অজান্তেই দুশ্চিন্তায় ভুগছেন না তো?

ছবি: সংগৃহীত

ওভারথিঙ্কিং বা মাত্রাতিরিক্ত চিন্তাকেই বলা হয় দুশ্চিন্তা। কী হওয়ার ছিল, কী হলো না। হলে ভালো বা খারাপ হতো সেই ভাবনায় বিভোর থাকা। এই চিন্তা-ভাবনা কিন্তু বেশিরভাগ সময়ে হয় অতীত, না হয় ভবিষ্যত কেন্দ্রিক। যেমন ধরুন, আপনি কী করলে পরীক্ষায় আরেকটু ভালো করতেন, কী হলে আপনি আগামী ৫ বছর পর আরেকটু ভালো স্থানে থাকতে পারবেন, কেমন থাকলে আপনার প্রিয় মানুষটিকে আপনার হারাতে হতো না এইসব নানান চিন্তা।
 
অনেকে বলেন, চিন্তা-ভাবনা না করলে সফল হওয়া যায় না। অথবা আগে থেকে চিন্তা করেছেন বলে বিপদ থেকে রক্ষা পেয়েছেন ইত্যাদি। চিন্তা করা নেতিবাচক বিষয় সেটা বলা হচ্ছে না। তবে, অতিরিক্ত চিন্তা-ভাবনা অবশ্যই নেতিবাচক। গবেষণা মোতাবেক, মানসিক অশান্তির মূল কারণ হলো বাস্তব প্রেক্ষাপটের বাইরে চিন্তা-ভাবনা করা। সেটা হতে পারে কারও কল্পনা কিংবা অতীত ও ভবিষ্যৎ নিয়ে মাত্রাতিরিক্ত চিন্তা করা। আর এই ওভারথিঙ্কিং-এর ফলে ক্রমাগত মানুষের ব্রেইনে প্রভাব ফেলে, যা পরবর্তী সময়ে সেটা সমস্যা সমাধান আর সৃজনশীলতাকে বিনষ্ট করে ফেলে। 

সুস্থ মস্তিষ্কের বিপরীতে পরিশ্রান্ত প্রতিচ্ছবি। ছবি: সংগৃহীত

আপনিও কি দুশ্চিন্তাগ্রস্ত?

প্রাত্যহিক জীবনে নানান ভাবনা চলেই আসে আমাদের মগজের ভেতরে। তাই বলে সবই কি দুশ্চিন্তা? না, সব নয়। তবে বেশ কিছু লক্ষণ আপনার মধ্যে বিদ্যমান থাকলে বুঝে নেবেন নিজে ভালো থাকতে এবং অন্যদের ভালো রাখতে আপনার পরিবর্তন আবশ্যক। এক নজরে যাচাই করে নিন নিজেকে! 

  • আপনি অতীতের ভুলগুলো নিয়ে বেশি ভাবেন।
  • আপনার সঙ্গে ঘটা অপ্রীতিকর পরিস্থিতি সারাক্ষণ মাথায় ঘুরতে থাকে।
  • আপনি ঠিকমতো ঘুমাতে পারেন না, সারাদিনের ঘটনাগুলো ঘুমাতে গেলে বেশি মনে পড়ে।
  • আপনার অপছন্দের কাজগুলো কেউ করলে ভুলতে পারেন না।
  • নানা ধরনের চিন্তায় বিষন্ন থাকেন।
  • চাইলেও না ভেবে থাকতে পারেন না।
  • ভবিষ্যৎ নিয়ে বেশি পরিকল্পনা করেন।
  • এমন যদি হতো টাইপ চিন্তা-ভাবনায় মশগুল থাকেন।
  • মানুষ  ভাববে, কি মনে করবে এই নিয়ে টেনশনে থাকেন।
  • কারও সঙ্গে কথা বলার পরে চিন্তা করেন কী বলা উচিত ছিল, কী উচিত হয়নি।
  • অতীত আর ভবিষ্যৎ নিয়ে ভাবতে ভাবতে বর্তমানকেই ভুলে বসে আছেন।
  • সারাক্ষণ ভয়ে থাকেন আপনার সঙ্গে কী ঘটবে, আপনি কীভাবে ভালো থাকবেন ইত্যাদি আত্নকেন্দ্রীক টাইপ টেনশনে ভোগেন। 
নানান প্রশ্নে বিভোর। ছবি: সংগৃহীত

এই কি-পয়েন্টগুলোর বেশিরভাগই যদি আপনার সঙ্গে মিলে যায় তাহলে নিঃসন্দেহে আপনি একজন ওভারথিঙ্কার বা দুশ্চিন্তাগ্রস্ত। আপনি জানেনও না কীভাবে আপনি নিজেই আপনার ক্ষতির কারণ হচ্ছেন। আপনি জানেন না, বেশি বেশি চিন্তা করে আপনি নিজের স্কিলগুলোতে শান দেওয়ার বিপরীতে দুর্বল করে ফেলছেন। এরকম চলতে থাকলে আপনি একসময় আপনার জীবনের স্বাভাবিক ছন্দ হারিয়ে ফেলবেন। শুধু কি তাই? আপনার সবল মস্তিষ্ক ধীরে ধীরে কাজ করার ক্ষমতাটাই হারিয়ে ফেলবে। ভয়ংকর হলেও সত্যি, আপনি মানসিক বিকারগ্রস্তও হয়ে পড়তে পারেন আপনার অজান্তেই। 

