আলী যাকেরের শূন্যতা কখনও পূরণ হবে না

একুশে পদকপ্রাপ্ত প্রখ্যাত অভিনেতা আলী যাকের। মঞ্চ ও টেলিভিশন নাটককে সমৃদ্ধ করে গেছেন। বিশেষ করে মঞ্চ নাটকে তার অবদান অনেক। দেওয়ান গাজী, নুরুলদীন, গ্যালিলিও চরিত্রে অভিনয়ের জন্য যুগ যুগ ধরে দর্শক হৃদয়ে বেঁচে থাকবেন তিনি।
আলী যাকের। ছবি: শাহরিয়ার কবির হিমেল/স্টার

একুশে পদকপ্রাপ্ত প্রখ্যাত অভিনেতা আলী যাকের। মঞ্চ ও টেলিভিশন নাটককে সমৃদ্ধ করে গেছেন। বিশেষ করে মঞ্চ নাটকে তার অবদান অনেক। দেওয়ান গাজী, নুরুলদীন, গ্যালিলিও চরিত্রে অভিনয়ের জন্য যুগ যুগ ধরে দর্শক হৃদয়ে বেঁচে থাকবেন তিনি।

তার নিবেদিত আলোচিত মঞ্চ নাটকগুলো হচ্ছে- নুরুলদীনের সারাজীবন, গ্যালিলিও, অচলায়তন, বাকি ইতিহাস, বিদগ্ধ রমণীকুল, সৎ মানুষের খোঁজে, কাঁঠালবাগান, তৈল সংকট, এই নিষিদ্ধ পল্লীতে ‍ও কোপেনিকের ক্যাপ্টেন।

টেলিভিশনে অসংখ্য নাটকে অভিনয় করেছেন। বহুব্রীহি, আজ রবিবার, তথাপি, দেয়াল, পাথর ও অচিন বৃক্ষ নাটকগুলো তার স্মরণীয় কাজ।

লালসালু, নদীর নাম মধুমতী, রাবেয়া ও আগামী তার অভিনীত উল্লেখযোগ্য কয়েকটি সিনেমা।

তিনি একজন শব্দ সংগ্রামীও।

সফল সাংস্কৃতিক ব্যক্তিত্ব আলী যাকেরের জন্মদিন ৬ নভেম্বর। প্রথমবার এই দিনটি উদযাপনে তিনি নেই।

আলী যাকেরকে নিয়ে দ্য ডেইলি স্টারের কাছে স্মৃতিচারণ করেছেন তার দীর্ঘদিনের সহকর্মী আসাদুজ্জামান নূর, স্ত্রী সারা যাকের ও ছেলে ইরেশ যাকের।

গ্যালিলিও নাটকে আলী যাকের ও আসাদুজ্জামান নূর। ছবি: সংগৃহীত

আলী যাকেরের হাত ধরে আমার মঞ্চে প্রবেশ: আসাদুজ্জামান নূর

কখনও অভিনয় করা হত কিনা, অভিনয়শিল্পী হতে পারতাম কিনা, জানি না। আলী যাকেরের সঙ্গে পরিচয় হওয়ার পর একদিন আমাকে দলে যোগ দিতে বলেন। তার কারণেই নাটকের দলে যোগ দেওয়া। সত্যি কথা বলতে, আলী যাকেরের হাত ধরেই আমার মঞ্চে প্রবেশ।

মূলত অভিনেতা হতে পেরেছি, অভিনয় শিল্পটাকে ভালোবাসতে পেরেছি আলী যাকেরের জন্য। এই কথা কখনোই ভুলব না। একইভাবে ব্যবসায় জড়ানো তার জন্যই। নানাভাবে তার কাছে আমি ঋণী।

৫০ বছরের সম্পর্ক আমাদের। সেই মধুর সম্পর্ক ছিন্ন করে আলী যাকের আকাশের ঠিকানায় পাড়ি জমিয়েছেন। আলী যাকের নেই এটা ভাবতেই বিষণ্ণতায় মন ভরে উঠে।

