মুক্তিযুদ্ধ

৩ নভেম্বর ১৯৭১: হোসেন আলীকে অবিলম্বে মুক্তির দাবি

মুক্তিযুদ্ধের ইতিহাসে ৩ নভেম্বর গুরুত্বপূর্ণ ও ঘটনাবহুল একটি দিন। এদিন দিল্লিতে বাংলাদেশ মিশনের প্রধান হুমায়ুন রশিদ চৌধুরী পাকিস্তান দূতাবাসে আটক গোয়েন্দা কর্মকর্তা হোসেন আলীর মুক্তি চেয়ে দিল্লিতে নিযুক্ত পাকিস্তানের রাষ্ট্রদূত সাজ্জাদ হায়দারের কাছে চরমপত্র পাঠান।

এতে বলা হয়, 'যদি ৪৮ ঘণ্টার মধ্যে মুক্তি দেওয়া না হয় তাহলে চরম প্রতিশোধ নেবে বাংলাদেশ সরকার।' চরমপত্রে এও বলা হয়, চরমপত্রের মেয়াদ শেষ হবে আগামীকাল বেলা ১২টায়। এর মধ্যে যদি তাদের মুক্তি না দেওয়া হয় তবে এর জন্য পাকিস্তান দূতাবাসই দায়ী থাকবে। এদিন হোসেন আলীর মুক্তির দাবিতে পাকিস্তান দূতাবাসের দায়িত্ব থেকে সদ্য পদত্যাগকারী ১০ জন বাঙালি কর্মচারী দূতাবাসের সামনে বিক্ষোভ করেন। এসময় হোসেন আলীর দুই শিশুপুত্রও বাবার মুক্তির দাবি জানায়।

৩ নভেম্বর মুজিবনগর থেকে প্রবাসী বাংলাদেশ সরকারের এক মুখপাত্র সাংবাদিকদের বলেন, 'দিল্লিতে পাকিস্তান দূতাবাসে বাঙালি দূতাবাস কর্মীদের উপর যে বর্বরতা ও পৈশাচিকতা চালানো হয়েছে আমরা এর তীব্র নিন্দা জানাই। এটি পাকিস্তান সরকার কর্তৃক বাংলাদেশে চালানো নির্যাতনের একটি নমুনা। এমন বর্বরতা সভ্য সমাজের রীতি নীতির পরিপন্থী। পাকিস্তানের এহেন আচরণে সভ্য সমাজ আজ স্তম্ভিত।'

ঢাকায় এদিন

৩ নভেম্বর ভোরে ২ নম্বর সেক্টরের গেরিলারা নারায়ণগঞ্জের সিদ্ধিরগঞ্জ পাওয়ার স্টেশনে ৩টি বিস্ফোরক দিয়ে পাওয়ার স্টেশনের ৪টি জেনারেটর ধ্বংস করে। এই অপারেশনের অন্যতম পরিকল্পনাকারী ছিলেন গেরিলা প্রকৌশলী নজরুল ইসলাম।

এদিন, নয়াপল্টনের জোনাকী সিনেমা হলের পূর্ব পাশের পলওয়েল মার্কেটের মুসলিম কমার্শিয়াল ব্যাংকে গেরিলারা অপারেশন চালায়। দুর্ধর্ষ অপারেশনে অংশ নেন গেরিলা রাইসুল ইসলাম আসাদ, এ টি এম মুনির উদ্দিন, আরিফুল মওলা, ফেরদৌস নাজমী, ফিরোজ, নজিবুল্লাহ জন সহ বেশ কয়েকজন মুক্তিযোদ্ধা। 

ভারতে এদিন

৩ নভেম্বর সন্ধ্যায় নদীয়া সীমান্তে পাকিস্তানি হানাদার বাহিনীর সঙ্গে ভারতীয় সীমান্তরক্ষী বাহিনী বিএসএফের গোলাগুলি হয়। এসময় প্রায় ২৫ জন হানাদার সেনা নিহত হয়।

