মুক্তিযুদ্ধ

২০ সেপ্টেম্বর ১৯৭১: বাংলাদেশের মুক্তি সংগ্রামকে স্বীকৃতি দেওয়া নৈতিক দায়িত্ব

মুক্তিযুদ্ধের ইতিহাসে ২০ সেপ্টেম্বর গুরুত্বপূর্ণ ও ঘটনাবহুল একটি দিন। এদিন দিল্লিতে ৩ দিনব্যাপী আন্তর্জাতিক সম্মেলনের তৃতীয় ও সমাপনী দিনে বিভিন্ন দেশের প্রতিনিধিরা বলেন 'বাংলাদেশের মুক্তি সংগ্রামকে স্বীকৃতি দেওয়া নৈতিক দায়িত্ব। কারণ এতে করে গণ মানুষের চাওয়া পূর্ণ হবে এবং ভারত যদি স্বীকৃতি দেয় তবে অন্য দেশের জন্য সহজ হবে। সম্মেলনের শেষ দিনে বেশ কয়েকটি প্রস্তাবের সুপারিশ করা হয়। তার মধ্যে বঙ্গবন্ধুর মুক্তির জন্য প্রতিনিধিরা বিভিন্ন দেশগুলোতে গিয়ে সুপারিশ করবেন। পাকিস্তানে সমস্ত প্রকার সাহায্য বন্ধ করতে প্রচেষ্টা চালানো হবে, দিল্লিতে পাকিস্তান মিশনে গণহত্যার প্রতিবাদ করবেন, শরণার্থী শিবিরগুলোতে পরিদর্শন করবেন।

মুক্তিযুদ্ধের ইতিহাসে ২০ সেপ্টেম্বর গুরুত্বপূর্ণ ও ঘটনাবহুল একটি দিন। এদিন দিল্লিতে ৩ দিনব্যাপী আন্তর্জাতিক সম্মেলনের তৃতীয় ও সমাপনী দিনে বিভিন্ন দেশের প্রতিনিধিরা বলেন 'বাংলাদেশের মুক্তি সংগ্রামকে স্বীকৃতি দেওয়া নৈতিক দায়িত্ব। কারণ এতে করে গণ মানুষের চাওয়া পূর্ণ হবে এবং ভারত যদি স্বীকৃতি দেয় তবে অন্য দেশের জন্য সহজ হবে। সম্মেলনের শেষ দিনে বেশ কয়েকটি প্রস্তাবের সুপারিশ করা হয়। তার মধ্যে বঙ্গবন্ধুর মুক্তির জন্য প্রতিনিধিরা বিভিন্ন দেশগুলোতে গিয়ে সুপারিশ করবেন। পাকিস্তানে সমস্ত প্রকার সাহায্য বন্ধ করতে প্রচেষ্টা চালানো হবে, দিল্লিতে পাকিস্তান মিশনে গণহত্যার প্রতিবাদ করবেন, শরণার্থী শিবিরগুলোতে পরিদর্শন করবেন।

২০ সেপ্টেম্বর মুজিবনগর থেকে পাঠানো এক বিজ্ঞপ্তিতে বলা হয়, জাতিসংঘের উদ্দেশ্যে মুজিবনগর সরকারের যে সকল সদস্য নিউইয়র্কে যাবেন তাদের মধ্যে ৮ জন আগামীকাল কলকাতা থেকে দিল্লি যাবেন। তারপর তারা দিল্লি থেকে নিউইয়র্ক যাবেন। এরই মধ্যে তারা কলকাতায় পৌঁছেছেন। অন্যদিকে লন্ডন থেকে প্রবাসী বাংলাদেশ সরকারের বিশেষ দূত আবু সাইদ চৌধুরী সরাসরি লন্ডন থেকে নিউইয়র্কে যাবেন।

