দুঃসাহসিক সালদা নদীর যুদ্ধ

মুক্তিযুদ্ধের ইতিহাসে অন্যতম শ্রেষ্ঠ যুদ্ধ সালদা নদীর যুদ্ধ। সালদা নদী সাব সেক্টর সামরিক দিক থেকেও ছিল ভীষণ গুরুত্বপূর্ণ। একদিকে যেমন ঢাকা-চট্টগ্রাম রেললাইন পড়েছে এখানে অন্যদিকে সীমান্তবর্তী এই অঞ্চলে মুক্তিবাহিনী চেয়েছিল সালদা নদী অঞ্চল দখল করে মুক্তাঞ্চলে নিজেদের কর্তৃত্ব প্রতিষ্ঠা করতে। এই অঞ্চলে নিজেদের নিয়ন্ত্রণ করতে হলে সর্বপ্রথম রেললাইনসহ গোটা এলাকা দখল করতে হবে। কারণ তাতে করে বন্ধ হয়ে যাবে ঢাকা-চট্টগ্রামের মধ্যে রেল যোগাযোগ। এটি ছিল পাকিস্তানি বাহিনীর জন্য লাইফ লাইন। আগস্টের শেষ সপ্তাহে যখন এই রেল লাইন মুক্তিবাহিনীর দখলে এলো তারপর বিজয়ের আগ পর্যন্ত তা একবার ছাড়া আর হাতছাড়া হয়নি মুক্তিযোদ্ধাদের। হাতছাড়া হওয়ার কয়েকদিনের মধ্যে মুক্তিবাহিনী রেললাইনের পুনরায় দখল নিয়েছিল। যার ফলে পাকিস্তানিদের যাতায়াত করতে হতো সড়ক পথে।
অবস্থান
এই সাব সেক্টরটি গঠিত হয়েছিল তৎকালীন কুমিল্লার সালদা নদী এলাকা, নয়নপুর, বুড়িচংসহ বেশ কিছু এলাকায়। মোট আয়তন ছিল ২০০ বর্গ কিলোমিটার। পাকিস্তানি বাহিনীর বিরুদ্ধে এই অঞ্চলে যুদ্ধ করেছিলেন ৪র্থ ইস্ট বেঙ্গল রেজিমেন্টের অধীনে মুক্তিযোদ্ধারা।
যেভাবে সালদা নদী যুদ্ধ
পাকিস্তানি বাহিনী সর্বপ্রথম সালদা নদী রেলওয়ে স্টেশন ও নয়নপুর বাজারে ৩০ পাঞ্জাব রেজিমেন্টের দুটি কোম্পানি নিয়োজিত রেখেছিল। সর্বপ্রথম পাকিস্তানি বাহিনীর সঙ্গে এই অঞ্চলে যুদ্ধ হয় মুক্তিযুদ্ধের জুলাই মাসে ২ নম্বর সেক্টরের সেক্টর কমান্ডার মেজর খালেদ মোশাররফের নির্দেশে। আর সর্বশেষ অপারেশন হয় ১৫ নভেম্বর।
সালদা নদী এলাকায় মুক্তিবাহিনীর সঙ্গে পাকিস্তানি বাহিনীর বেশ কয়েকটি যুদ্ধ হয়েছিল। সালদা নদী স্টেশন হাতছাড়া হওয়ার পরে মুক্তিবাহিনীর প্রথম লক্ষ্যই ছিল সালদা নদী রেল স্টেশন পুনরায় দখল করা। আর এজন্য এই স্টেশন মুক্তিবাহিনীর প্রথম লক্ষ্যবস্তুতে পরিণত হয়। অন্যদিকে সালদা নদী স্টেশন দখলে রাখতে প্রয়োজন ছিল সালদা নদী বাজার দখলে রাখা। পাকিস্তানি বাহিনী বুঝতে পেরে ৩০ পাঞ্জাব রেজিমেন্টের একটি কোম্পানি রেখেছিল সালদা নদী রেলওয়ে স্টেশনে, অন্যটি সালদা নদী বাজারে। সালদা নদী বাজারে রাখার কারণ হলো এই অঞ্চল তথা কসবা থেকে কুমিল্লা যাওয়ার জন্য সালদা নদী হয়েই যেতে