আনন্দ রূপ নিয়েছে দুঃস্বপ্ন যাত্রায়

গত কয়েক সপ্তাহ ধরে একমাত্র মেয়ে লিলিয়া সিজদার প্রথম জন্মদিন পালনের জন্য বিভিন্ন পরিকল্পনা করছিলেন মোহন ও তানিয়া। মেয়ের জন্মদিনটা স্মরণীয় করে রাখতে এক জোড়া ডায়মন্ডের কানের দুল কিনেছিলেন তারা। প্রথম জন্মদিনে মেয়ের কান ফুটানোর এবং কিয়েভের বাড়িতে একটি পার্টির আয়োজনও করেছিলেন এই বাংলাদেশি প্রবাসী দম্পতি।
মেহেদী হাসান মোহন ও তানিয়া খাতুন তাদের ১ বছর বয়সী মেয়েকে নিয়ে এখন ঝাঁপিয়ে পড়েছেন বেঁচে থাকার লড়াইয়ে। ছবি: মেহেদী হাসান মোহনের সৌজন্যে

গত কয়েক সপ্তাহ ধরে একমাত্র মেয়ে লিলিয়া সিজদার প্রথম জন্মদিন পালনের জন্য বিভিন্ন পরিকল্পনা করছিলেন মোহন ও তানিয়া। মেয়ের জন্মদিনটা স্মরণীয় করে রাখতে এক জোড়া ডায়মন্ডের কানের দুল কিনেছিলেন তারা। প্রথম জন্মদিনে মেয়ের কান ফুটানোর এবং কিয়েভের বাড়িতে একটি পার্টির আয়োজনও করেছিলেন এই বাংলাদেশি প্রবাসী দম্পতি।

গতকাল শুক্রবার মেয়ে লিলিয়া সিজদার ছিল প্রথম জন্মদিন। অথচ মেহেদী হাসান মোহন ও তানিয়া খাতুন তাদের ১ বছর বয়সী মেয়েকে নিয়ে এখন ঝাঁপিয়ে পড়েছেন বেঁচে থাকার লড়াইয়ে।

গতকাল শুক্রবার লিলিয়া সিজদার ছিল প্রথম জন্মদিন। ছবি: মেহেদী হাসান মোহনের সৌজন্যে

রাজধানী কিয়েভ ছেড়ে ইউক্রেনের সীমান্তবর্তী কোভেল শহরে যাওয়ার সময় শুক্রবার বিকেলে মোহন টেলিফোনে দ্য ডেইলি স্টারকে বলেন, 'প্রায় ৩০ ঘণ্টা ধরে গাড়িতে বসে আছি, সবাই সবার খুব কাছাকাছি। কিন্তু যুদ্ধের কারণে সবাইকে নিয়ে জীবন বাঁচাতে পালাচ্ছি।'

'সবকিছু কিয়েভে রেখে এলাম। মেয়ের জন্য কেনা কানের দুলটাও নিতে পারিনি,' বলছিলেন মোহন।

গত বৃহস্পতিবার ইউক্রেনে রুশ বাহিনী সামরিক হামলা শুরুর কয়েক ঘণ্টা পর পরিবারটি কিয়েভের বাড়ি ছেড়ে চলে যাওয়ার সিদ্ধান্ত নেয়। এ সময় হাজারো মানুষ প্রতিবেশী দেশের সীমান্তের দিকে ছুটতে শুরু করে।

একটি নীল রঙের ফরাসি লোগান গাড়িতে যাত্রা শুরু করেন মোহন। সঙ্গে স্ত্রী তানিয়া, মেয়ে লিলিয়া, বন্ধু আব্দুল আওয়াল, আওয়ালের স্ত্রী ও ২ সন্তান। শুক্রবার রাত পর্যন্ত প্রায় ৯০০ কিলোমিটার গাড়ি চালিয়েছেন। শুধু তেল নিতে এবং টয়লেট ব্যবহারের জন্য থামে তাদের গাড়ি।

চলতি পথে সব রাস্তাঘাট প্রায় জনশূন্য ছিল এবং পথে কোনো রেস্তোরাঁও খোলা পাননি তারা।

বাড়ি থেকে বের হওয়ার আগে তারা কয়েকটা স্যুটকেসে কাপড় ও কিছু শুকনো খাবার প্যাকেট করে নিয়েছিলেন। ইতোমধ্যে খাবারও প্রায় শেষ।

শুক্রবার রাতে মোহনের সঙ্গে কথা হচ্ছিল ফেসটাইম অ্যাপসের মাধ্যমে। যানজটে আটকে ছিলেন তিনি। বলছিলেন, 'এটি একটি ভয়ঙ্কর যাত্রা। আমরা বৃহস্পতিবার ইউক্রেনের স্থানীয় সময় দুপুর ২টার দিকে পোল্যান্ড সীমান্তের দিকে যাত্রা শুরু করি। সীমান্ত এখনো ৬ কিলোমিটার দূরে। আমরা গত ৪ ঘণ্টা ধরে একই জায়গায় আটকে আছি। ভয়াবহ যানজট।'

