‘বেতারে প্রথম গান গেয়ে ১০ টাকা সম্মানী পেয়েছিলাম’

ফেরদৌসী রহমান বাংলাদেশের সংগীত জগতের বিখ্যাত এবং গুরুত্বপূর্ণ একটি নাম। গত ছয় দশক ধরে সংগীতকে ঘিরেই তার জীবন। অনেক কালজয়ী গানের শিল্পী ফেরদৌসী রহমান এ দেশের প্রখ্যাত শিল্পী আব্বাসউদ্দীন আহমদের যোগ্য উত্তরসূরি।
ফেরদৌসী রহমান। স্টার ফাইল ফটো

ফেরদৌসী রহমান বাংলাদেশের সংগীত জগতের বিখ্যাত এবং গুরুত্বপূর্ণ একটি নাম। গত ছয় দশক ধরে সংগীতকে ঘিরেই তার জীবন। অনেক কালজয়ী গানের শিল্পী ফেরদৌসী রহমান এ দেশের প্রখ্যাত শিল্পী আব্বাসউদ্দীন আহমদের যোগ্য উত্তরসূরি।

একাধারে পল্লীগীতি, নজরুল, রবীন্দ্র, আধুনিক গানের শিল্পী ফেরদৌসী রহমান ষাটের দশকে আসিয়া সিনেমায় প্রথম প্লেব্যাক করেন। এ দেশে টেলিভিশন সম্প্রচার শুরু হলে সেখানে প্রথম গান তিনিই গেয়েছিলেন।

জাতীয় চলচ্চিত্র পুরস্কার, একুশে পদকসহ অনেক সম্মাননায় ভূষিত হয়েছেন তিনি। গুণী শিল্পী ফেরদৌসী রহমান দ্য ডেইলি স্টারকে বলেছেন তার ফেলে আসা জীবনের অনেক কথা।

প্রথম প্লেব্যাক করা প্রসঙ্গে ফেরদৌসী রহমান বলেন 'আমার সংগীত জীবনে অনেক গান গেয়েছি। সিনেমার জন্যও অনেক গান গেয়েছি। যতদূর মনে পড়ে প্রথম যে সিনেমার জন্য গান গেয়েছিলাম, সেটি রিলিজ হয়নি। বহু বছর আগের কথা সেটা। বিজি প্রেসের ওখানে ছোট্ট একটি স্টুডিওতে গানটির রেকর্ডিং করেছিলাম। এরপর ওইভাবে বলতে গেলে আমার প্রথম প্লেব্যাক আসিয়া সিনেমায়।'

'সেই সময় আসিয়া সিনেমাটি আমাদের দেশে ও পাকিস্তানে খুব নাম করেছিল। আসিয়া সিনেমার গানের রেকর্ডিংও করেছিলাম বিজি প্রেসের ওই ছোট্ট স্টুডিওতে। জীবনের প্রথম রিলিজ হওয়া প্লেব্যাক করা সিনেমাটি ছিল সেই সময়ের বহুল আলোচিত সিনেমা।'

'তারপর তো এক এক করে বহু সিনেমার জন্য গান গেয়েছি।'

ফেলে আসা জীবন নিয়ে এই গুণী শিল্পী বলেন, 'ফেলে আসা জীবনের কথা বলতে গেলে বা নস্টালজিক হয়ে পড়লে তো কত কথাই মনে পড়ে। আব্বার কথাও খুব মনে পড়ে। আব্বাকে নিয়ে কিছু স্মৃতির কথা শেয়ার করছি। অনেক বছর আগে কলকাতা থেকে আব্বা আমাদের নিয়ে ঢাকায় এলেন। ঢাকা বলতে তখন ছিল সদরঘাট, ইসলামপুরের ওইদিকটা। ভিক্টোরিয়া পার্কর ওদিকে আমাদের বাসা ছিল তখন। সেই সময় আমি রেডিওতে গান গাওয়া শুরু করি। ১০ টাকা সম্মানী পেয়েছিলাম প্রথম বেতারে গান গেয়ে। সেই সময় ১০ টাকা অনেক টাকা।'

'আমার আব্বা প্রখ্যাত সংগীত শিল্পী আব্বাসউদ্দীন আহমদ। সেই সময়ে একদিন বলেছিলেন, "টাকাগুলো জমিয়ে রেখো। কাজে দেবে।"'

'তারপর তাই হলো। রেডিওর সম্মানীর টাকাগুলো জমিয়ে রাখতে শুরু করি। একদিন আব্বা ১০ টাকা দিয়ে বললেন, "যাও আজ যা খুশি খরচ করে এসো।"'

'আমি ও আমার ভাই ১০ টাকা নিয়ে ইসলামপুরে গিয়েছিলাম। ২ ভাইবোন মিলে রওনা দিলাম। সদরঘাটের ওদিকে তো মূল শহর ছিল। ইসলামপুরে গেলাম। কত কী যে দেখতে থাকি। সেদিন ঘুরতে ঘুরতে দেখতে দেখতে সন্ধ্যা হয়ে গেল।'

'বাসায় ফিরে আব্বাকে ১০ টাকা ফেরত দিই। আব্বা বললেন, সে কী? কিছুই তো কিনলে না? চকলেট তো কিনতে পারতে?'

