের আমলাতন্ত্রের বর্তমান কাঠামো ঠিক নেই। তাদের মতে, এতে কর্মক্ষমতার পাশাপাশি বিভিন্ন স্তরের কর্মকর্তাদের মধ্যে সম্প্রীতি নষ্ট হয়।

সর্বশেষ সরকারি 'সিভিল অফিসার্স অ্যান্ড স্টাফ ২০২০' এর পরিসংখ্যান গত ১৫ জুন প্রকাশিত হয়েছে। সেখানে ৩৭০টি অনুমোদিত পদের বিপরীতে ৪৯০ জন কর্মকর্তা যুগ্ম-সচিব (গ্রেড-৩) পদে আছেন বলে উল্লেখ করা হয়। এছাড়া, ১৩৫টি পদের বিপরীতে ১৬৫ জন কর্মকর্তা গ্রেড-৪ (সিলেকশন গ্রেড) পদে আছেন। এগুলো যুগ্ম-সচিব ও উপসচিবের (গ্রেড ৫) মাঝামাঝি স্তরে পড়ে।

বিপরীতে, নয়টি পদের বাকি ছয়টিতে জনবল সংকট আছে। গ্রেড-৬ (সিনিয়র সহকারী সচিব) ও গ্রেড-৯ (সহকারী সচিব) এর অবস্থা সবচেয়ে ভয়াবহ। এখানে এক হাজার ৭৪০টি পদের বিপরীতে ৮৮৬ জন সিনিয়র সহকারী সচিব এবং এক হাজার ৩১৪টি পদের বিপরীতে ৭৩৬ জন সহকারী সচিব আছেন।

এ অবস্থা সত্ত্বেও সমকালের সাম্প্রতিক প্রতিবেদন অনুযায়ী, সরকার যুগ্ম-সচিবদের আরেকটি ব্যাচকে শিগগির অতিরিক্ত সচিব পদে পদোন্নতি দিতে যাচ্ছেন।

সাবেক মন্ত্রিপরিষদ সচিব আলী ইমাম মজুমদার দ্য ডেইলি স্টারকে বলেন, 'এই ধরনের পদোন্নতি (ইন-সিটু) প্রশাসনের জন্য ভালো নয়। অনুমোদিত পদগুলোর সঙ্গে সামঞ্জস্য করে পদোন্নতি দেওয়া উচিত।'

বিশেষজ্ঞদের মতে, ইন-সিটু প্রমোশনের জন্য কোন নির্দিষ্ট নির্দেশনা নেই। এতে তদবির ও রাজনৈতিক বিবেচনায় 'পিক অ্যান্ড চয়েজ' এর সুযোগ তৈরি করে।

ট্রান্সপারেন্সি ইন্টারন্যাশনাল বাংলাদেশের (টিআইবি) সাম্প্রতিক এক জরিপে দেখা গেছে, জনপ্রশাসনের বর্তমান অবস্থা নানা ধরনের সমস্যার সৃষ্টি করে।

টিআইবির নির্বাহী পরিচালক ইফতেখারুজ্জামান বলেন, যে কোনো কার্যকরী সংস্থার অর্গানোগ্রামের তুলনায় জনপ্রশাসনের শীর্ষ পদের কাঠামো 'একেবারে বিপরীত'।

তিনি দ্য ডেইলি স্টারকে বলেন, 'এই সাংগঠনিক কাঠামো প্রশাসনিক দক্ষতা ও কার্যক্ষমতা বাড়াতে বাঁধা দেয়। এটি নিচের স্তরের কর্মকর্তাদের পদোন্নতির ক্ষেত্রেও বাধা সৃষ্টি করে এবং সিদ্ধান্ত গ্রহণ প্রক্রিয়ায় দীর্ঘসূত্রিতা তৈরি করে।'

কেন এমন পদোন্নতি?

২০০৬ সালের আগে 'ইন-সিটু' শব্দটি বাংলাদেশের জনপ্রশাসনে খুব বেশি পরিচিত ছিল না। গত ১০ বছরে এই ধরনের পদোন্নতি খুব বেশি দেখা গেছে। 

অ্যাডমিন ক্যাডার বাইরের অন্যান্য ক্যাডার সার্ভিসের কর্মকর্তারা জানিয়েছেন, পদ খালি না থাকায় পদোন্নতির জন্য তাদেরকে বছরের পর বছর অপেক্ষা করতে হচ্ছে।

নাম প্রকাশ না করার অনুরোধ জানিয়ে এক কর্মকর্তা বলেন, 'কিন্তু প্রশাসন ক্যাডারের ক্ষেত্রে বিষয়গুলো ভিন্ন।'

পুলিশের পদোন্নতির দাবির মুখে সরকার ২০১৮ সালের নভেম্বরে ২৩০ জন অতিরিক্ত পুলিশ সুপারকে এসপি পদে ইন-সিটু পদোন্নতি দেন।

বেশ কয়েকজন পুলিশ কর্মকর্তা জানান, পুলিশ ক্যাডারে এটিই ছিল প্রথম ও এখন পর্যন্ত শেষ ইন-সিটু পদোন্নতি।