আলী যাকেরের শূন্যতা কখনও পূরণ হবে না।

স্বৈরাচারবিরোধী আন্দোলনে একসঙ্গে মিছিল করার স্মৃতি আজও চোখে ভাসে। যেকোনো সাম্প্রদায়িকতাবিরোধী মিছিলেও দুজন অগ্রভাগে থেকেছি।

আন্দোলন-সংগ্রামে, সুখে-দুঃখে অর্ধ-শতাব্দীকাল একসঙ্গে কাটানোর স্মৃতি ভুলে থাকা বড়ই কঠিন। সেসব স্মৃতি নিয়েই থাকতে চাই। বাকি পথটাও এসব স্মৃতি ধরে রেখে চলতে চাই।

কখনও ভাবিনি তাকে নিয়ে এভাবে বলতে হবে। বেঁচে থাকলে তাকে নিয়ে কথা বলতে আনন্দ পেতাম। তার অবর্তমানে বলাটা কষ্টের। বড়ই বেদনার।

দেখতে দেখতে আলী যাকেরের জন্মদিন চলে এলো। প্রথমবার জন্মদিনে নেই আলী যাকের। চিরদিন হাসি-খুশি থেকেছেন। কাজ নিয়ে থেকেছেন। সফলতায় ভরা জীবন।

জীবনকে সুন্দর করে সাজিয়েছিলেন। এটাই বা কয়জন পারে?

টেলিভিশনে অনেক কাজ করেছি দুজনে। মঞ্চেও অনেক কাজ করেছি। মঞ্চের আলী যাকেরকে বড্ড মিস করি। যেখানে আছেন, ভালো থাকুন। দূর থেকেই জন্মদিনের ভালোবাসা।

স্ত্রী ও ছেলে-মেয়ের সঙ্গে আলী যাকের। ছবি: সংগৃহীত

ওর তোলা ছবি নিয়ে প্রদর্শনী করব: সারা যাকের

আলী যাকেরের মঞ্চের কাজগুলোর কথা প্রথমে বলি। মঞ্চে বড় বড় চরিত্র করেছিলেন তিনি। যা কিনা চ্যালেঞ্জিংও ছিল। গ্যালিলিও চরিত্রটি করেছিলেন। দুর্দান্ত অভিনয় করে মুগ্ধ করেছিলেন সবাইকে। নুরুলদিন করেছিলেন। ম্যাকবেথ করেছিলেন। একটা সময় নিয়মিত মঞ্চে অভিনয় করতেন। পুরো জীবন কাজ করে গেছেন। মঞ্চকে প্রমোট করার জন্য যা যা দরকার ছিল করে গেছেন। মঞ্চ নাটককে অনন্য এক উচ্চতায় নিয়ে যেতে পেরেছিলেন।

কখনও হতাশ হতে দেখিনি। সারাজীবন আশাবাদী মানুষ ছিলেন। স্বপ্ন দেখা ও তা বাস্তবায়নের জন্য কাজ করে গেছেন।

কেউ তো সারাজীবন থাকে না। মৃত্যু এসে একসময় নিয়েই যাবে সবাইকে। তবে চলে যাবেন, এমন কথা বলতে দিতেন না। পছন্দও করতেন না এমন কথা। শেষ কাজ বলে কিছু ছিল না আলী যাকেরের কাছে। কাজটাই ছিল ওর কাছে সব।

ওর যাপিতজীবন যেমন ছিল, তেমনি মানুষকে দিয়েও গেছেন। জীবনকে অর্থবহ করে গেছেন। মৃত্যু নিয়ে কখনও চিন্তা করতেন না। ভয় ছিল না। কাজে ডুবে থাকতেন। শতভাগ ইতিবাচক মানুষ বলতে যা বোঝায় তাই ছিলেন।