যানজটের দীর্ঘ সারির যানবাহনের ২টি ছবি তিনি পাঠিয়েছেন ডেইলি স্টারের জন্য। ইউক্রেনের সীমান্ত পার হতে আরও ৪ থেকে ৫ ঘণ্টা সময় লাগতে পারে বলে ধারণা করছিলেন তিনি।

মোহনের বাড়ি বাংলাদেশের যশোরে।

পথে ইন্টারনেট ব্যবহারে সমস্যা হচ্ছিল মোহনের। আলাপের সময় বেশ কয়েকবার সংযোগ বিচ্ছিন্ন হয়ে যায়। এক পর্যায়ে তিনি ভয়েস মেসেজ পাঠাতে থাকেন।

পোল্যান্ড প্রবেশের পথে দীর্ঘ যানজট। ছবি: মেহেদী হাসান মোহন

ভয়েস মেসেজে তিনি বলেন তিনি, 'এটা ভালো খবর যে আমরা সীমান্তের কাছাকাছি পৌঁছে গেছি এবং এখন অনেকটাই নিরাপদে আছি। আমরা শুনেছি পোল্যান্ড পাসপোর্ট ও গাড়ির কাগজ থাকলে প্রবেশের অনুমতি দিচ্ছে।'

নিরাপদ স্থানে যাওয়ার পর বাংলাদেশে আসার চেষ্টা করবেন কি না জানতে চাইলে তিনি বলেন, 'সত্যি বলতে আমি জানি না কী করব। আমাদের প্রথমে পোল্যান্ড যেতে হবে। যে কোনো ভাবে আমরা কেবল যুদ্ধের অবসান চাই।'

তার বন্ধু আব্দুল আউয়াল বলেন, 'সব টাকা-পয়সা, সম্পদ, জিনিসপত্র হারিয়েছি। তবে খুশি যে আমরা বেঁচে আছি।'

পোল্যান্ডে গিয়ে কোথায় থাকবেন জানতে চাইলে তিনি বলেন, 'আমরা সেখানে পৌঁছে তারপর সিদ্ধান্ত নেবো।'

অন্য কোনো বাংলাদেশির সঙ্গে তাদের দেখা হয়েছে কি না জানতে চাইলে তিনি বলেন, 'সীমান্ত পার হচ্ছে, এমন কারও কথা আমরা এখনো শুনতে পাইনি। প্রায় ১০ থেকে ১২ জনের সঙ্গে ফোনে যোগাযোগ হয়েছে। তারা বলেছিল যে তারা সীমান্তের দিকে যাচ্ছেন। প্রায় ২০ ঘণ্টা সময় লাগতে পারে ইউক্রেনের সীমানা পার হতে।'

রাশিয়ার হামলায় ইউক্রেনের রাজধানী কিয়েভ ছেড়ে অনেকে পারিয়ে গেলেও কিছু মানুষ রয়ে গেছেন সেখানেই। ভবনের বেসমেন্ট বা বাংকারে অবস্থান করছেন তারা। ছবি: সংগৃহীত

মোহন এবং আউয়ালের মতো কয়েকজন বাংলাদেশি কিয়েভ ছেড়ে গেলেও, অনেকে আবার রয়ে গেছেন।

এমন ৩ বাংলাদেশির সঙ্গে কথা হয় ডেইলি স্টারের। ফারুক আহমেদ তাদের একজন।

৫৮ বছর বয়সী ফারুক পরিবারের সদস্যদের সঙ্গে একটি কিন্ডারগার্টেন স্কুলের বেসমেন্টে ৩০ ঘণ্টা ধরে অবস্থান করছিলেন। ৪৩০ বর্গফুটের বেসমেন্টটিতে কয়েকজন বাংলাদেশিসহ প্রায় ৮০ জন আশ্রয় নিয়েছিলেন।

ফারুক দ্য ডেইলি স্টারকে বলেন, 'আমাদের খাওয়ার জন্য শুধু চা আর বিস্কিট আছে। জানি না কতক্ষণ এখানে থাকতে হবে।'

'সবাই অপেক্ষা করছে কখন এয়ার স্ট্রাইক বন্ধ হবে। বাচ্চাদের চিৎকারে চোখে পানি ধরে রাখা দায় হয়ে উঠেছে। একেকটা বোমা পরার পরে নিজেকে জীবিত অবস্থায় দেখে মনে হয়, এ যাত্রায় বেঁচে গেলাম। প্রতিটি মুহূর্ত আতঙ্ক আর মৃত্যু ভয়ে কাটছে,' বলছিলেন আতঙ্কিত ফারুক।

Comments

The Daily Star  | English
Khagrachhari violence leaves 3 dead

Khagrachhari violence: 3 dead, 4 sent to CMCH 'with bullet wounds'

Three indigenous people died of their injuries at a hospital in Khagrachhari yesterday and early today, hours after arson attacks and violence in the district

3h ago