প্রশাসনের একজন কর্মকর্তার মতে, প্রশাসন ক্যাডারে উপসচিবের ওপরে খুব কম পদ থাকায় এখানে প্রতিযোগিতা তীব্র। সাম্প্রতিক বছরগুলোতে ব্যাচের ভিত্তিতে পদোন্নতি একটি রীতি হয়ে গেছে।

নাম প্রকাশ না করা শর্তে তিনি বলেন, 'এর মানে হলো যদি একটি নির্দিষ্ট ব্যাচের কর্মকর্তাদের সংখ্যা বেশি হয়, পদোন্নতির সংখ্যাও বেশি হয়। এভাবেই পদের চেয়ে পদোন্নতির সংখ্যা বেশি।'

'নেতিবাচক প্রভাব'

আলী ইমাম মজুমদার সম্প্রতি জানান, ২০০৬ সালের আগে ভবিষ্যতের শূন্য পদ বিবেচনা করে ইন-সিটু পদোন্নতি দেওয়া হতো। কিন্তু, সংখ্যাটি খুবই কম ছিল।

বিএনপি নেতৃত্বাধীন সরকারের মেয়াদের শেষদিকে ২০০ থেকে ৩০০ জন কর্মকর্তাকে উপসচিব পদে পদোন্নতি দেওয়া হয়। তবে, পদোন্নতিপ্রাপ্ত কর্মকর্তাদের ওই সরকার নির্দিষ্ট দপ্তরে পদায়ন করে যেতে পারেনি।

পরে, তত্ত্বাবধায়ক সরকারের সময় দেখা যায় উপসচিব পদের অনেক কর্মকর্তার কোনো কাজ নেই। তবে, সহকারী সচিব ও সিনিয়র সহকারী সচিবের অভাব।

ওই উপসচিবদের কাজ দিতে তখন পদের চেয়ে অতিরিক্ত পদোন্নতি ব্যবস্থা চালু করা হয়েছিল। তবে, তত্ত্বাবধায়ক সরকার প্রয়োজন শেষ হয়ে গেলে এই ধরনের পদগুলো বাতিল করার সিদ্ধান্ত নিয়েছিল।

সাবেক এই মন্ত্রিপরিষদ সচিব বলেন, 'কিন্তু, ২০০৯ সালে দায়িত্ব নেওয়ার পর আওয়ামী লীগ নেতৃত্বাধীন সরকার "ব্যাপক পদোন্নতি" দেওয়া শুরু করে। সেগুলো অনুমোদিত পদগুলোর সঙ্গে অসঙ্গতিপূর্ণ ছিল।

এছাড়া, পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয় এবং পুলিশ বাহিনীতেও প্রশাসনিক কাঠামোর উচ্চ পদগুলোতে প্রয়োজনের তুলনায় লোকবল বেশি বলে উল্লেখ করেন তিনি।

তিনি বলেন, 'পুলিশেও পদের তুলনায় অতিরিক্ত পদোন্নতি চলছে। এছাড়াও, পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়গুলো সিভিল সার্ভিসের অংশ না হলেও উচ্চ পদগুলোতে লোকবল বেশি আছে।'

প্রশাসন ক্যাডারের পদোন্নতির ক্ষেত্রে অসামঞ্জস্য সুবিধা ভোগের প্রভাব সম্পর্কে জানতে চাইলে ড. ইফতেখারুজ্জামান বলেন, 'এটি আন্তঃক্যাডার সম্পর্কের ওপর বিরূপ প্রভাব ফেলে।'

তিনি বলেন, 'অন্যান্য ক্যাডারের বঞ্চিত কর্মকর্তারা এটিকে বৈষম্যমূলক বলে মনে করেন। এটি তাদের কর্মক্ষমতাকে প্রভাবিত করে।'

গত ২৯ জুলাই ডেইলি স্টার জনপ্রশাসন মন্ত্রণালয়ের সিনিয়র সচিব কে এম আলী আজমকে কিছু গ্রেডে ইন-সিটু পদোন্নতির অবিশ্বাস্য সংখ্যা সম্পর্কে জিজ্ঞাসা করেছিল। তখন তিনি জানিয়েছিলেন, তাকে প্রথমে তথ্যগুলো যাচাই করতে হবে। তিনি এই প্রতিবেদককে ১ আগস্ট কল করতে বলেন।

পরবর্তীতে বারবার ফোন এবং এসএমএসের মাধ্যমে তার সঙ্গে যোগাযোগ করার চেষ্টা করা হলেও তাকে পাওয়া যায়নি।

দ্য ডেইলি স্টার গতকাল জনপ্রশাসন প্রতিমন্ত্রী ফরহাদ হোসেনের সঙ্গে কথা বলার চেষ্টা করলে তার সঙ্গেও যোগাযোগ করা যায়নি।

ইংরেজি থেকে অনুবাদ করেছেন সুমন আলী।

Comments

The Daily Star  | English

JP central office vandalised, set ablaze

A group of unidentified people set fire to the central office of Jatiyo Party in Dhaka's Kakrail area this evening

1h ago