১ অক্টোবর ১৯৭১: ‘বাংলাদেশকে স্বাধীন রাষ্ট্রের স্বীকৃতি দেওয়া হোক’

মুক্তিযুদ্ধের ইতিহাসে ১ অক্টোবর গুরুত্বপূর্ণ ও ঘটনাবহুল একটি দিন। এদিন নিউইয়র্কের চার্চ সেন্টারে এক সংবাদ সম্মেলনে  প্রবাসী বাংলাদেশ সরকারের বিশেষ দূত ও বাংলাদেশ প্রতিনিধি দলের নেতা আবু সাঈদ চৌধুরী বলেন, ৩টি শর্ত ছাড়া কোনো আলোচনা হতে পারে না।

মুক্তিযুদ্ধের ইতিহাসে ১ অক্টোবর গুরুত্বপূর্ণ ও ঘটনাবহুল একটি দিন। এদিন নিউইয়র্কের চার্চ সেন্টারে এক সংবাদ সম্মেলনে প্রবাসী বাংলাদেশ সরকারের বিশেষ দূত ও বাংলাদেশ প্রতিনিধি দলের নেতা আবু সাঈদ চৌধুরী বলেন, ৩টি শর্ত ছাড়া কোনো আলোচনা হতে পারে না।

এ ৩টি শর্ত হচ্ছে- বাংলাদেশকে স্বাধীন রাষ্ট্রের স্বীকৃতি দেওয়া হোক, অবিলম্বে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানকে নিঃশর্ত মুক্তি দেয়া হোক এবং বাংলাদেশ থেকে ইয়াহিয়ার হানাদার দখলদার বাহিনীর অপসারণ হোক। তা না হলে কোনো সমাধান বাংলাদেশের জনগণের কাছে গ্রহণযোগ্য হবে না।

এ ছাড়া, জাতিসংঘ এদিন পাকিস্তানের আপত্তির কারণে জাতিসংঘ সাধারণ পরিষদের লাউঞ্জে বাংলাদেশ প্রতিনিধিদলের প্রবেশ নিষিদ্ধ করে। সাংবাদিক ও দর্শনার্থী প্রবেশেও কড়াকড়ি আরোপ করা হয়। পাকিস্তানের স্থায়ী প্রতিনিধি আগা শাহী বেশ কয়েকদিন আগে এ বিষয়ে লিখিত আপত্তি জানিয়েছিলেন।

ঢাকায় এদিন

১ অক্টোবর জমিয়তে উলামায়ে ইসলামের কার্যনির্বাহী কমিটির বৈঠক অনুষ্ঠিত হয়। বৈঠকে উপ-নির্বাচনে অংশগ্রহণের সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়। এতে সভাপতিত্ব করেন শান্তি কমিটির নেতা পীর মোহসেনউদ্দিন। 

এদিন এপিপিকে দেওয়া এক সাক্ষাৎকারে প্রাদেশিক সমবায়, মৎস্য ও সংখ্যালঘু মন্ত্রী আউং শু প্রু বলেন, 'দেশের সংখ্যালঘুদের ওপর অত্যাচার করা হচ্ছে বলে ভারত যে প্রচারণা চালিয়েছে, তা সম্পূর্ণ মিথ্যা। সশস্ত্রবাহিনীর সদস্যরা তাদের জানমালের নিরাপত্তা বিধান করছে।'

১ অক্টোবর চীনের ২২তম জাতীয় দিবস উপলক্ষে এক অনুষ্ঠানে ঢাকায় নিযুক্ত চীনা রাষ্ট্রদূত চ্যাং ইং বলেন, 'বহিরাগত কোনো অপশক্তি যদি পাকিস্তানে আক্রমণ করার ধৃষ্টতা দেখায়, তবে পাকিস্তান ও চীন তার সমুচিত জবাব দেবে। চীন সবসময় পাকিস্তানের পাশে আছে।'