হতো। মুক্তিবাহিনীর লক্ষ্য ছিল একাধারে এই পথ, ঢাকা-চট্টগ্রাম রেলপথ এবং সালদা নদীর নদীপথে পাকিস্তানি বাহিনীর বিচরণ সম্পূর্ণভাবে বন্ধ করে দেওয়া। আর এজন্য চতুর্থ ইস্ট বেঙ্গলের অধিনায়ক ক্যাপ্টেন এম এ গাফফারের নির্দেশনায় মন্দভাগ বাজার মন্দভাগ রেলওয়ে স্টেশনসহ বড় একটি অঞ্চলে একটি মুক্তাঞ্চল গড়ার পরিকল্পনা হয়। আর তা বাস্তবায়নের জন্য প্রয়োজন সালদা নদী রেলওয়ে স্টেশন, সালদা নদী বাজার, নয়নপুর ও চানলাকে মুক্ত করা।
সেপ্টেম্বর মাসের শুরুতেই ২ নম্বর সেক্টরের সেক্টর কমান্ডার মেজর খালেদ মোশাররফ পরিকল্পনা করলেন সালদা নদী রেলওয়ে স্টেশন এবং সালদা নদী বাজার পুরোপুরি দখলে নিতে। আর এজন্য তিনি তিনটি পদাতিক কোম্পানি দিয়ে মুজিব ব্যাটারির ফায়ার সাপোর্ট নিয়ে একটি বড়সড় আক্রমণ পরিচালনার। কিন্তু ২২ সেপ্টেম্বর সেক্টর কমান্ডার মেজর খালেদ মোশাররফ আহত হয়ে গেলে সেক্টরের দায়িত্ব নিয়েছিলেন মেজর এটিএম হায়দার। এটিএম হায়দারের নির্দেশে কোম্পানি কমান্ডারেরা আক্রমণের দিনক্ষণ ঠিক করলেন ৩০ সেপ্টেম্বর। এই অপারেশনের জন্য ক্যাপ্টেন আশরাফ, ক্যাপ্টেন এম এ গাফফার, মেজর সালেক এবং ক্যাপ্টেন আবদুল আজিজ পাশার কোম্পানি দিয়ে আক্রমণ সাজালেন। এর মধ্যে ক্যাপ্টেন আবদুল আজিজ পাশার অধীনে ছিল মুজিব ব্যাটারি।
ঠিক করা হলো ক্যাপ্টেন আশরাফের কোম্পানি মন্দভাগ রেলওয়ে স্টেশনের বাম দিক থেকে রেললাইন হয়ে এগুবে এরপর সালদানদী স্টেশনে আক্রমণ চলাবে এবং দখল করবে। ক্যাপ্টেন এম এ গাফফারের কোম্পানি মন্দভাগ বাজার ও রেলওয়ে স্টেশন দখলের পর এমনভাবে আঁকড়ে রাখবে যেন পাকিস্তানিরা পেছন দিক থেকে আক্রমণ গড়ে তুলতে না পারে। মেজর সালেকের কোম্পানি সালদা নদী বাজারের পাকিস্তানি বাহিনীর ক্যাম্প আক্রমণ করে দখল করবে। আর ক্যাপ্টেন আবদুল আজিজ পাশার নেতৃত্বে ফায়ার সাপোর্টে থাকবে মুজিব ব্যাটারি অন্যদিকে সুবেদার জব্বার নেতৃত্ব দেবেন তিন ইঞ্চি মর্টার প্লাটুনের
৩০ সেপ্টেম্বরের যুদ্ধ