৩ নভেম্বর দিল্লিতে ভারতের প্রতিরক্ষা মন্ত্রণালয়ের এক মুখপাত্র বলেন, ভারতীয় সেনাবাহিনীকে সীমান্ত অতিক্রম না করার জন্য কড়া নির্দেশ দিয়েছে প্রতিরক্ষা মন্ত্রণালয়। ত্রিপুরার কামালপুরে পাকিস্তানের গোলাবর্ষণ বন্ধ করার জন্য ভারতীয় সেনাবাহিনী সীমান্ত অতিক্রম করতে পারে বলে সংবাদপত্রে যে খবর বেরিয়েছে তা সম্পূর্ণ বানোয়াট। আমি বলেছি, 'পাকিস্তানি সামরিক বাহিনী ত্রিপুরার সীমান্তবর্তী শহরগুলোতে বিনা উসকানিতে যে গোলাবর্ষণ করছে আমরা তার সক্রিয় প্রতিশোধ নেবো। তার মানে এই কথার অর্থ এই নয় যে আমাদের সেনাবাহিনী সীমান্ত অতিক্রম করে তাদের উপর হামলা করবে।'

পাকিস্তানে এদিন

৩ নভেম্বর রাওয়ালপিন্ডিতে পাকিস্তানের প্রেসিডেন্ট ইয়াহিয়া খানের সঙ্গে আড়াই ঘণ্টা ব্যাপী সাক্ষাৎ করেন পাকিস্তান পিপলস পার্টির চেয়ারম্যান জুলফিকার আলী ভুট্টো। এর আগে ১০ দিনব্যাপী বিদেশ সফর শেষে ভুট্টো আজই পাকিস্তানে ফিরেছেন। প্রেসিডেন্ট ইয়াহিয়া খানের সঙ্গে বৈঠক শেষে ভুট্টো সাংবাদিকদের বলেন, 'প্রেসিডেন্টের সঙ্গে পূর্ব পাকিস্তানের পরিস্থিতি, উপনির্বাচন, বৈদেশিক রাষ্ট্রসমূহের মনোভাব নিয়ে আলোচনা হয়েছে। প্রেসিডেন্ট একই সঙ্গে দেশের নানা ঘটনা প্রবাহ নিয়েও আলোচনা করেছেন।'

আন্তর্জাতিক মহলে এদিন

৩ নভেম্বর ভারতের প্রধানমন্ত্রী ইন্দিরা গান্ধী লন্ডন থেকে নিউইয়র্কে এসে পৌঁছান। বিমানবন্দরে তাকে বরণ করেন ওয়াশিংটনে নিযুক্ত ভারতের রাষ্ট্রদূত লক্ষ্মী কান্ত ঝা ও জাতিসংঘে নিযুক্ত ভারতের স্থায়ী প্রতিনিধি সমর সেন। পরদিন ওয়াশিংটনে মার্কিন প্রেসিডেন্ট রিচার্ড নিক্সনের সঙ্গে ইন্দিরা গান্ধীর বৈঠক অনুষ্ঠিত হবে।

৩ নভেম্বর চীনা কমিউনিস্ট পার্টি এক বিবৃতিতে পাকিস্তানের বিরুদ্ধে বাংলাদেশের মুক্তিযোদ্ধাদের সামরিক তৎপরতা চালানোর কাজে সাহায্য না করা এবং পাকিস্তানের সাথে সব বিবাদ সরাসরি আলোচনার মাধ্যমে মিটিয়ে ফেলার জন্য গণচীন ভারতের প্রতি হুঁশিয়ারি জানায়।