অসম্ভব প্রকৃতি প্রেমিক ছিলেন। প্রকৃতি দেখলেই ছবি তুলতেন। ছবি তোলা ছিল অন্যতম শখ। ভালোবাসতেন প্রকৃতির ছবি তুলতে। ছবি বিষয়ে বললে- হাসতেন। ওর তোলা ছবি নিয়ে প্রদর্শনী করব।

আলী যাকের লেখালেখিও করতেন। যা ভালো লাগত লিখতেন। ছবি তোলা ও লেখালেখিটা শখের বশেই করতেন।

রবীন্দ্রনাথের গান খুব পছন্দ করতেন। রবীন্দ্রনাথের যেকোনো সৃষ্টি তকে টানত খুব। রবীন্দ্রনাথের একটি গান ভীষণ প্রিয় ছিল- আকাশ ভরা সূর্য তারা বিশ্বভরা প্রাণ।

ভীষণ রকমের উদার মানুষ ছিলেন। মানুষে মানুষে ভেদাভেদ দেখতেন না। মানুষ পরিচয়টাকেই বড় করে দেখতেন।

ওর স্মৃতিগুলো ধরে রাখার জন্য যা যা দরকার করব।

বাবার আদর্শ নিজের ভেতর লালন করি: ইরেশ যাকের

ছেলে হিসেবে বাবাকে সবসময় মিস করি। সবসময় মনে করি। সবসময় উপলব্ধি করি। বাবার আদর্শ নিজের ভেতর লালন করি।

বাবার সবচেয়ে বড় দিক হচ্ছে, নীতির ক্ষেত্রে কখনও আপস করতেন না। নীতি-নৈতিকতায় খুব আপোষহীন ছিলেন। এভাবেই তিনি একজন আলী যাকের হয়ে উঠেছিলেন।

আমি বড় হয়েছি বাবার আদর্শের এই শক্তির কাছে। বাবার চিন্তা-ভাবনা ও চেতনার মধ্যে দিয়ে বেঁচে থাকতে চাই। আমার শক্তির জায়গা বাবার নীতির ওই জায়গাটা।

একজন আলী যাকের হতে পেরেছিলেন এ কারণেই। তার জায়গায় তিনি অসাধারণ।

বাবা চাইতেন আমি অভিনয় করি। তবে, বাবা চাইতেন মঞ্চে ও সিনেমায় বেশি অভিনয় করি। টেলিভিশন নাটকের ব্যাপারে বলতেন, এত নাটক হচ্ছে, কোয়ালিটি ধরে রাখতে পারবে কি? বাবার কথা মনে থাকবে সবসময়।

বাবার সঙ্গে কাজ করেছি। প্রায় ১০টি নাটক হবে। বাবার সঙ্গে অভিনয়টা দারুণ হত আমার। বন্ডিংটা হত খুব। বাবা সবসময় মনে করতেন সহশিল্পী যদি পারফেক্ট অভিনয় করতে পারেন, তাহলে দৃশ্যটি সুন্দর হবে। সেভাবেই তিনি সহশিল্পী হিসেবে আমার সঙ্গে সংলাপ বলতেন। ইমোশনকে ধরার জন্য যেভাবে কাজ করা দরকার সেভাবেই করতেন। খুব কেয়ারফুল থাকতেন।

বাবার অভিনয় সবসময়ই প্রিয়। তবে বহুব্রীহি সবচেয়ে প্রিয়।

বাবার জন্মদিন, কিন্তু কাছ থেকে শুভ জন্মদিন আর কখনও বলা হবে না। এটা কষ্টের।

Comments

The Daily Star  | English

Love road at Mirpur: A youthful street

Certain neighbourhoods in Dhaka have that one spot where people gather to just sit back and relax. For Mirpur, it’s the frequently discussed street referred to as “Love Road”.

2h ago