বাংলাদেশে উচ্চশিক্ষার ভবিষ্যৎ

‘আমাদের বিশ্ববিদ্যালয় শিক্ষাজীবনের ভবিষ্যতে কী আছে জানি না, কিন্তু আমি এবং আমার সহপাঠীরা সেটার সঙ্গে মানিয়ে নিতে সমস্যায় পড়বো, কারণ আমরা ইতোমধ্যে অনলাইন ক্লাসের সঙ্গে নিজেদের অভ্যস্ত করে নিয়েছি। আমার মনে হয় না করোনাভাইরাস মহামারির আগে পরিস্থিতি যেমন ছিলো, তা পুরোপুরি ফিরে আসবে। এ কারণে, সামনে কী আছে তা নিয়ে আমি একই সঙ্গে রোমাঞ্চিত এবং উদ্বিগ্ন,’ বলছিলেন ঢাকার একটি বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ের তৃতীয় বর্ষের শিক্ষার্থী রিসানা ইসলাম।

'আমাদের বিশ্ববিদ্যালয় শিক্ষাজীবনের ভবিষ্যতে কী আছে জানি না, কিন্তু আমি এবং আমার সহপাঠীরা তার সঙ্গে মানিয়ে নিতে সমস্যায় পড়বো, কারণ আমরা ইতোমধ্যে অনলাইন ক্লাসের সঙ্গে নিজেদের অভ্যস্ত করে নিয়েছি। আমার মনে হয় না করোনাভাইরাস মহামারির আগে পরিস্থিতি যেমন ছিলো, তা পুরোপুরি ফিরে আসবে। এ কারণে, সামনে কী আছে তা নিয়ে আমি একই সঙ্গে রোমাঞ্চিত এবং উদ্বিগ্ন,' বলছিলেন ঢাকার একটি বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ের তৃতীয় বর্ষের শিক্ষার্থী রিসানা ইসলাম।

বাংলাদেশের বিশ্ববিদ্যালয়গুলো এ বছরের অক্টোবর থেকেই খুলতে শুরু করেছে। বিশেষত, সরকারি বিশ্ববিদ্যালয়গুলো ভাবছে মহামারির আগের শিক্ষাদান প্রক্রিয়াই শিক্ষার্থীদের জন্য মঙ্গলজনক এবং তারা সে প্রক্রিয়াতে পুরোপুরি ফিরে গেছে। অপরদিকে, বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়গুলো কিছুটা ভিন্ন দৃষ্টিতে বিষয়টা দেখছে। কিছু বিশ্ববিদ্যালয় অনলাইনে ক্লাস নেওয়া অব্যাহত রেখেছে আর কোনোটি অনলাইন ও প্রথাগত ক্লাসের সমন্বিত পদ্ধতিতে পাঠদান পরিচালনা করছে। বাকিরা সরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ের পথে হেঁটে প্রথাগত ক্লাসরুমের শিক্ষাপদ্ধতিতে ফিরে গেছে। তবে তাদের পাঠদান প্রক্রিয়ায় অনলাইন শিক্ষার কিছু বিষয় নতুন করে সংযুক্ত হয়েছে। 

তবে এ ক্ষেত্রে প্রশ্ন একটাই, কোভিড-১৯ মহামারির প্রভাব ধীরে ধীরে শূন্যের কোঠায় নেমে আসার প্রেক্ষাপটে উচ্চ শিক্ষার ক্ষেত্রে কোন দৃষ্টিভঙ্গি সবচেয়ে বেশি উপযোগী হবে?

কানাডিয়ান ইউনিভার্সিটি অব বাংলাদেশের ট্রাস্টি বোর্ডের উপদেষ্টা অধ্যাপক ড. এইচ এম জহিরুল হক বলেন, 'ব্লেন্ডেড লার্নিংকে (অন-লাইন ও প্রথাগত শিক্ষাপদ্ধতির সমন্বয়) এড়িয়ে যাওয়ার কোনো উপায় নেই, কারণ শিক্ষক ও শিক্ষার্থীরা ইতোমধ্যে অনলাইন শিক্ষার সঙ্গে নিজেদের মানিয়ে নিয়েছেন। কানাডিয়ান ইউনিভার্সিটি অব বাংলাদেশে (সিইউবি) আমরা নিশ্চিত করছি দেশের প্রত্যন্ত অঞ্চলে থাকা শিক্ষার্থী অথবা যাদের অভিভাবকরা তাদের সশরীরে ক্লাসে যোগদান করার অনুমতি দেয়নি, তারাও যাতে ক্যাম্পাসে অনুষ্ঠিত ক্লাসগুলো অনলাইনে লাইভ দেখতে পায়। মহামারি শেষ হওয়ার পরেও আমরা এই ব্লেন্ডেড ক্লাসের দৃষ্টিভঙ্গি বজায় রাখব।'