এ বিষয়ে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের মনোবিজ্ঞান বিভাগের অধ্যাপক ড মেহতাব খানন বলেন, 'মানসিক স্বাস্থ্য সম্পর্কে সচেতনতা আমাদের দেশের প্রেক্ষাপটে খুবই কম। আমাদের আরও বেশি বোঝাপড়া তৈরি করা উচিত এবং এই বিষয়ে আরও অনেক আলোচনা করা উচিত । দুর্ভাগ্যবশত, আমরা প্রায়শই এটিকে এড়িয়ে চলছি। উন্নত দেশগুলিতে, যারা এই সমস্যাগুলির সাথে লড়াই করছেন তাদের জন্য প্রথমে এগুলি থেকে বেরিয়ে আসার উপায় রয়েছে৷ অনেক মানুষ এমনকি একজন সাইকিয়াট্রিস্ট এবং সাইকোথেরাপিস্টের মধ্যে পার্থক্য জানেন না।' 

তাহলে ওভারথিঙ্কিং থেকে রেহাই পাওয়ার উপায়?

মনে রাখবেন, অতিরিক্ত চিন্তা করে সমস্যা সৃষ্টি যেহেতু আপনিই করছেন তাহলে সমাধানও আপনারই খুঁজে বের করতে হবে। প্রকৃতির নিয়মে সমস্যা সৃষ্টির থেকে সমাধানের প্রক্রিয়া একটু জটিল হয়। ড মেহতাব খানমের ভাষ্যমতে, 'অতিমাত্রায় উদ্বিগ্ন থাকার ফলে অনেকে বাস্তবতার সঙ্গে যোগাযোগ হারিয়ে ফেলতে পারে। তখন তাদের ওষুধের প্রয়োজন কারণ তাদের মস্তিষ্কের রাসায়নিক বা নিউরোট্রান্সমিটার ভারসাম্যহীন। এটি দীর্ঘ সময়ের জন্য অবহেলা করলে বড় ক্ষতির আশঙ্কা থেকেই যায়।' 

তাই আপনি যদি বুঝতে পারেন আপনি বেশি চিন্তা করছেন তাহলে শুরুতেই কালক্ষেপণ না করে নিচের কাজগুলো ধীরে ধীরে অনুসরণ করার চেষ্টা করুন! 

পজিটিভ থাকুন, নেগেটিভিটি দূর করুন

সব ভাবনার এক ভাবনা নেতিবাচকতা। যত বেশি নেতিবাচক বিষয় থেকে নিজেকে দূরে রাখবেন, তত বেশি মানসিক প্রশান্তি লাভ করবেন। আপনার দৈনন্দিন জীবনে যেসব বিষয় আপনার ভালো থাকার পথে বাধা দিচ্ছে, সেসব বিষয় ছেটে ফেলুন রুটিন থেকে। মনে রাখবেন- জীবন আপনার, ভালো থাকার দায়িত্বও আপনার।

কষ্টের স্মৃতি পেছনে রাখুন, আনন্দে ভালো থাকুন

সবার জীবনেই কিছু না কিছু খারাপ লাগা থাকে। কিছু পরিস্থিতি থাকে যেগুলো আসলে ভুলে থাকা সম্ভব নয়। তাই বলে কষ্টে মন ভারাক্রান্ত হয়ে পেছনে পড়ে থাকবেন নাকি পরিস্থিতির সঙ্গে খাপ খাইয়ে ভালো থাকার চেষ্টা করবেন? সিদ্ধান্ত আপনার। ভুলে যাবেন না, কষ্টের স্মৃতিগুলো আপনি বদলাতে পারবেন না কিন্তু চাইলে আনন্দের মুহূর্তগুলো উপভোগ করে জীবনে এক ধাপ এগিয়ে থাকতে পারবেন।

'যদি হতো' পরিহার করুন, সন্তুষ্ট থাকুন

একবার ভাবুন তো, আপনার জীবন কি 'যদি' শব্দের মধ্যেই সীমাবদ্ধ রেখে সর্বদা হা-হুতাশ করে নির্বুদ্ধিতার পরিচয় দিবেন? নাকি সৃষ্টিকর্তার প্রতি সন্তুষ্ট থেকে কর্মজীবনে এগিয়ে যাওয়ার পরিকল্পনা করবেন? 'যদি হতো' টাইপ চিন্তা-ভাবনা আপনাকে কখনোই স্বস্তিতে থাকতে দেবে না। সর্বদা অভাব নিয়ে চিন্তা করলে অভাব মোচনের কাজটা কখন করবেন মশাই?

