নগদ অর্থ সংকটে ব্যাংক, ৭৬ শতাংশ উদ্বৃত্ত তহবিল গুটিকয়েকের হাতে

বাংলাদেশের ব্যাংকিং খাতে অতিরিক্ত তারল্যের গল্প কার্যত এই খাতের সঠিক চিত্র দেখাচ্ছে না। কারণ অতিরিক্ত তহবিলের বেশিরভাগই গুটিকয়েক ব্যাংকের কাছে কেন্দ্রীভূত।

বাংলাদেশের ব্যাংকিং খাতে অতিরিক্ত তারল্যের গল্প কার্যত এই খাতের সঠিক চিত্র দেখাচ্ছে না। কারণ অতিরিক্ত তহবিলের বেশিরভাগই গুটিকয়েক ব্যাংকের কাছে কেন্দ্রীভূত।

গত অক্টোবরে ব্যাংকগুলোর মোট উদ্বৃত্ত তহবিল ছিল ২ লাখ ২০ হাজার ৮৮০ কোটি টাকা। এর আগের মাসের তুলনায় যা শূন্য দশমিক ৬ শতাংশ বেশি। অর্থ সংকটের এই পরিস্থিতিতে ব্যাংকিং খাতে অতিরিক্ত তারল্য বেড়ে যাওয়াটা কিছুটা বিস্ময়কর।

মোট উদ্বৃত্ত তহবিলের মধ্যে ১ লাখ ৬৮ হাজার ৫০৮ কোটি টাকা কেবল ১ ডজন ব্যাংকের হাতে কেন্দ্রীভূত। যা অতিরিক্ত তারল্যের ৭৬ শতাংশ। এসব ব্যাংকগুলোর কোনো কোনোটি ঋণ আকারে মূল ধারার অর্থনীতিতে অর্থ পাঠানোর পরিবর্তে সরকার ও কেন্দ্রীয় ব্যাংকের বিভিন্ন সিকিউরিটিজে বিনিয়োগ করছে।

এভাবে তহবিল কেন্দ্রীভূত হয়ে পড়ায় ব্যাংকিং খাতে তারল্যের চাপ তৈরি হয়েছে। কারণ করোনাভাইরাস মহামারির জন্য সৃষ্ট অচলাবস্থা শেষে পুনরায় অর্থনৈতিক কর্মকাণ্ড চালু হওয়ার পর ব্যাংকগুলি ঋণের চাহিদা মেটাতে হিমশিম খাচ্ছে।

ব্যাংক কর্মকর্তাদের ভাষ্য, এর পরেও কেন্দ্রীয় ব্যাংক 'স্ববিরোধী অবস্থান' নিয়েছে। কারণ একইসঙ্গে রেপো (পুনঃক্রয় চুক্তি) ও বাংলাদেশ ব্যাংক (বিবি) বিলের মাধ্যমে কেন্দ্রীয় ব্যাংক নিলাম আয়োজন করছে।

চলতি বছরের আগস্ট পর্যন্ত বিবি বিলের মাধ্যমে বিভিন্ন ব্যাংক থেকে টাকা তোলার এই নিলাম স্থগিত ছিল।

কিন্তু কেন্দ্রীয় ব্যাংক এই প্রক্রিয়া পুনরুজ্জীবিত করে ৯ আগস্ট থেকে অতিরিক্ত তারল্য বাজার থেকে তুলে নিচ্ছে।

সর্বশেষ গত ১৮ নভেম্বর অনুষ্ঠিত নিলামে কেন্দ্রীয় ব্যাংক ১৫০ কোটি টাকা তুলে নিয়েছে। বৃহস্পতিবার পর্যন্ত বিনিয়োগের আগের অংশ ম্যাচিউর হওয়ার পর বিবি বিলে ১০ হাজার ২২৬ কোটি টাকা বিনিয়োগ হিসেবে জমা আছে।

কিন্তু তারল্য পরিস্থিতি সম্প্রতি পাল্টে যাওয়ায় বিবি বিল নিলামের এই ধারাবাহিকতা নিয়ে প্রশ্ন উঠেছে।

কিছু ব্যাংকের নগদ টাকার সংকট মেটাতে কেন্দ্রীয় ব্যাংক দীর্ঘ বিরতির পর রেপো নিলামের মাধ্যমে আর্থিক খাতে তহবিল সরবরাহ করতে শুরু করেছে।

রেপো হলো এমন একটি ব্যবস্থা যার মাধ্যমে কেন্দ্রীয় ব্যাংক বাজারে টাকা সরবরাহ করে। বাংলাদেশে রেপোর সুদ হার ৪ দশমিক ৭৫ শতাংশ।

নাম প্রকাশ না করার শর্তে কেন্দ্রীয় ব্যাংকের এক কর্মকর্তা বলেন, 'এটা বাংলাদেশ ব্যাংকের স্ববিরোধী একটা অবস্থান। ব্যাংক থেকে নগদ টাকা তুলে নিয়ে এবং একইসঙ্গে তা বাজারে সরবরাহ করার বিষয়টি অযৌক্তিক।'

তারল্যের ঘাটতিতে থাকা ব্যাংকগুলো মরিয়া হয়ে আন্তব্যাংক কল মানি (ব্যাংকগুলোর নিজেদের মধ্যে টাকা ধার প্রক্রিয়া) মার্কেটে যেতে বাধ্য হচ্ছে। সুদ হার রাতারাতি ব্যাপকভাবে বেড়েছে।

