জীবন গিয়েছে চলে তাদের কুড়ি-কুড়ি বছরের পার!

৭৪ বছর পর আবার দেখা। ছবি: সংগৃহীত

একে একে কেটে গেছে ৭৪ বছর। অনেকেরই তো এতো বছর আয়ু থাকে না। তবে তারা বেঁচে আছেন। জীবনের শেষ প্রান্তে এসে দেখা করেছেন একে অপরের সঙ্গে।

মনে হতে পারে এটি কোনো চলচ্চিত্র বা উপন্যাসের কাহিনী। আসলে এটি ঘটমান বাস্তবতা। এখানে কল্পনার কোনো রঙ নেই।

এমন অম্ল-মধুর দৃশ্যের সংবাদ মাঝে-মধ্যে গণমাধ্যমে আসে বৈকি! তেমন এক দৃশ্য বিশ্ববাসী দেখেছে ভারত-পাকিস্তানের করতারপুর করিডোরে।

গতকাল বৃহস্পতিবার ভারতীয় সংবাদমাধ্যম জানায়, ১৯৪৭ সালে দেশভাগের বিশৃঙ্খল পরিস্থিতিতে পাঞ্জাবের লুধিয়ানা এলাকা থেকে হারিয়ে যাওয়া ২ সহোদর সাত দশকের বেশি সময় পর একে অপরকে খুঁজে পেয়েছেন।

প্রায় ৭৪ বছর পর দেখা করেছেন বৈরী ২ প্রতিবেশী দেশের সীমান্তের ওপর। তাদের আনন্দঘন মুহূর্ত দেখে সেই পুনর্মিলনের আয়োজক ড. জাগসির সিং মন্তব্য করেন, 'কয়েক ঘণ্টা যেন ভারত-পাকিস্তান হারিয়ে গিয়েছিল!'

সংবাদমাধ্যম দ্য প্রিন্ট জানায়, সাদিক খান, হাবিব খান ও তাদের এক বোন মা-বাবার সঙ্গে থাকতেন লুধিয়ানার জাগরাঁও গ্রামে। এক সময় নেমে আসে দেশভাগের বিভীষিকা। চারদিকে, আগুন-হত্যাযজ্ঞ। এমন পরিস্থিতিতে কোলের শিশু হাবিবকে নিয়ে মা গেলেন ৪৫ কিলোমিটার দূরের ফুলেওয়ালা গ্রামে, তার মা-বাবার সঙ্গে দেখা করতে। বাড়িতে রেখে যান স্বামী, ছেলে ও মেয়েকে।

এরপর তাদের জীবনে শুরু হয় এক নতুন ইতিহাস। ইতিহাসের সেই অধ্যায় বেদনা-বিধুর, আক্ষেপ আর অশ্রুর।

হাবিব-সাদিকদের বাবাকে হত্যা করে দুষ্কৃতিকারীরা। হট্টগোলের মধ্যে বিচ্ছিন্ন হয়ে পড়েন বোন। চলে আসেন নতুন রাষ্ট্র পাকিস্তানে। সাদিক কয়েক বছর পর বোনকে খুঁজে পেলেও মা ও ছোটভাই হাবিবকে হারিয়ে ফেলেন।

দেশভাগের পর বিভক্ত পাঞ্জাবের পাকিস্তান অংশে বোগরান গ্রামে চাচাদের সঙ্গে বেড়ে ওঠেন সাদিক। ছেলে-মেয়ে, নাতি-নাতনি নিয়ে পাকিস্তানে সাদিকের বড় পরিবার।

এ দিকে, মা-বাবা, ভাই-বোনকে হারিয়ে পাঞ্জাবের ভারতীয় অংশে চরম দুর্দশায় পড়েন কোলের সেই ছোট্ট শিশু হাবিব। তার মা যখন জানতে পারেন তার স্বামী-সন্তানরা দাঙ্গার দাবানলে হারিয়ে গেছেন তখন তিনি খালে ঝাঁপ দিয়ে আত্মহনন করেন।

হাবিবকে লালন-পালন করেন তার মামারা। পরিবারের অন্যদের মতো হাবিব গোচারণ ও দিনমজুরি করে জীবিকা নির্বাহ করতে থাকেন।

যেভাবে বদলায় দৃশ্যপট

পাকিস্তানভিত্তিক ইউটিউব চ্যানেল 'পাঞ্জাবি লেহার'-এ একটি ভিডিও প্রকাশিত হওয়ার পর আকস্মিকভাবে বদলে যেতে থাকে দৃশ্যপট। নাসির দিলন ও লাভলি সিং তাদের সেই চ্যানেলে মূলত বিভক্ত পাঞ্জাবের বিভক্ত পরিবারগুলোর ওপর ভিডিও প্রকাশ করে থাকেন।

গ্রামের প্রধান ও সাদিকের ভাগ্নে একদিন নাসির দিলনকে জানান, তার মামা ভারতে থেকে যাওয়া তার ভাইকে খুঁজছেন। তিনি থাকেন পূর্ব পাঞ্জাবের ফুলেওয়ারা গ্রামে। ২০১৯ সালের মে মাসে নাসির ও লাভলি বগরানে গিয়ে সাদিক খানের সঙ্গে কথা বলে জেনে নেন সেসব কাহিনী।