ভারতে এদিন

১ অক্টোবর দিল্লিতে সোভিয়েত প্রেসিডেন্ট নিকোলাই পদগোর্নির সম্মানে ভারতের প্রেসিডেন্ট ভি ভি গিরির দেওয়া ভোজসভায় নিকোলাই পদগোর্নি বলেন, 'ভারতের যে কোনো প্রয়োজনে সোভিয়েত ইউনিয়ন পাশে আছে। সোভিয়েত ইউনিয়ন ও ভারতের মধ্যে আন্তরিক ও বন্ধুত্বপূর্ণ সম্পর্ক ভবিষ্যতেও একই রকম থাকবে। পূর্ব বাংলার বিষয়টি সোভিয়েত ইউনিয়ন ইতোমধ্যেই জাতিসংঘে উত্থাপন করেছে। আমরা আশা করছি শিগগিরই একটি সুষ্ঠু সমাধান হবে।'

আন্তর্জাতিক মহলে এদিন

১ অক্টোবর নিউইয়র্কে জাতিসংঘ সদর দপ্তরে এক সংবাদ সম্মেলনে ব্রিটিশ পররাষ্ট্রমন্ত্রী অ্যালেক ডগলাস হোম বলেন, 'নিঃসন্দেহে পাক-ভারত পরিস্থিতি গুরুতর রূপ লাভ করেছে। অচিরেই এই পরিস্থিতির নিরসন ঘটবে বলে আমি মনে করি না। ভারত-পাকিস্তান সীমান্তে গেরিলা তৎপরতা ও নাশকতামূলক কর্মকাণ্ডে আমরা শঙ্কিত। সম্প্রতি কয়েকটি রিলিফবাহী জাহাজের ক্ষতি করা হয়েছে। ফলে শিপিং ব্যাবস্থায় স্থবিরতা দেখা দিয়েছে। পূর্ব পাকিস্তানের যোগাযোগ ব্যবস্থার উন্নয়নে জাতিসংঘকে কার্যকর ভূমিকা নিতে হবে। একই দিনে যুক্তরাষ্ট্রের পররাষ্ট্রমন্ত্রী উইলিয়াম রজার্সের সঙ্গে বৈঠক করেন অ্যালেক ডগলাস হোম। এ সময় তারা শরণার্থী সমস্যা সমাধান ও বাংলাদেশের নানা সমস্যা নিয়ে আলোচনা করেন। এদিন সন্ধ্যায়  ব্রিটিশ পররাষ্ট্রমন্ত্রী অ্যালেক ডগলাস হোমের সঙ্গে দেখা করেন জাতিসংঘ সাধারণ পরিষদে যোগ দেওয়া পাকিস্তানি প্রতিনিধি দলের নেতা মাহমুদ আলী।

১ অক্টোবর সোভিয়েত ইউনিয়নের রাষ্ট্রীয় পত্রিকা 'প্রাভদা'তে সম্পাদকীয় নিবন্ধ প্রকাশিত হয়। সেই নিবন্ধে বাংলাদেশের সাধারণ মানুষ ও কারখানা শ্রমিকদের প্রতি সদয় আচরণ করার অনুরোধ করা হয়।

এদিন যুক্তরাষ্ট্রের নিউইয়র্কের কলম্বিয়া বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়ুয়া পাকিস্তানী ছাত্রদের সঙ্গে বৈঠক করেন জামায়াত নেতা এ টি সাদী। বৈঠকে তিনি পূর্ব পাকিস্তানের 'বিচ্ছিন্নতাবাদীদের' বিরুদ্ধে সোচ্চার হবার জন্যে ছাত্রদের প্রতি আহ্বান জানান।

বেশ কয়েকজন ব্রিটিশ মন্ত্রী ও হাউস অব কমন্সের এমপির সঙ্গে বৈঠক করার জন্য ১ অক্টোবর ভারতের পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের নীতিনির্ধারণী কমিটির চেয়ারম্যান ডিপি ধর মস্কো থেকে লন্ডনের উদ্দেশে পাড়ি জমান।

দেশব্যাপী প্রতিরোধ যুদ্ধ

১ অক্টোবর নওয়াবগঞ্জের মুক্তিবাহিনীর ওপর আক্রমণকারী হানাদারদের বিরুদ্ধে প্রতিরোধ গড়ে তুলে মুক্তিবাহিনী। এ সময় মুক্তিযোদ্ধারা সমগ্র নওয়াবগঞ্জ থানা নিজেদের নিয়ন্ত্রণে নিয়ে নেন। যুদ্ধে বেশ কয়েকজন হানাদার সেনা নিহত হয়। আহত হয় ৩০ জন হানাদার ও রাজাকার। 