৩০ সেপ্টেম্বর সকাল ৬টার দিকে তীব্র আক্রমণ গড়ে তোলে মুক্তিবাহিনী। প্রায় ১৫ ঘণ্টা ব্যাপী চলে এই যুদ্ধ। রাত ৯টায় শেষ হওয়া এই যুদ্ধে ক্যাপ্টেন আশরাফের কোম্পানি সালদা নদী রেলওয়ে স্টেশনের উত্তর পাড় পর্যন্ত দখল করেন। একদিকে মেজর সালেক সালদা নদীর উত্তর পাড় পর্যন্ত এসেছিলেন। কিন্তু পাকিস্তানি বাহিনীর তীব্র আক্রমণে মুক্তিবাহিনীর আক্রমণ থেমে যায়। এক পর্যায়ে পাকিস্তানি বাহিনীর তীব্র আক্রমণে টিকতে না পেরে মেজর সালেক পিছু হটেন। তবে এম এ গাফফারের নেতৃত্বে তার কোম্পানি মন্দভাগ বাজার ও মন্দভাগ রেলওয়ে স্টেশন দখলে রাখে। শেষ পর্যন্ত সেক্টর কমান্ডার এটিএম হায়দার বুঝতে পেরে আক্রমণকারী দলসমূহকে ছেড়ে আসার নির্দেশ দেন।
এরপর মেজর এম এ গাফফারকে সালদা নদী কমপ্লেক্স দখলের দায়িত্ব দেন এটিএম হায়দার। সালদা নদী কমপ্লেক্স দখল করতে না পেরে মুক্তিযোদ্ধাদের মধ্যে ব্যাপক প্রতিক্রিয়ার সৃষ্টি হয়েছিল। তারা কোনভাবেই এই পরাজয় মেনে নিতে পারেননি। যার ফলে তারা প্রতিটি মুহূর্তে ভাবতে থাকেন এই অপারেশন কীভাবে সফল করা যায়।
৮ অক্টোবরের যুদ্ধ
৮ অক্টোবরের যুদ্ধে পাকিস্তানি বাহিনীর একটি অবস্থান খাদ্য গুদাম দখল করে মুক্তিবাহিনী। ক্যাপ্টেন গাফফারের নেতৃত্বে সুবেদার মঙ্গল মিয়ার প্লাটুন, সুবেদার বেলায়েতের প্লাটুন এবং সুবেদার সিরাজের প্লাটুন ও নায়েব সুবেদার আক্রমণ চালায় সালদা নদী তীরবর্তী খাদ্য গুদামে। ভোর ৫টা থেকে রাত ১০টা পর্যন্ত চলা এই যুদ্ধে পুরো গুদাম দখল করে মুক্তিবাহিনী। এই ঘাঁটি দখলের পর ঘাঁটি থেকে বিপুল পরিমাণ অস্ত্র ও গোলাবারুদ দখলে নেয় মুক্তিবাহিনী। এই যুদ্ধে পাকিস্তানি বাহিনীর ২৭ সৈন্য নিহত হয়।
১৩ অক্টোবরের যুদ্ধ
১৩ অক্টোবর বিকেলে পাকিস্তানি আর্টিলারির সহযোগিতায় ৫ম পাঞ্জাব রেজিমেন্টের পাকিস্তানি সেনারা সালদা নদী রেলওয়ে স্টেশন এলাকায় ভয়াবহ হামলা চালায়। কিন্তু চতুর্থ ইস্ট বেঙ্গলের ডেল্টা কোম্পানি তাদের উপর প্রতি আক্রমণ করে আক্রমণ প্রতিহত করে। প্রায় এক ঘণ্টা প্রতিরোধ যুদ্ধের পর পাকিস্তানি হানাদার বাহিনীর উপর আক্রমণের তীব্রতা বাড়লে তারা পিছু হটে। এই যুদ্ধে প্রায় ৪৫ জন পাকিস্তানি সৈন্য নিহত হয়, অন্যদিকে ৪র্থ ইস্ট বেঙ্গলের দুই মুক্তিযোদ্ধা শহীদ হন এবং একজন আহত হন।
ক্যাপ্টেন এম এ গাফফারের নেতৃত্বে চতুর্থ ইস্ট বেঙ্গলের দুটি মর্টার প্লাটুন ও মুজিব ব্যাটারির সাপোর্টকে ঠিক রেখে নতুন করে পরিকল্পনা করা হয়। ক্যাপ্টেন এম এ গাফফার এরপর বিভিন্ন পেশাজীবীর বেশে রেকি করে পাকিস্তানি বাহিনীর অবস্থান জানানোর চেষ্টা করতে শুরু করলেন। একদিন পাকিস্তানি বাহিনী বাইনোকুলার দিয়ে পর্যবেক্ষণ অবস্থায় ক্যাপ্টেন গাফফারের উপস্থিতি টের পেয়ে গুলিবর্ষণ শুরু করে। কিন্তু রাত হয়ে যাওয়ায় সেদিন ভাগ্যক্রমে তিনি বেঁচে গিয়েছিলেন।