ঢাকায় এদিন

২০ সেপ্টেম্বর পাকিস্তান ডেমোক্রেটিক পার্টি (পিডিপি) কেন্দ্রীয় কমিটির সভা দলটির অন্যতম প্রতিষ্ঠাতা ও জাতীয় পরিষদ সদস্য সৈয়দ আজিজুল হকের বাসায় অনুষ্ঠিত হয়। এই সভায় উপনির্বাচন পিছিয়ে দেওয়ার ব্যাপারে নূরুল আমিনের দেয়া বিবৃতিকে অনুমোদন করা হয়। একই দাবি জানান কাইয়ুম মুসলিম লীগের সাধারণ সম্পাদক খান এ সবুরও।

২০ সেপ্টেম্বর পূর্ব পাকিস্তানের শ্রম, সমাজকল্যাণ ও পরিবার পরিকল্পনামন্ত্রী এ এস এম সোলায়মান বলেন, 'পাকিস্তানের বীর সেনাবাহিনী শত্রুকে নির্মূল করে দিয়েছে। শত্রুরা প্রিয় মাতৃভূমি পাকিস্তান ভাঙতে চেয়েছিল। কোনো শক্তিই পাকিস্তান ভাঙতে পারবে না।'

ভারতে এদিন

২০ সেপ্টেম্বর ভারতের পাঞ্জাব রাজ্যের লুধিয়ানায় এক সমাবেশে ভারতের প্রধানমন্ত্রী ইন্দিরা গান্ধী বলেন, যেসব সরকার বা মানুষ বাংলাদেশে চলমান গণহত্যা ও পৈশাচিকতাকে পাকিস্তানের রাজনৈতিক সমস্যা ও অভ্যন্তরীণ বিষয় বলে মন্তব্য করবে তারা পক্ষান্তরে নিরীহ মানুষের উপর গণহত্যাকেই সমর্থন করছে। ভারত সরকার ভারতে অবস্থানকারী বাংলাদেশের শরণার্থীদের মুক্ত স্বদেশে ফেরত পাঠাতে আগ্রহী। কিন্তু পরিস্থিতি এখনও স্বাভাবিক নয়। আমরা তাদের জেনেশুনে মৃত্যুর মুখে ঠেলে দিতে পারি না। পরিস্থিতি স্বাভাবিক হলেই শরণার্থীরা স্বদেশে ফিরে যেতে পারবেন।'

২০ সেপ্টেম্বর দিল্লিতে ভারতের পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের এক বিজ্ঞপ্তিতে বলা হয়, 'জাতিসংঘের সাধারণ পরিষদের অধিবেশনে যোগ দিতে পররাষ্ট্রমন্ত্রী সরদার শরণ সিং আগামীকাল নিউইয়র্কের উদ্দেশ্যে যাত্রা করবেন। সেখানে পররাষ্ট্রমন্ত্রী বাংলাদেশ বিষয়ে ভারতের অবস্থান প্রকাশ করবেন এবং রাজনৈতিক সমাধানের জন্য নানা প্রস্তাব উত্থাপন করবেন।'

আন্তর্জাতিক মহলে এদিন

২০ সেপ্টেম্বর নিউইয়র্কে জাতিসংঘ মহাসচিব উ থান্টের সঙ্গে দেখা করেন ভারতের পররাষ্ট্র সচিব টি এন কাউল। এসময় টি এন কাউল জাতিসংঘ মহাসচিবকে বিদ্যমান শরণার্থী সমস্যা ও ভারতের অবস্থান নিয়ে আলোচনা করেন। জাতিসংঘ মহাসচিব এসময় চলমান পরিস্থিতিতে জাতিসংঘের উদ্বেগের কথা জানান।

২০ সেপ্টেম্বর সোভিয়েত ইউনিয়নের রাষ্ট্রীয় পত্রিকা 'প্রাভদা' তে আফগানিস্তানের রাজা জহির শাহর সোভিয়েত ইউনিয়ন সফরে দেয়া বিবৃতি প্রকাশিত হয়। যেখানে জহির শাহ শরণার্থীদের দেশে ফিরিয়ে নিতে উপযুক্ত পরিবেশ তৈরিতে পাকিস্তানের প্রতি আহ্বান জানান।