একই দিনে ময়মনসিংহের ভালুকা, কাশীগঞ্জ ও ত্রিশাল থেকে পাকিস্তানি হানাদার  বাহিনীর ৩টি দল বাইন্দা ও বড়াইদ এলাকার দিকে অগ্রসর হলে, আফসার বাহিনীর কোম্পানি কমান্ডার কাশেমের নেতৃত্বে কছিমউদ্দিন, মনেরউদ্দিন ও হাফিজুর রহমানের মুক্তিবাহিনী হানাদার বাহিনীর পথ রোধ করে। এ সময় মুক্তিবাহিনীর সঙ্গে হানাদার বাহিনীর যুদ্ধ হয়। প্রায়  ১৭ ঘন্টার এ যুদ্ধে হানাদার  বাহিনীর ৭১ জন সেনা ও রাজাকার নিহত হয়। অসংখ্য হানাদার সেনা আহত হয়।

১ অক্টোবর বগুড়ার সুকানপুর রেলস্টেশনে রাজাকারদের বড় একটি দল মুক্তিযোদ্ধাদের ওপর হামলা চালায়। এ সময় মুক্তিবাহিনী তীব্র প্রতিরোধ গড়ে তুললে রাজাকাররা হানাদার বাহিনীকে খবর দেয়। এরপর বগুড়া থেকে হানাদার বাহিনীর বড় একটি দল গিয়ে রাজাকারদের সঙ্গে মিলে মুক্তিবাহিনীর উপর হামলা চালায়।  প্রায় ৬ ঘণ্টার এই যুদ্ধে ২০ জন মুক্তিযোদ্ধা শহীদ হন। হানাদার বাহিনী ও রাজাকাররা ২০ মুক্তিযোদ্ধাকে আটক করে। মুক্তিযোদ্ধাদের আশ্রয় দেওয়ার অপরাধে হানাদার বাহিনী নিরীহ গ্রামবাসীদের ওপর গণহত্যা চালায়। এই গণহত্যায় বহু মানুষ শহীদ হন।

১ অক্টোবর চট্টগ্রামের মুক্তিযোদ্ধাদের একটি দল দুর্গাপুর হাইস্কুলের রাজাকার ক্যাম্প আক্রমণ করে। এ সময়  কয়েকজন রাজাকার নিহত হয় এবং বাকিরা পালিয়ে যায়। যুদ্ধ শেষে  ৭টি রাইফেল মুক্তিবাহিনীর হাতে আসে। 

এদিন ফেনীর ফুলগাজীর মুন্সিরহাটে মুক্তিবাহিনীর একটি দল হানাদার বাহিনীর ক্যাম্পে হামলা চালায়। এ সময় কয়েকজন হানাদার সেনা নিহত হয়।

১ অক্টোবর লক্ষ্মীপুরের রায়পুরের রাজাকার প্রশিক্ষণ কেন্দ্রের ওপর আক্রমণ চালিয়ে গেরিলাদের একটি দল কয়েকজন রাজাকারকে হত্যা করে।

এদিন মৌলভীবাজারের ভারত সীমান্তবর্তী কুমারসাইল চা বাগানের পাশে পাকিস্তানি বাহিনীর একটি টহল  দলের উপর আক্রমণ চালায় মুক্তিবাহিনীর একটি দল। এ সময় বেশ কয়েকজন হানাদার সেনা নিহত হয়। 

একইদিনে ৮নং সেক্টরের গোজাডাঙ্গা সাব-সেক্টরের মুক্তিবাহিনীর একটি দল ভারুখালীতে অবস্থানরত পাকিস্তানী হানাদার বাহিনীর উপর অতর্কিতে হামলা  চালায়। এই হামলায় পাকিস্তানি হানাদার বাহিনীর ৪ সেনা নিহত হয়।

১ অক্টোবর সিলেটের পুট্টিছড়া এলাকায় মুক্তিবাহিনী হানাদার বাহিনীর ক্যাম্পে হামলা চালায়। এ সময় ৩ হানাদার সেনা নিহত হয় এবং ১ জন সেনা আহত হয়।