গুছিয়ে রাখুন সব কাজ, নির্ভাবনায় কাটান রাত

আগামীকাল কী করবেন সবকিছু ভেবে রাখুন ঘুমানোর আগেই। এক্ষেত্রে টু ডু লিস্টের ব্যবহার করতে পারেন, ফোনে রিমাইন্ডার সেট করে রাখতে পারেন কিংবা আপনার প্রিয় ডায়েরিতে টুকে রাখতে পারেন। রুটিন অনুযায়ী কাজ করার অভ্যাস না থাকলে, অভ্যাস করে ফেলুন। আপনার ব্যক্তি জীবন তো বটেই একাডেমিক ও প্রফেশনাল জীবনেও বেশ কাজে দিবে।

নিজের শখকে সময় দিন, নিশ্চিন্তে কাটুক কয়েকটা দিন 

কর্মব্যস্ত জীবনের একঘেয়েমি কমানোর ফুরসতটুকু মিলছে না? কয়দিনের জন্য ছুটি নিন সবকিছু থেকে। ঘুরে আসুন ভিন্ন কোনো জায়গা থেকে। কোলাহলময় নগরী থেকে দূরে কোথাও সূর্যস্নান উপভোগ করার সময় আলগোছে ফেলে দিন আপনার পাওয়া না পাওয়ার বিরক্তিকর লিস্টটা। ফেরার সময় সাথে নিয়ে আসুন একরাশ মুগ্ধতা।

সীমাবদ্ধতাকে গ্রহণ করুন, পরিপূর্ণতাকে দূরে রাখুন

কোনো কাজ করার আগে কখনো পরিপূর্ণতা নিয়ে দুশ্চিন্তা করা উচিত নয়। আগে থেকে যদি একটা মাপকাঠি বানিয়ে রাখেন, কাজের পর তা পূর্ণ না হলেই হতাশায় ভুগবেন যা অস্বাভাবিক কিছু নয়। কিন্তু আপনি যদি পরিপূর্ণতাকে এত বেশি মূল্য না দিতেন, তাহলে নিজের মতো করে বা পরিস্থিতি অনুযায়ী কাজটি নিশ্চিন্তে করতে পারতেন। আর কাজ শেষে হতাশায় নিমজ্জিত না থেকে সন্তুষ্টির হাসি হাসতেন। 

বর্তমান নিয়ে থাকুন, ভবিষ্যৎ নিয়ে কম ভাবুন

জীবনের বেশিরভাগ সময় আগামী নিয়ে ভাবনায় থাকি অনেকেই। কখনো কখনো এত বেশি অপটিমিস্টিক হয়ে যাই, বর্তমানকেই ভুলে যাই। সবাইকে সময় কীভাবে অপচয় না করে থাকা যায় সেভাবে কাজ করা উচিত। পরীক্ষার প্রস্তুতি কীভাবে নেবেন সে চিন্তা করতে গিয়ে প্রস্তুতি নিতেই দেরি করে ফেলেন অনেকে। তাদের বলছি, এত বেশি যদি ভবিষ্যৎ নিয়ে মুখর থাকেন, বর্তমানের কাজটা করবেন কখন?

মস্তিষ্ক স্থির রাখুন, নিজেকে ভালো রাখুন

জীবনে বাঁচতে চাইলে প্রথমেই দরকার নিজের সুস্থতা। তার জন্য প্রয়োজন পর্যাপ্ত ঘুম। সারাদিনের কর্মব্যস্ততায় নিজেকে স্থির রাখতে হলে, রাতে ঘুমাতে হবে ঠিক সময়ে। গবেষণা অনুযায়ী, যারা মধ্যরাতে ঘুমাতে যায় তাদের তুলনায় ঠিক সময়ে ঘুমানোর মানুষগুলো বেশি কর্মক্ষম হয়। অর্থাৎ, শুধু ঘুমালেই হবে না, সময়টাও মেইনটেইন করতে হবে। সেই সঙ্গে উদ্বিগ্নতা, বিষন্নতা ও অধিক চিন্তা-ভাবনার অভ্যাস পরিহার করার চেষ্টা করতে হবে। তবেই ভালো থাকবে আপনার মস্তিষ্ক, ভালো থাকবেন আপনি।

উপর্যুক্ত নিয়ম অনুসারে জীবন পরিচালনা করলে অতিরিক্ত চিন্তা-ভাবনা বা ওভারথিঙ্কিং থেকে দূরে থাকতে পারবেন আপনি। ভুলে যাবেন না, বেশি চিন্তা করে সবার থেকে এগিয়ে থাকতে গিয়ে আপনি অবচেতনভাবে সবার থেকে পিছিয়েই পড়ছেন। আর জীবনে স্বাগত জানাচ্ছেন দীর্ঘস্থায়ী অসুস্থতা আর মানসিক যন্ত্রণা। 

 

তথ্যসূত্র: 
সাইকো.কম
ক্যারিয়ার গাইড.কম
ভেরি ওয়েলমাইন্ড

Comments

The Daily Star  | English

Students to resist AL event today

The student movement against discrimination will hold a mass gathering at Zero Point in the capital’s Gulistan today, demanding trial of the Awami League.

3h ago