সারা বিশ্বের শিক্ষাবিদ ও গবেষকরা একমত হয়েছেন যে শিক্ষার ভবিষ্যৎ হচ্ছে ব্লেন্ডেড বা সমন্বিত শিক্ষা ব্যবস্থা। তবে এই সমন্বিত বা হাইব্রিড শিক্ষাব্যবস্থার প্রকৃত রূপ কী, তা নিয়ে বিভিন্ন মানুষের মতভেদ রয়েছে।

ইউনিভার্সিটি অব লিবারেল আর্টস বাংলাদেশের (ইউল্যাব) উপাচার্য অধ্যাপক ইমরান রহমান বলেন, 'যদি হাইব্রিড দৃষ্টিভঙ্গির অর্থ এটাই হয় যে কিছু শিক্ষার্থী অফলাইনে ক্লাস করবে আর বাকিরা অনলাইনে করবে, তাহলে আমি এ বিষয়ে খুব একটা আগ্রহী নই। এটা ভালো কাজ করবে না।' তিনি এ ধরনের সমন্বিত দৃষ্টিভঙ্গির ক্লাস বিভিন্ন ধরনের শিক্ষার্থীদের প্রতি কতটুকু ন্যায়সঙ্গত হবে, সে ব্যাপারে সন্দেহ প্রকাশ করেন। তিনি আশংকা করেন, যেসব শিক্ষার্থী শ্রেণিকক্ষে একে অপরের সঙ্গে যোগাযোগ করার সুযোগ পাবেন, তারা অনলাইনে ক্লাস করা শিক্ষার্থীদের চেয়ে বেশি সুবিধাজনক অবস্থানে থাকবেন।

এ ছাড়াও, ইন্টারনেট সংযোগের নির্ভরযোগ্যতা, সুষ্ঠু ডিভাইসের প্রাপ্তি এবং ঝামেলাহীন সমন্বিত শিক্ষাদান প্রক্রিয়া চালু করার জন্য প্রয়োজনীয় আধুনিক প্রযুক্তির জন্য বিশ্ববিদ্যালয়গুলোর বিনিয়োগ করার সক্ষমতা ও স্বদিচ্ছা নিয়েও প্রশ্ন তোলা যায়। অধ্যাপক ইমরান ব্যাখ্যা করেন, 'প্রতিটি শ্রেণিকক্ষে ক্যামেরা ও রেকর্ডিং প্রযুক্তি বসাতে হবে, যেটি করা সহজ নয়।'

আধুনিক প্রযুক্তিতে বিনিয়োগ এবং সর্বস্তরে এর প্রচলন, এই দুটি বিষয় এর আগে দূরশিক্ষণ প্রক্রিয়া চালু করার ক্ষেত্রে সবচেয়ে বড় প্রতিবন্ধকতা হিসেবে কাজ করেছে। সমন্বিত শিক্ষা চালুর ক্ষেত্রেও একই সমস্যা রয়েছে। অধ্যাপক জহিরুল বলেন, 'আমরা অনলাইন শিক্ষা পদ্ধতিতে যাওয়ার জন্য প্রযুক্তিগত দিক দিয়ে প্রস্তুত ছিলাম না। সিইউবিতে আমরা আমাদের শিক্ষা ব্যবস্থাপনা সফটওয়্যার 'মুডল' এর উন্নয়ন করেছি। আমরা প্রতিটি শ্রেণিকক্ষে ক্যামেরা ও মাইক্রোফোনের ব্যবস্থা করেছি। আমরা আমাদের সার্ভারের ধারণক্ষমতা বাড়িয়েছি এবং নিরবচ্ছিন্ন অনলাইন ক্লাস নিশ্চিত করার জন্য ব্যাকআপ সার্ভার কিনেছি। এছাড়াও আমরা অনলাইনে কিছু সার্টিফিকেট কোর্স চালু করতে যাচ্ছি।'

অধ্যাপক ইমরান রহমান বলেন, 'শিক্ষাব্যবস্থার ভবিষ্যৎ কী হবে তা নির্ধারণে বড় ভূমিকা রাখবে প্রযুক্তি। শিক্ষার্থীরা ম্যাসিভ ওপেন অনলাইন কোর্সেস (এমওওসিএস) প্ল্যাটফর্মের মাধ্যমে নিজেরাই শিক্ষাগ্রহণ করবে। এর সঙ্গে আমাদের লিবারেল আর্টস দর্শন মিলে যায়, যেখানে আমরা শিক্ষার্থীদের মধ্যে আজীবন শিক্ষা গ্রহণের প্রতি ভালোবাসা তৈরি করার চেষ্টা করি।'