এরপর, সাদিকের বার্তা দিয়ে নাসির ভিডিও ক্লিপ তৈরি করে তাদের চ্যানেলে প্রকাশ করেন। সেখানে ফুলেওয়ালা গ্রামের কথা উল্লেখ করা হয়।

ভাইকে আজও খুঁজে চলার আর্তি নিয়ে সাদিক বলেন, 'হাবিব, তোমাকে আমি বহু বছর ধরে খুঁজে চলছি। তুমি যদি আমাকে দেখতে পাও তাহলে যোগাযোগ করো। এখন আমার বয়স ৮০ বছর। জানি না আর কতদিন বাঁচবো। কিন্তু, তোমাকে দেখার জন্য অধীর আগ্রহ নিয়ে অপেক্ষা করছি।'

ভিডিও প্রকাশের ২ দিন পর জাগরাঁও গ্রামের বাসিন্দাদের মধ্যে যারা সাদিক ও হাবিবকে জানতেন, তাদের একজন তা জানান তার আত্মীয় ও ফুলেওয়ালা গ্রামের বাসিন্দা ড. জাগসির সিংকে।

ড. জাগসির দ্য প্রিন্টকে বলেন, 'হাবিব গ্রামের স্বল্প সংখ্যক মুসলমানদের একজন। আমি যখন ভিডিওটি দেখি তখন সাদিক ও হাবিবের চেহারায় মিল পাই। হাবিবকে ভিডিওটি দেখানোর পর তিনি কাঁদতে শুরু করেন। তারপর মোবাইল ফোনে ভিডিও কলে তাদের কথা বলিয়ে দিই।'

এই ব্যক্তির হাত ধরেই হারিয়ে যাওয়া ২ সহোদরের কথার পর শুরু হয় সামনা-সামনি দেখার প্রস্তুতি।

ড. জাগসি আরও বলেন, 'আমরা ভারতে আর নাসির পাকিস্তানে। সিদ্ধান্ত নিই ২ ভাইকে করতারপুর সীমান্তে নিয়ে দেখা করাতেই হবে। তাদের বয়স হয়ে গেছে। কোনো দুর্ঘটনা ঘটে যাওয়ার আগেই যদি তাদের দেখা করাতে না পারি, তাহলে নিজেদের কখনই ক্ষমা করতে পারবো না।'

করতারপুরের দৃশ্য

ভারত-পাকিস্তান সীমান্ত থেকে প্রায় ৫ কিলোমিটার ভেতরে পাকিস্তানের করতারপুর। সেই করিডোর দিয়ে ভারত থেকে শিখ ধর্মাম্বলীরা নিয়মিত যান গুরুদুয়ারা দরবার সাহিব তীর্থস্থানে। সেই স্থানটিকে বেছে নেওয়া হয় সাদিক ও হাবিবের পুনর্মিলনস্থল হিসেবে।

২০২০ সালের মার্চে দিন-তারিখ ঠিক করা হলে আচমকা বিশ্বব্যাপী শুরু হয় করোনা মহামারি। লকডাউনের কারণে বন্ধ থাকে করতারপুর করিডোর।

ভাগ্য সদয় হওয়ায় সম্প্রতি সাদিক ও হাবিব করতারপুরে দরবার সাহিব তীর্থস্থানে গিয়ে দেখা করেন।

পুনর্মিলন

ভিডিওতে দেখা যায়, ২ ভাই একে অপরকে জড়িয়ে কাঁদছেন। বসলেন মেঝেতে। আবেগ জড়ানো কণ্ঠে হাবিব বললেন, 'দেখ, অবশেষে আমাদের দেখা হলো।'

সাদিক তখন তার পরিবারের সদস্যদের পরিচয় করিয়ে দেন ছোটভাই হাবিবের সঙ্গে। সবাই মিলে খাবার খান।

দেশ ভিন্ন হলেও ভাষা এক। শত কথার গল্প হয় তাদের মধ্যে। হয় স্মৃতিচারণ। সাদিক জানান, দেশ ভাগের সময় তার বয়স ছিল ৬ বছরের মতো। এখনো অনেক কিছু তার স্পষ্ট মনে আছে। হাবিব ছিল কোলের শিশু।

সাদিক তার মাকে আর কখনোই দেখতে পাননি। পরিবারের অন্য সদস্যদের সঙ্গে তাকেও গ্রামছাড়া করেছিল দাঙ্গাবাজরা।

হাবিব বিয়ে করেননি। তিনি ভূমিহীন দিনমজুর—এসব জানার পর সাদিক বলেন, 'ভাই, যা কিছু আমার তা তোমারও।'

তারপর আবারও দেখা হওয়ার বাসনা নিয়ে বিদায় নেন ২ ভাই।

Comments

The Daily Star  | English
Anti-Terrorism Act

Govt issues ordinance amending Anti-Terrorism Act

Activities of certain entities, and activities supporting them can now be banned

1h ago