দেশব্যাপী এদিন

দৈনিক ইত্তেফাক পত্রিকায় ২০ সেপ্টেম্বর এক প্রতিবেদনে 'জাতীয় পরিষদের ৭৮টি ও প্রাদেশিক পরিষদের ১০৫টি আসনে উপনির্বাচনের ব্যবস্থা' শিরোনামে এক প্রতিবেদনে বলা হয় '১৯শে সেপ্টেম্বর পাকিস্তান নির্বাচন কমিশন কর্তৃক ঘোষিত কর্মসূচি অনুযায়ী পূর্ব পাকিস্তানের ৭৮টি জাতীয় পরিষদ নির্বাচন এবং ১০৫টি শূন্য প্রাদেশিক পরিষদ আসনে উপনির্বাচন অনুষ্ঠিত হবে। এখানে পাকিস্তান নির্বাচন কমিশনের এক প্রেসনোটে উপরোক্ত তথ্য প্রকাশ করা হয়...।'

উল্লেখ্য জাতীয় পরিষদ ও প্রাদেশিক পরিষদ নির্বাচনের জন্য মনোনয়নপত্র গ্রহণের তারিখ ২৯ ও ৩০ সেপ্টেম্বর, মনোনয়ন বাছাইয়ের তারিখ ১ ও ২ অক্টোবর এবং মনোনয়নপত্র প্রত্যাহারের তারিখ ৮ অক্টোবর নির্ধারণ করা হয়েছিল।

২০ সেপ্টেম্বর 'মুক্তিযুদ্ধ' পত্রিকায় প্রকাশিত এক প্রতিবেদনে বলা হয়, রংপুর জেলার ডিমলা থানার অন্তর্গত সুটিবাড়ি হাটের পশ্চিম জোড়জিগা গ্রামে মুক্তিবাহিনীর অতর্কিত আক্রমণে ৯ পাকসেনা নিহত হয় এবং কয়েকজন অস্ত্রশস্ত্র ফেলে পালিয়ে প্রাণ বাঁচায়। ওই থানার বালাপাড়া গ্রামে মুক্তিবাহিনীর পেতে রাখা মাইনে ৭ জন পাকিস্তানি সেনা নিহত হয়। পরে হানাদাররা বালাপাড়া গ্রাম সম্পূর্ণভাবে জ্বালিয়ে দেয়।

২০ সেপ্টেম্বর 'দাবানল' পত্রিকায় প্রকাশিত এক প্রতিবেদনে বলা হয়, মালিকনগর এলাকায় প্রায় দুই কোম্পানি পাকিস্তানি সেনাদের সঙ্গে মুক্তিবাহিনীর গোলা বিনিময়ে ২ জন পাকিস্তানি সেনা নিহত হয়েছে।

দেশব্যাপী প্রতিরোধ যুদ্ধ

২০ সেপ্টেম্বর কুমিল্লার চৌদ্দগ্রামে মুক্তিবাহিনীর একটি গেরিলা দল ঢাকা চট্টগ্রাম মহাসড়কের জগন্নাথদীঘির কাছে বাজানকারা সেতুটি উড়িয়ে দিয়ে সেতুর পাশে পাকিস্তানি হানাদার বাহিনীর অপেক্ষায় ওঁত পেতে থাকে। এদিকে বাজানকারা সেতু ধ্বংসের সংবাদ পেয়ে ফেনী থেকে পাকিস্তানি হানাদার বাহিনীর একটি বড় দল সেতুর দিকে অগ্রসর হলে হানাদার বাহিনীর উপর অতর্কিত হামলা চালায় গেরিলা দলটি। এসময় হানাদার বাহিনীর এক অফিসারসহ ২৫ জন নিহত হয়।