রেকি করা শেষে ক্যাপ্টেন গাফফার কিছু সিদ্ধান্তে উপনীত হলেন। তিনি দেখলেন পাকিস্তানিদের ঘাঁটিগুলো শক্তিশালী কাঠামোতে তৈরি তাই সাধারণ পদ্ধতিতে ধ্বংস করার সক্ষমতা মুক্তিবাহিনীর নেই। আর তাই অতর্কিত হামলা চালাতে হবে তাদের উপর। কমপ্লেক্সের ঘাঁটি চারটি কংক্রিটের বাঙ্কারে ঘেরা। আর সালদা নদী বাজার ও রেলওয়ে স্টেশনের মধ্যে ১ হাজার গজ ব্যবধান। তারা এই ৪টি বাঙ্কার থেকেই পুরো এলাকা কভার করেছিল। মাঝের এক হাজার গজ পাকিস্তানিদের বড় একটি দুর্বলতা এবং পাকিস্তানিরা সারারাত তৎপর থাকলেও সকালে খেয়ে বিশ্রামে যায়। যার ফলে তখন প্রতিরক্ষা নড়বড়ে থাকে। কারণ তখন পাহারায় থাকে স্বল্প প্রশিক্ষিত সিভিল আর্মড ফোর্সের সদস্যরা। আর তাদের কাছে থাকে সাধারণ থ্রি নট থ্রি রাইফেল। এছাড়াও শত্রুর অবস্থান রেকিতে বুঝতে পেরে ক্যাপ্টেন গাফফার বুঝলেন সালদা নদী কমপ্লেক্সে পাকিস্তানিদের দুই পদাতিক কোম্পানি সেনা এবং সালদা নদী বাজার ও রেলস্টেশনে দুটি ইপিসিএএফ প্লাটুন অবস্থান নিয়েছে। অন্য দিকে পাকিস্তানের আরো দুটি কোম্পানি আছে নয়নপুর বাজার, চানলা ও বড় দুশিয়ায়।
কিন্তু পাকিস্তানিদের দুটি কোম্পানিকে প্রথাগত পদ্ধতিতে আক্রমণ করতে হলে তিন গুণ শক্তি দরকার অর্থাৎ ৬ কোম্পানি মুক্তিযোদ্ধা। আর তাই গ্রহণ করা হলো অপ্রচলিত পদ্ধতি। তখন ক্যাপ্টেন এম এ গাফফার নতুন করে পরিকল্পনা সাজালেন।প্রথমত চতুর্থ ইস্ট বেঙ্গলের একটি কোম্পানিকে দিয়ে পরিচালনা করা হবে। একটি কোম্পানি রাখা হবে রিজার্ভে। সিদ্ধান্ত নেওয়া হলো মূল আক্রমণটি হবে ত্রিমুখী সাঁড়াশি আক্রমণ। একপাশে সুবেদার মোহাম্মদ হোসেনের নেতৃত্বে একটি ১০৬ মি.মি ও একটি ৭৫ মিমি রিকোয়েললেস রাইফেল ডিটাচমেন্ত রাতের আঁধারেই নদীর এপারে অবস্থান নিয়ে পরদিন ভোরেই গোলা ছুঁড়ে ৪টি বাঙ্কার ধ্বংস করবে। সুবেদার বেলায়েতের নেতৃত্বে একটি পদাতিক প্লাটুন সালদা নদী অতিক্রমণ করে চারটি বাঙ্কার দখলে করেই দুইপাশ বিচ্ছিন্ন করে দিয়ে। সুবেদার সিরাজের নেতৃত্বে একটি পদাতিক প্লাটুন সালদানদী রেলস্টেশনের পূর্ব পাশের পাহাড়ে অবস্থান নিয়ে রেললাইন ধরে এগিয়ে রেলস্টেশন দখল নিবে। আরেকপাশে সুবেদার মঙ্গল