দেশব্যাপী প্রতিরোধ যুদ্ধ 

৩ নভেম্বর দিবাগত রাতে যশোরের চৌগাছায় লেফটেন্যান্ট অনিক গুপ্তের নেতৃত্বে গণ বাহিনী ও ইপিআরের ৪২ জন মুক্তিযোদ্ধা পাকিস্তানি হানাদার বাহিনীর চৌগাছা বিওপি আক্রমণের লক্ষ্যে অ্যামবুশ করে। পরে সকাল নয়টার দিকে হানাদার বাহিনীর একটি পেট্রোল পার্টিকে আসতে দেখেই আক্রমণ গড়ে তোলে। এসময় পেট্রোল পার্টিকে সাহায্যের জন্য বিওপি থেকে হানাদারদের একটি দল গেরিলাদের চতুর্দিক ঘিরে ফেললে গেরিলা দলটি তীব্র প্রতিরোধ গড়ে তোলে। এই সময় দুই পক্ষের মধ্যে ব্যাপক সংঘর্ষ হয়। এসময় ক্যাপ্টেন নজমুল হুদার নেতৃত্বে আরেকটি দল চৌগাছা বিওপির সামনে এসে আগের দলটির সঙ্গে যোগ দেয়। অন্যদিকে ভারতীয় সৈন্যরা দূর থেকে ৩ ইঞ্চি মর্টার দিয়ে মুক্তিবাহিনীকে সাহায্য করলে মুক্তিবাহিনীর দুর্ধর্ষ আক্রমণে হানাদারেরা বিওপি ছেড়ে পালিয়ে যায়। এ যুদ্ধে হানাদার বাহিনীর ৪০ সৈন্য নিহত হয়। এবং ইপিআরের একজন ল্যান্স নায়েক আহত হন।

৩ নভেম্বর ২ নম্বর সেক্টরে মুক্তিবাহিনীর একটি গেরিলা দল রাঙ্গামাটি রোডে একটি সেতু ধ্বংসের চেষ্টা করে। এসময় হঠাৎ সেখানে একটি পাকিস্তানি মিলিশিয়া ও রাজাকারদের পেট্রোল পার্টি এসে পড়ে। মুক্তিবাহিনীর দলটি কিছু বোঝার আগেই গেরিলা পরিমল সরকারকে ধরে পাকিস্তানি ক্যাম্পে নিয়ে যায় রাজাকার ও মিলিশিয়াদের দলটি। এক পর্যায়ে মুক্তিবাহিনীর দলটি নিজেদের ক্যাম্পে ফিরে গিয়ে আরো অধিক সংগঠিত হয়ে হানাদারদের ক্যাম্পে দুর্ধর্ষ আক্রমণ গড়ে তোলে। এসময় গেরিলাদের হামলার মুখে হানাদার বাহিনীও প্রতিরোধ যুদ্ধ গড়ে তুললে দুই পক্ষের মধ্যে ব্যাপক সংঘর্ষ হয়। সংঘর্ষে হানাদার বাহিনীর ৪ সৈন্য নিহত হয়। অন্যদিকে একজন গেরিলা আহত হন।

৩ নভেম্বর চট্টগ্রাম বন্দরে মুক্তিবাহিনীর নৌকমান্ডোদের পাতা মাইন বিস্ফোরণে একটি পাকিস্তানি তেলবাহী জাহাজ ডুবে যায়। এসময় বিস্ফোরণে জাহাজে থাকা ৮ নাবিক নিহত হয়।

সূত্র-

বাংলাদেশের স্বাধীনতা যুদ্ধ: দলিলপত্র পঞ্চম, সপ্তম একাদশ ও দ্বাদশ খণ্ড। 

দৈনিক পাকিস্তান ৪ ও ৫ নভেম্বর ১৯৭১ 

দৈনিক অমৃতবাজার পত্রিকা, ৪ নভেম্বর ১৯৭১

কলকাতার দৈনিক যুগান্তর ৪ ও ৫ নভেম্বর

[email protected]

Comments

The Daily Star  | English

Netanyahu says Israel close to meeting its goals in Iran

JD Vance says US at war with Iran's nuclear programme, not Iran

17h ago