২০ সেপ্টেম্বর সিরাজগঞ্জের শাহজাদপুরের কায়েমপুরে মুক্তিবাহিনীর ক্যাপ্টেন গাফফারের নেতৃত্বে একটি শক্তিশালী দল নিয়ে কায়েমপুরে যায়। পরদিন ভোরে রেকি করার পর সকাল ১০টার দিকে হানাদার বাহিনীর উপর পাকিস্তানি সেনাদের ওপর আক্রমণ চালায়। এসময় বহু হানাদার সেনা হতাহত হয়।

২০ সেপ্টেম্বর লক্ষ্মীপুরের রামগঞ্জে মুক্তিবাহিনীর কমান্ডার সুবেদার আলী আকবর পাটোয়ারীর নেতৃত্বে মুক্তিবাহিনীর একটি দল হানাদার ও রাজাকারদের রামগঞ্জ অবস্থানের ওপর আক্রমণ চালায়। এসময় হানাদার বাহিনী প্রতিরোধ গড়ে তোলে। দুই পক্ষের মধ্যে তুমুল যুদ্ধে ১৪ হানাদার সেনা নিহত এবং ১৭ জন আহত হয়।

২০ সেপ্টেম্বর চাঁপাইনবাবগঞ্জের সোনা মসজিদের পাশে মুক্তিবাহিনীর মুক্তিযোদ্ধারা ভারতীয় বাহিনীর সহযোগিতায় হানাদার বাহিনীর উপর আর্টিলারি হামলা চালালে অসংখ্য হানাদার সৈন্য নিহত হয়। এসময় মুক্তিবাহিনী ধোবড়া এলাকা পর্যন্ত নিজেদের নিয়ন্ত্রণে আনে।

২০ সেপ্টেম্বর রাজশাহীর চারঘাটে মুক্তিবাহিনীর একটি দল শান্তি কমিটির সেক্রেটারির বাড়ি আক্রমণ করে।

২০ সেপ্টেম্বর দিনাজপুরে ক্যাপ্টেন সুলতান শাহরিয়ার রশিদের নেতৃত্বে তিন কোম্পানি মুক্তিযোদ্ধা পাকিস্তানি হানাদার বাহিনীর অমরখানা অবস্থানের উপর আক্রমণ চালালে দুই পক্ষের মধ্যে ব্যাপক যুদ্ধ হয়।

২০ সেপ্টেম্বর ফেনীর ছাগলনাইয়ায় মুক্তিবাহিনীর কমান্ডার সুবেদার রহমান আলীর নেতৃত্বে মুক্তিবাহিনীর একটি দল পাকিস্তানি হানাদার বাহিনীর চম্পকনগর বিওপি আক্রমণ করে। এসময় মুক্তিবাহিনীর হামলায় ৩ হানাদার সেনা নিহত হয়।

২০ সেপ্টেম্বর খুলনার আশাশুনি থানার চাপড়ার রাজাকার ক্যাম্পের উপর মুক্তিবাহিনীর একটি দল অতর্কিত হামলা চালায়। এসময় রাজাকারেরা পালিয়ে যায়। মুক্তিবাহিনী ক্যাম্পে থাকা কিছু অস্ত্র ও রসদ নিজেদের দখলে নেয়।

২০ সেপ্টেম্বর সিলেটের কুমারশৈল চা বাগানে মুক্তিযোদ্ধাদের পেতে রাখা মাইন বিস্ফোরণে এক হানাদার সেনা নিহত হয়।

সূত্র-

বাংলাদেশের স্বাধীনতা যুদ্ধ: দলিলপত্র তৃতীয়, পঞ্চম, দশম, দ্বাদশ ও ত্রয়োদশ খণ্ড

দৈনিক ইত্তেফাক ২০ সেপ্টেম্বর ১৯৭১

দৈনিক পাকিস্তান ২১ সেপ্টেম্বর ১৯৭১

দৈনিক অমৃতবাজার পত্রিকা ২১ সেপ্টেম্বর ১৯৭১

[email protected]

Comments

The Daily Star  | English

The story of Gaza genocide survivor in Bangladesh

In this exclusive interview with The Daily Star, Kamel provides a painful firsthand account of 170 days of carnage.

1d ago