মিয়ার নেতৃত্বে একটি পদাতিক প্লাটুন নদী অতিরকম করে সালদা নদীর গোডাউন এবং বাজার দখল করবে। অন্যদিকে সুবেদার আবদুল ওহাবের নেতৃত্বে চতুর্থ ইস্ট বেঙ্গলের এক পদাতিক কোম্পানি রিজার্ভ ফোর্স হিসেবে আক্রমণের আগে ৭ অক্টোবর রাতে পাঁচটি রেইড দল গঠন করে বড় দুশিয়া, চানলা, সাহেববাড়ি, গোবিন্দপুর ও কাইয়ুমপুরে পাকিস্তানি বাহিনীর অবস্থানগুলোতে আক্রমণ চালিয়ে তাদের বিভ্রান্ত করে দেবে। যাতে তারা ভুলভাবে বুঝতে পারে আসলে আক্রমণ কোথায় হচ্ছে। এর ফলে তারা বিভ্রান্ত হবে। অন্যদিকে সারারাত এমন ব্যস্ত রাখতে হবে যেন সকালে তারা রাজাকারদের হাতে পাহারার দায়িত্ব দিয়ে বিশ্রামে যায়।
ক্যাপ্টেন গাফফার সিদ্ধান্ত নেন সালদা নদী এলাকায় আক্রমণের সময় এমনভাবে অবস্থান নিতে হবে যাতে বড়দুশিয়া, চানলা, সাহেববাড়ি, গোবিন্দপুর কিংবা কাইয়ুমপুর থেকে পাকিস্তানি বাহিনীর কোনো সেনা সালদা নদী এলাকায় ঢুকতে না পারে। ক্যাপ্টেন গাফফার এই আক্রমণের জন্য মুজিব ব্যাটারি বা ভারতীয় আর্টিলারির সহযোগিতা নেননি। কেবল তিনি বাড়তি হিসেবে মর্টার প্লাটুন এবং হেভি মেশিনগান ডিটাচমেন্ট নিযুক্ত করেছিলেন। সিদ্ধান্ত হয় সুবেদার জব্বারের নেতৃত্বে মর্টার প্লাটুন সালদা নদী রেল স্টেশন থেকে একটু দূরে মুক্তাঞ্চলে ফায়ার বেস স্থাপন করবে। পরে এগুলো ফায়ার বেসে নিয়ে যাওয়া হলো।
১৫ নভেম্বর, সালদা নদীর সর্বশেষ যুদ্ধ
১৫ নভেম্বর দিবাগত রাতে ক্যাপ্টেন গাফফারের নির্দেশে লেফটেন্যান্ট জামিল উদ্দিন আহসানের নেতৃত্বে সি কোম্পানির ৩টি প্লাটুন একযোগে পাকিস্তানি অবস্থানে ইনফিলট্রেশন করে পিছ থেকে ত্রিমুখী আক্রমণ করে তাদের জানমালের ক্ষতি সাধন করে নিজ অবস্থানে ফিরে আসবে বলে ঠিক হয়। এসময় তিনি ক্যাপ্টেন গাফফারের সঙ্গে পরিকল্পনা নিয়ে আলোচনা করে চূড়ান্ত অনুমোদন নেন। ফিরে এসে প্লাটুন কমান্ডারদের সঙ্গে আলোচনা করে নির্দেশনা দিলেন। ঠিক হলো মুজিব ব্যাটারি, ব্যাটালিয়ন মর্টার ও আরআর প্লাটুন পরিকল্পনা অনুযায়ী, অভিযান চলাকালে ফায়ার সাপোর্ট দেবে।