কার্ডিফ বিশ্ববিদ্যালয় ও বাংলাদেশ প্রকৌশল ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয় (বুয়েট) পরিচালিত একটি সাম্প্রতিক সমীক্ষায় দেশের প্রেক্ষাপট ও শিক্ষার্থীদের আর্থসামাজিক পরিস্থিতি বিবেচনা করে সমন্বিত শিক্ষা ব্যবস্থা তৈরি করার সুপারিশ করা হয়েছে। অন্যান্য সুপারিশের মধ্যে আছে পাঠ্যক্রমকে পরিবর্তনযোগ্য রাখা। ঢাকার কিছু বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয় ইতোমধ্যে এই সুপারিশগুলোকে মাথায় রেখে বিভিন্ন উদ্যোগ নিচ্ছে।

অধ্যাপক জহিরুল বলেন, 'সিইউবিতে আমরা অনলাইন শিক্ষাকে আরও মানসম্মত করার জন্য পাঠক্রমের পরিবর্তন করেছি।'

ইউল্যাবের অধ্যাপক ইমরান বলেন, 'পাঠগুলোকে ছোট ছোট অংশে ভেঙ্গে ফেলতে হবে, কারণ অনলাইন ক্লাসরুমে শিক্ষার্থীদের সঙ্গে সংযোগ স্থাপন করা এবং তাদের মনোযোগ ধরে রাখা বেশ চ্যালেঞ্জিং।'

অপরদিকে, সাউথইস্ট বিশ্ববিদ্যালয় পুরো বিষয়টিকে নিয়ে এক ধাপ এগিয়ে গেছে। তারা শিক্ষার্থীদের জন্য শিক্ষাকে আরও সুবিধাজনক এবং সহজ করার জন্য বিভিন্ন পরিস্থিতিকে বিবেচনায় নিয়ে সে অনুযায়ী তাদের কৌশল নির্ধারণ করেছে।

সাউথইস্ট বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্য অধ্যাপক এ এফ এম মজিফুল ইসলাম বলেন, 'আমরা মাস্টার্সের ক্ষেত্রে অনলাইন কোর্স চালিয় যাব, কারণ বেশিরভাগ শিক্ষার্থী চাকরিজীবী এবং অনেকেই ঢাকার বাইরে থাকেন। অন্য সব কোর্সের ক্ষেত্রে আমরা লক্ষ্য করেছি, বেশিরভাগ শিক্ষার্থী ঈদের ছুটির আগে ঢাকা ছেড়ে যায় এবং ১ সপ্তাহ ছুটি কাটিয়ে তারপর ফিরে আসে। এই ২ সপ্তাহ আমরা অনলাইন ক্লাস পরিচালনা করব, যাতে শিক্ষাদানে কোনো প্রভাব না পড়ে। হরতালের মধ্যেও আমরা অনলাইন ক্লাস পরিচালনা করতে পারি।'

করোনাভাইরাস মহামারির পরবর্তী সময়ে শিক্ষাদানের সবচেয়ে সেরা পদ্ধতি বেছে নেওয়ার জন্য আরও পরীক্ষা নিরীক্ষা প্রয়োজন। তবে একটি বিষয় খুব পরিষ্কার, আমরা আগের পৃথিবীতে আর ফিরে যেতে পারছি না। 

অধ্যাপক মফিজুল বিষয়টাকে সুন্দর করে ব্যাখ্যা করেছেন, 'আমাদের আধুনিক প্রযুক্তি, জ্ঞান আর মহামারির সময় অর্জিত অভিজ্ঞতা ব্যবহার করে আমরা সশরীরে অথবা অনলাইন অথবা সমন্বিত শিক্ষা পদ্ধতি নিয়ে এগিয়ে যাব। আমরা সার্বক্ষণিকভাবে এই উদ্যোগগুলোর বিশ্লেষণ করতে থাকবো, যাতে আমরা বুঝতে পারি কোনগুলো কাজ করছে, কোনগুলো কাজ করছে না এবং কীভাবে চলতি পথের বিভিন্ন সমস্যার সঙ্গে মোকাবিলা করা যায়।'

অনুবাদ করেছেন মোহাম্মদ ইশতিয়াক খান।

Comments

The Daily Star  | English

Horrors inside the Gaza genocide: Through a survivor’s eyes

This is an eye-witness account, the story of a Palestinian in Gaza, a human being, a 24-year-old medical student, his real human life of love and loss, and a human testimony of war crimes perpetrated by the Israeli government and the military in the deadliest campaign of bombings and mass killings in recent history.

17h ago