'ওই স্মৃতিটা আব্বাকে ঘিরে মনে পড়ে আজও।'

'এক সময় আমরা বাসা বদল করে পল্টনে চলে আসি। তখন আমি কলেজে উঠে গেছি। কলেজে পড়ার সময়ের একটি ঘটনা মনে পড়ে। তখন রিকশা ও ঘোড়ার গাড়ির প্রচলন ছিল ঢাকা শহরে। বাস গাড়ি কমই ছিল। কলেজে যাতায়াত করার জন্য আমার জন্য একটি রিকশা ভাড়া করে দেওয়া হয়েছিল। প্রতিদিন একই রিকশা আমাকে কলেজে নিয়ে যেত। আবার ছুটি হলে ওই রিকশাওয়ালা আমাকে বাসায় নিয়ে আসতেন। রিকশায় যেতে যেতে শহর উপভোগ করার স্মৃতি আজও মনে এখনও দাগ কেটে আছে।'

'আব্বা সেই সময় একদিন বলেছিলেন, দেখো গাড়ি কিনতে পারি। কিন্তু তোমরা জীবনটাকে জানো। জীবনটাকে দেখো। জীবনটাকে বোঝো এবং শেখো। কষ্ট করতে শেখো।'

'আব্বার ওই কথাটি সারাজীবন মনে রেখে পথ চলেছি।'

'৫০ এর দশকে ঢাকায় রিকশার মধ্যে পর্দা করে দেওয়া হতো। ঘোড়ার গাড়িতেও পর্দা করে রাখা হতো। এতটাই রক্ষণশীল ছিল সেই সময়ের সমাজ ব্যবস্থা। মা ও আমি কয়েকদিন ঘোড়ার গাড়িতে করে যাতায়াত করেছি। বেশি করেছি রিকশায়। ঘোড়ার গাড়িতে করে যাওয়ার স্মৃতি ছিল বড়ই মধুর। ঘোড়ার পায়ের আওয়াজ হতো, অন্যরকম লাগতো।'

টেলিভিশনে প্রথম গান গাওয়ার স্মৃতি নিয়ে ফেরদৌসী রহমান বলেন, 'এদেশে যখন প্রথম টেলিভিশন এলো, উদ্বোধনী অনুষ্ঠানে প্রথম গানটি আমার ছিল। আমিই প্রথম এ দেশের টেলিভিশনে গান গেয়েছিলাম। এটাও বড় একটি অ্যাচিভমেন্ট। টেলিভিশনে প্রথম গান গেয়ে পেয়েছিলাম ২০০ টাকা। এটা ১৯৬৪ সালের কথা। খুবই মধুর স্মৃতি, যা কখনো ভুলবার নয়। আমার জন্য এটা অনেক সম্মানের বিষয়।'

দেশের বাইরে গান গাইতে যাওয়া প্রসঙ্গে বলেন, 'একবার চীন গিয়েছিলাম। প্রায় ৫০ জনের একটা দল। চীনের প্রেসিডেন্টও ছিলেন অনুষ্ঠানে। ১০ হাজারের মতো দর্শক ছিল। দেশের গান দিয়ে শুরু করি। বেশ কয়েকটি গান গেয়েছিলাম। শেষে চীনা ভাষায় দুটি গান গাই। চীনা দর্শকরা এতটাই হাততালি দিয়েছিলেন যা মনে আছে। সবাই ভীষণ খুশি হয়েছিলেন। প্রেসিডেন্ট নিজে এসে তার ভালো লাগার কথা জানিয়েছিলেন।'

'চীনে সেবার ৬টি গান ১৮ বার গেয়েছিলাম। প্রতিটি গান ৩ বার করে। খুবই সফল একটা আয়োজন ছিল। এরপর মস্কোতেও এক অনুষ্ঠানে গান গেয়েছি।'

তিনি বলেন, 'আর দেশের স্টেজে কত গান গেয়েছি। দেশের স্টেজে গান গাওয়ার আনন্দই আমার কাছে বেশি। সবার আগে আমার দেশ। আমি এই দেশের মানুষ। এই দেশের শিল্পী।'

ও কি গাড়িয়াল ভাই গানের প্রসঙ্গে বলেন, 'এটা আব্বার গান। আমি গাইছি অনেক বছর ধরে। এই গানটির অন্যরকম একটি আবেদন আছে। দেশের মাটির ঘ্রাণ আছে এই গানে। মানুষ গানটি এতটা গ্রহণ করবে ভাবনায় ছিল না। এখনো এই গানটির আবেদন আছে। এটা অনেক ভালো লাগার বিষয়।'

ব্যক্তিজীবন প্রসঙ্গে তিনি বলেন, 'ছা্ত্র জীবনে অনেক ভালো ছাত্র ছিলাম। মেট্রিক পরীক্ষায় বোর্ড স্ট্যান্ড করেছিলাম। পড়ালেখা, সংগীত জীবন, সংসার সবকিছু করেছি গুছিয়ে। কোনো কাজকে অবহেলা করিনি। সব কিছু গোছানো ছিল আমার। সবকিছু উপভোগ করেছি। না হলে করা সম্ভব হতো না। এত ভালো পড়াশোনা করেও গান করেছি। আবার সংসারেও সময় দিয়েছি।'

সবশেষে ফেরদৌসী রহমান বলেন, 'এক জীবনে যতটুকু পেয়েছি তার জন্য পরম সৃষ্টিকর্তার প্রতি আমার কৃতজ্ঞতার শেষ নেই। আর পেয়েছি মানুষের ভালোবাসা। পেছনে ফিরে তাকালে ভাবি, কত মানুষ আমাকে ভালোবাসেন। কত মানুষের কাছ থেকে সম্মান, ভালোবাসা ও শ্রদ্ধা পেয়ে আসছি।'

'আসলে ফেলে আসা জীবনের গল্প কোনোদিনও শেষ হবে না।'

Comments

The Daily Star  | English

How hot is too hot?

Scientists say our focus should not be on just heat, but a combination of heat and humidity

2h ago