এদিন রাত ১২টার পর প্রায় ১০০ জন মুক্তিযোদ্ধাকে ৩টি প্লাটুনে সংগঠিত করেন সি কোম্পানির কমান্ডার লেফটেন্যান্ট জামিল আহসান। রাত ২টার দিকে একযোগে ৩টি প্লাটুন পাকিস্তানি বাহিনীর অবস্থানের দিকে অগ্রসর হয়। অন্যদিকে জামিল আহসান, সুবেদার ওয়াহাব, নায়েব সুবেদার মঙ্গল মিয়ার ৭ নম্বর প্লাটুনের সঙ্গে মধ্যরেখা বরাবর অগ্রসর হন। বামে নায়েব সুবেদার বেলায়েতের ৮ নম্বর প্লাটুন সালদা নদীর নিজস্ব পাড় বরাবর এবং ডানে নায়েব সুবেদার শহীদ ৯ নম্বর প্লাটুন নিয়ে সম্মুখে অগ্রসর হন। জামিল আহসান ৭ নম্বর প্লাটুনের সঙ্গে পাকিস্তানি সৈন্যদের অবস্থান থেকে প্রায় ২০০–৩০০ গজ দূরে নো ম্যানস ল্যান্ডে একটি বসতিহীন গ্রামের বাড়িঘর ও গাছপালার আড়ালে অবস্থান নিয়ে অন্য প্লাটুনের অগ্রগতি জানার অপেক্ষায় থাকেন। কিন্তু রাত প্রায় ৩টার দিকে হঠাৎ করে পাকিস্তানি সৈন্যদের অবস্থান থেকে প্রথমে ডান দিকে এবং ক্রমান্বয়ে সমগ্র অবস্থান থেকে ফায়ারিং শুরু হয়। ওয়্যারলেসে নায়েব সুবেদার শহীদ কোম্পানি কমান্ডার জামিল আহসানকে জানালেন তারা খোলা ধান খেতে লাইং পজিশন নিয়ে অবস্থান নিয়েছেন। কিন্তু তাদের অবস্থান জেনে ফেলেছে পাকিস্তানি বাহিনী। আর গুলিবর্ষণ শুরু করেছে। এসময় জামিল আহসানের নির্দেশনায় প্লাটুন কমান্ডার শহীদ নিরাপদ অবস্থানে চলে গেল।
এদিকে ওয়্যারলেসে নায়েব সুবেদার বেলায়েত বললেন, 'তিনি নদীতীরের কাছাকাছি নিরাপদ অবস্থানে আছেন এবং তীব্র সম্মুখযুদ্ধে লিপ্ত। কোম্পানি কমান্ডার বুঝতে পারলেন নায়েব সুবেদার শহীদ আর সামনে এগুতে পারবেন না। তখন ভোর হয়ে আসছে। মুক্তিযোদ্ধারা নিজেদের অবস্থান থেকে ফায়ার করে শত্রুকে পিন ডাউন করে রাখলেন। ইতোমধ্যে পাকিস্তানিদের আর্টিলারি মুক্তিযোদ্ধাদের অবস্থানের ওপর গোলাবর্ষণ শুরু করেছে। তবে বেশির ভাগই উপর দিয়ে পেছনে পড়তে লাগলো । এরপর এয়ার বাস্ট শুরু করলো মুক্তিযোদ্ধারা। তখন মুক্তিযোদ্ধাদের পক্ষে খোলা অবস্থানে থাকা দুষ্কর হয়ে পড়লো। এসময় ৯ নম্বর প্লাটুন নিজ অবস্থানের কাছাকাছি পৌঁছানোর পর ৭ নম্বর প্লাটুনকে উইথড্র করে নিজ অবস্থানে ফিরে যাওয়ার নির্দেশ দিলেন জামিল আহসান। তখনো পাকিস্তানি আর্টিলারির এয়ার বার্স্ট চলছিল। নায়েব সুবেদার বেলায়েতের ৮ নম্বর প্লাটুন ছাড়া আমরা সবাই নিরাপদে আমাদের অবস্থানে ফিরে এলাম। ইতিমধ্যে সকাল হয়ে গেছে।'