১৮ নভেম্বর কল মানি সুদ হার ৪ দশমিক ৪৯ শতাংশে পৌঁছায়। এর আগে ৩১ অক্টোবর এই হার ছিল ২ দশমিক ২৫ শতাংশ।

মিউচুয়াল ট্রাস্ট ব্যাংকের ব্যবস্থাপনা পরিচালক সৈয়দ মাহবুবুর রহমানের বক্তব্য, কেন্দ্রীয় ব্যাংকের উচিত আপাতত বিবি বিল নিলাম স্থগিত রাখা। কারণ অনেক ব্যাংকের কাছে পর্যাপ্ত নগদ অর্থ নেই।

তিনি বলেন, 'কেন্দ্রীয় ব্যাংক যদি বিবি বিলের নিলাম অব্যাহত রাখে তাহলে কল মানি সুদ হার আরও বাড়বে।'

কেন্দ্রীয় ব্যাংকের ওই কর্মকর্তার ভাষ্য, যেসব ব্যাংক উদ্বৃত্ত তহবিল নিয়ে বসে আছে তারাই কল মানি মার্কেটের বিনিয়োগকারী। এই ১২টি ব্যাংক হলো- সোনালী, ইসলামী ব্যাংক, অগ্রণী, জনতা, স্ট্যান্ডার্ড চার্টার্ড, পূবালী, ডাচ বাংলা, রূপালী, সাউথ ইস্ট, ট্রাস্ট, ব্যাংক এশিয়া ও যমুনা ব্যাংক।

এর মধ্যে রাষ্ট্রায়ত্ত ৪টি ব্যাংকের উদ্বৃত্ত তহবিল আছে ৯৭ হাজার ১৩০ কোটি টাকা। যা ব্যাংক খাতের মোট উদ্বৃত্ত তহবিলের ৪৪ শতাংশ।

ব্যাংকগুলো এখন একইসঙ্গে কল মানি মার্কেট ও বিবি বিলে বিনিয়োগ করছে। কেন্দ্রীয় ব্যাংকের ওই কর্মকর্তা বলছেন, বিবি বিলের নিলাম বন্ধ হলে এর তহবিল কল মানি মার্কেটে যাবে। এতে চাপ কমবে।

অগ্রণী ব্যাংকের ব্যবস্থাপনা পরিচালক শামস-উল ইসলাম জানান, তারা নিয়মিতভাবে বিবি বিল ও কল মানি মার্কেটে বিনিয়োগ করছেন।

গত ৩১ অক্টোবর এই ব্যাংকের অতিরিক্ত তারল্য ২২ হাজার ৪৫৫ কোটি টাকায় পৌঁছায়।

শামস-উল ইসলাম অবশ্য বলছেন যে, ব্যাংকটি এখন তার উদ্বৃত্ত তহবিল কমাতে ক্ষুদ্র ও মাঝারি শিল্পকে ঋণ দিচ্ছে।

এনআরবি কমার্শিয়াল ব্যাংকের ব্যবস্থাপনা পরিচালক গোলাম আউলিয়া বিবি বিলের নিলাম বন্ধের আহ্বান জানিয়ে বলেন, 'তারল্য পরিস্থিতি এখন ব্যাংকগুলোর জন্য অনুকূল নয়। বিবি বিলের নিলাম বন্ধ হলে ব্যাংকগুলো তাদের উদ্বৃত্ত তহবিল কল মানি মার্কেটে বিনিয়োগ করতে পারবে।'

ব্যাংক এশিয়ার ব্যবস্থাপনা পরিচালক মো. আরফান আলী আশা করছেন যে, আগামীতে কল মানি মার্কেট স্থিতিশীলতায় পৌঁছাবে।

মিউচুয়াল ট্রাস্ট ব্যাংকের মাহবুবুর রহমান তারল্যের চাপ আরও ঘনীভূত হওয়ার কারণ হিসেবে আমদানি বাড়ার বিষয়টিকে ইঙ্গিত করেন। কারণ কিছু ব্যাংক তাদের গ্রাহকদের জন্য নিয়মিত মার্কিন ডলার কিনতে বাধ্য হচ্ছে।

ডলার কেনার কারণে টাকার সরবরাহে ঘাটতি পড়েছে। কেন্দ্রীয় ব্যাংক চলতি বছরে এ পর্যন্ত ১ দশমিক ৮২ বিলিয়ন মার্কিন ডলার বিক্রি করেছে।

মাহবুবুর রহমানের ধারণা, আমানতের সুদের হার দ্রুততম সময়ের মধ্যে বাড়বে। যা ঋণের সুদ হারের ওপর চাপ তৈরি করবে।

অনেক ব্যাংক এখন ৬ শতাংশ হারে স্থায়ী আমানত সংগ্রহ করছে। ৩ থেকে ৪ মাস আগে এই হার ছিল ২ থেকে ৩ শতাংশ।

অনুবাদ করেছেন মামুনুর রশীদ

Comments

The Daily Star  | English

Women MPs in reserved seats: How empowered are they really?

Fifty-two years ago, a provision was included in the constitution to reserve seats for women in parliament for a greater representation of women in the legislative body.

11h ago