১ অক্টোবর ৫নং সেক্টরের মুক্তিযোদ্ধারা মুরাবস্তিতে হানাদার বাহিনীর অবস্থানের ওপর আক্রমণ করে। এ সময় মুক্তিবাহিনীর হামলায় হানাদারদের ২টি বাঙ্কার ধ্বংস হয়। এ সময় হানাদার বাহিনী তীব্র প্রতিরোধ গড়ে তোলে এবং মুক্তিবাহিনীর ওয়ারলেস সেট নষ্ট  হয়ে যায়। ফলে মুক্তিবাহিনী পিছু হটে ক্যাম্পে ফিরে যায়। 

১ সেপ্টেম্বর ব্রাহ্মণবাড়িয়ার কসবায় মুক্তিবাহিনীর ৪১ সদস্যের একটি গেরিলা দল প্রশিক্ষণ শেষে কসবা থেকে ২টি নৌকায় ঢাকার উদ্দেশে রওনা হয়। কসবার দক্ষিণে শাহ সেতুর কাছে পৌঁছালে সেখানে টহলরত হানাদার সেনারা গেরিলাদের নৌকার ওপর হামলা চালায়। এতে ৫ জন মুক্তিযোদ্ধা  শহীদ হন এবং ৩ জন আহত হন। এ সময় হানাদার বাহিনী মুক্তিযোদ্ধাদের ফেলে যাওয়া ১৫টি রাইফেল ও ৫টি স্টেনগান নিজেদের দখলে নেয়।

১ অক্টোবর নোয়াখালী সদর মহকুমাকে ৪ ভাগে ভাগ করে ৪ জনকে দায়িত্ব দেওয়া হয়। দক্ষিণ-পশ্চিমাংশের দায়িত্ব দেওয়া হয়  সুবেদার মেজর লুৎফর রহমানকে। এ ছাড়া,পূর্ব-দক্ষিণ অংশে সুবেদার ওয়ালীউল্লাহকে,পূর্ব-উত্তরে নায়েক সুবেদার শামসুল হককে এবং  পশ্চিম-উত্তর  অংশে নায়েক সুবেদার ইসহাককে দায়িত্ব দেওয়া হয়।

১ অক্টোবর নেত্রকোনার মোহনগঞ্জে  ১১ নং সেক্টরের  সাবসেক্টর কমান্ডার ক্যাপ্টেন মতিয়ার রহমানের নেতৃত্বে ৩ প্লাটুন মুক্তিযোদ্ধা এবং স্থানীয় মুক্তিযোদ্ধারা একসঙ্গে মোহনগঞ্জ থানা আক্রমণ করেন। এ সময় থানায় থাকা হানাদার সেনারা প্রতিরোধ করার চেষ্টা করলেও, মুক্তিবাহিনীর ব্যাপক প্রতিরোধের মুখে শেষ পর্যন্ত থানার দখল ছেড়ে চলে যায়।

এ ছাড়া, ১ অক্টোবর কুমিল্লা অঞ্চলে মুক্তিযোদ্ধাদের একটি দল লালমাই-সোনাগাজী সড়কের পেপুলিয়া বাজারের কাছে ডিনামাইট লাগিয়ে একটি সেতু উড়িয়ে দেয়।

সূত্র-

বাংলাদেশের স্বাধীনতা যুদ্ধঃ দলিলপত্র ষষ্ঠ, দশম, দ্বাদশ ও ত্রয়োদশ খণ্ড। 

দৈনিক পাকিস্তান, ২ অক্টোবর ১৯৭১

দৈনিক অমৃতবাজার পত্রিকা, ২ অক্টোবর ১৯৭১

দৈনিক আনন্দবাজার, ২ অক্টোবর ১৯৭১

আহমাদ ইশতিয়াক [email protected]

Comments

The Daily Star  | English

Sea-level rise in Bangladesh: Faster than global average

Bangladesh is experiencing a faster sea-level rise than the global average of 3.42mm a year, which will impact food production and livelihoods even more than previously thought, government studies have found.

9h ago