এদিকে নায়েব সুবেদার বেলায়েতের ৮ নম্বর প্লাটুন নদীতীর বরাবর নিরাপদ আড়াল থেকে নদীর অপর তীরে পাকিস্তানিদের বাঙ্কারে ফায়ার করছেন তখনো। হেড কোয়ার্টার থেকে তার সঙ্গে কথা হলো ব্যাটেলিয়ন কমান্ডারের। ব্যাটেলিয়ন কমান্ডার তাকে চলে আসতে বললেও তিনি যুদ্ধ চালিয়ে যাওয়ার জন্য অনুমতি প্রার্থনা করলেন। অনুমতি দেওয়া হলো। ইতিমধ্যে ৭ নম্বর প্লাটুন ফিরে আসায় চার্লি কোম্পানির কমান্ডার জামিল আহসান সুবেদার বেলায়েতের সঙ্গে যোগ দেন। তখন ব্যাটালিয়ন মর্টার আর মুজিব ব্যাটারি থেকে নয়নপুর বাজারের পাকিস্তানিদের অবস্থানের উপর গোলাবর্ষণ শুরু হয়েছে। এর মধ্যে ব্যাটালিয়ন হেডকোয়ার্টার থেকে ২টি ১০৬ ও ৭৫ মি.মি আরআর আমাদের অবস্থানে যোগ দেয়। আরআর দিয়ে নদীর অপর পাড়ের শত্রু পোস্টে গোলাবর্ষণ করতে থাকলেন মুক্তিযোদ্ধারা। একই সঙ্গে ৮ নম্বর প্লাটুন ও এমজি ফায়ার থেকে ফায়ার করে পাকিস্তানিদের এমজি ফায়ার নিষ্ক্রিয় করে ফেললো। এক পর্যায়ে পাকিস্তানিরা বিপর্যস্ত হয়ে গেল। পালাতে শুরু করলো। এমন সময় বা পাশে সাগরতলা অবস্থান থেকে লেফটেন্যান্ট মমতাজের নেতৃত্বে আলফা কোম্পানির একটি প্লাটুন এসে স্টেশনে পাকিস্তানিদের অবস্থান দখল করে দূরে পাকিস্তানিদের উপর ফায়ারিং শুরু করলো। ততক্ষণে দুপুর পেরিয়ে যাচ্ছে।
১৫ নভেম্বর রাতেই ক্যাপ্টেন গাফফারের নির্দেশে মুক্তিযোদ্ধারা দুর্ভেদ্য প্রতিরক্ষা ব্যবস্থা গড়ে তুললেন। অন্যদিকে ক্যাপ্টেন গাফফারের নির্দেশে নয়নপুর বাজার এবং সালদা নদী রেলওয়ে স্টেশনের মাঝামাঝি অংশে তার অধীনে থাকা ট্রুপস মোতায়েন করলেন। রাতের মধ্যে চার্লি কোম্পানির কমান্ডার জামিল উদ্দিন চৌধুরীর নেতৃত্বে কয়েকজন মুক্তিযোদ্ধা সালদা নদীর উপর দিয়ে বাঁশের সাঁকো তৈরি করে ফেললেন।
১৬ তারিখ ভোর থেকেই সবাই নিজ নিজ অবস্থান নিয়েছে। সকাল ১০টার দিকে নায়েব সুবেদার বেলায়েত কোম্পানি হেডকোয়ার্টারের সামনে ওয়্যারলেস অপারেটর সঙ্গে একজন রানার নয়নপুর বাজারের থেকে সামনে নদীর ধারে গেলেন পাকিস্তানি বাহিনীর অবস্থান রেকি করার জন্য। দূরে তখন পাকিস্তানিদের পজিশন। তারা বুঝতে পারে সুবেদার বেলায়েতের অবস্থান। তারা গুলিবর্ষণ করে এসময় সুবেদার বেলায়েতের মুখে এসে লাগলো উনি সাথে সাথে পড়ে যান। একটা ভাঙা তক্তায় তাকে শুইয়ে কোনাবনে নিয়ে যাওয়া হলো কিন্তু পথেই তিনি শহীদ হন।
সূত্র-
বাংলাদেশের স্বাধীনতা যুদ্ধ: দলিলপত্র দশম খণ্ড।
মুক্তিযুদ্ধের দু'শো রণাঙ্গন/ মেজর রফিকুল ইসলাম পিএসসি
কে ফোর্স এস ফোর্স জেড ফোর্স /মেজর রফিকুল ইসলাম পিএসসি
Comments